পদ্মাসেতু দুর্নীতি মামলা ও একটি ডায়েরির কথা

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 18 Feb 2017, 04:26 AM
Updated : 18 Feb 2017, 04:26 AM

৯ ফেব্রুয়ারি কানাডার অন্টারিও সুপেরিয়র কোর্টের বিচারপতি ইয়ান নরধেইমার এসএনসি-লাভালিন (SNC Lavalin) গ্রুপ ইনকর্পোরেটেড দুর্নীতি– যেটা পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত– সে মামলা থেকে অভিযুক্তদের খালাস দিয়েছেন এবং মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। বিচারকের মতে, বিচারিক ক্ষেত্রে যে wiretap প্রমাণ দাখিল করা হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ গুজবের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।

অন্টারিও সুপেরিয়র কোর্টের বিচারপতি ইয়ান নরধেইমার তাঁর রুলিংয়ে বলেন, ২০১১ সালে আরসিএমপি– কানাডিয়ান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অত্যন্ত স্বতন্ত্র ও সম্মানিত অঙ্গ– দায়ের করা এক আবেদনে wiretap ব্যবহার করতে আদালতের অনুমোদন পেতে যে অনুরোধ করেছিল সে সম্পর্কে তাঁর গুরুতর উদ্বেগ ছিল। আরসিএমপি বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের ক্যানাডার এসএনসি-লাভালিন কর্মকর্তারা ঘুষের মাধ্যমে ৫০ মিলয়ন ডলারের একটা প্রোজেক্ট পাইয়ে দেওয়ার জন্য– যে প্রজেক্টের পুরো খরচ আনুমানিক ৫ বিলিয়ন ডলার– তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য wiretap ব্যাবহারের অনুমতি চেয়েছিল।

বিচারক তাঁর রায়ের উপসংহারে বলেন, "wiretap-এ যে প্রমাণসমূহ দাখিল করা হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ গুজবের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। ওইসব গুজব প্রমাণের জন্য যেসব সত্যনিষ্ঠ প্রমাণ দরকার তার কোনোকিছুই আদালতে হাজির করা হয়নি। যেসব প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল তার সবগুলোই ছিল জনশ্রুতি (বা তার চেয়েও খারাপ), অন্যান্য জনশ্রুতি তার সঙ্গে যোগ করে রচিত হয়েছিল।"

আরসিএমপি প্রথমে দুর্নীতির সঙ্গে পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে, কিন্তু অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে– বাংলাদেশ জন্ম নেওয়া এসএনসির প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইসমাইল ও আবুল হাসান চৌধুরী– অভিযোগ ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাহার করে হয়। অবশিষ্ট তিন আসামী, এসএনসির জ্বালানি ও অবকাঠামো ভাইস প্রেসিডেন্ট, কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং বাংলাদেশি-কানাডিয়ান ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগও গত শুক্রবার মিথ্যা প্রমাণিত হল, যখন বিচারক নরধেইমার তিনজনকেই খালাস দিয়ে দেন। এ সিদ্ধান্ত আসে যখন সরকারি অ্যাটর্নি তানিট গিলিয়াম wiretap প্রমাণ বাদ দেওয়ার বিচারকের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর অন্য কোনো সাক্ষী হাজির না করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে।

বিচারক তাঁর রুলিংয়ে বলেন, যেসব তথ্য wiretap-এ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো এসেছিল তিনজন বেনামী বা অবিশ্বস্ত লোকের দ্বারা পাঠানো ইমেইল থেকে। তিনি বলেন, পুলিশ প্রথমে অন্যান্য উৎসকে ইন্টারভিউ করার চেষ্টা করেনি, যদিও ওইসব বেনামীরা আর কিছু লোকের নাম দিয়েছিল এবং যাদের সঙ্গে পুলিশকে যোগাযোগ করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছিলেন।

আমার বর্তমান নিবন্ধটি আমার আগের প্রকাশিত আগের দুটো নিবন্ধের ধারাবাহিকতায় রচিত। নিবন্ধগুলো ঘুষ দেওয়ার ষড়যন্ত্র ঘিরে আবর্তিত যেখানে কন্ট্রাক্টের ১০ থেকে ১২ শতাংশ ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এ অর্থের পরিমান অবশ্য সম্পূর্ণ প্রজেক্টের প্রস্তাবিত খরচের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। তা সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক এবং মিডিয়া অঙ্গনে এটা কেন এত শোরগোল তুলেছে? এর কারণ হল এ ঘটনার বাদী বিশ্বের সর্বশক্তিমান আর্থিক সংস্থা এবং আসামি হল ১৬ কোটি মানুষের দেশের উন্নয়নকামী সরকার, যে দেশের অর্থনীতি এমন স্বনির্ভর নয় যে ওই পরাক্রমশালী সংস্থাকে বিদায় জানাতে পারে। যার ফলে ওই সংস্থাটির দেওয়া অর্থনৈতিক প্রেসক্রিপশন উন্নয়নশীল দেশসমূকে গলাধঃকরণ করতে হয়, তা সে প্রেসক্রিপশন যতই তেতো হোক না কেন।

যে প্রকল্পটি নিয়ে এ নিবন্ধের অবতারণা সেটার সঙ্গে পরিচিত নয় এমন মানুষ হয়তো বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। প্রকল্পটির সফলতা হতে পারত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক বিরাট মাইলফলক। এটা নিয়ে আমি দুটো নিবন্ধ লিখেছিলাম যদিও আমি সাংবাদিক নই, অনুসন্ধিৎসু তো অনেক দূরের কথা। ওইসব নিবন্ধে আমি সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করতে চেয়েছিলাম, যে মিথ্যাগুলো প্রচারিত হয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অপব্যবহার করে, যেখানে সত্যের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়নি। অথচ যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা হাতে হাত ধরে চলার কথা।

প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা না বলে 'স্বেচ্ছাচারিতা' বলাই ঠিক হবে। এই মামলার প্রাকবিচার শুনানির প্রায় পুরোটা সময়টা আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম।যেহেতু শুনানির শুরুতেই মহামান্য আদালত শুনানির সব কার্যবিধি প্রকাশের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন এবং যেটা তিনি শুনারির শেষদিনে পুর্নব্যক্ত করেন এই বলে যে, পরবর্তীতে এই মামলার পূর্ণাঙ্গ বিচার শেষ না হওয়া অবধি সেটা বলবৎ থাকবে। আদালতে আমার প্রশ্নের জবাবে এ নিষেদাজ্ঞার যে কোনো ভৌগলিক সীমারেখা নেই এবং এটা যে ইন্টারনেটসহ সব ধরনের ইলোকট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য– সেটা মহামান্য আদালত পরিষ্কার করেছিলেন।

এ ধরনের পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর সবাই তাদের ইচ্ছামাফিক সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে সংবাদ এবং নিবন্ধ প্রকাশ করে। 'দৈনিক প্রথম আলো'র একই সংখ্যায় আর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যেটাতে বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষ সূত্রের বরাত দিয়ে রমেশ শাহের ডায়েরি সর্ম্পকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল, যে ডায়েরি নিয়েই পুরো দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলাটি আবর্তিত হয়েছিল।

আমি সেই হাতেগোনা মানুষদের একজন যে ওই ডায়েরির গুরুত্বপূর্ণ পাতাটি দেখার সুযোগ পেয়েছি। এ ডায়েরির পাতাটির সত্যতা ও বৈধতাই এ মামলার জয়-পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। অনেক কিছু ভুল তথ্যের সঙ্গে 'দৈনিক প্রথম আলো' লিখেছিল, "রমেশের হাতে লেখা ডায়েরি এই বিশেষ পৃষ্ঠায় এসএনসি-লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেসের স্বাক্ষর রয়েছে।"

সাধারণ জ্ঞানই বলবে কারো ব্যক্তিগত ডায়েরিতে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সহকর্মীর স্বাক্ষর থাকার কথা নয়।

আরসিএমপি পুরো তদন্তটাই শুরু করছে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে। কোনো অবস্থাতেই বিশ্বব্যাংক কোনো ঐশী প্রতিষ্ঠান নয়, আর এক ঝাঁক ফেরেস্তাও এটা পরিচালনা করছে না। আমার জানামতে, প্রাকবিচার শুরুর আগপর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছেও ওই ডায়েরির কোনো কপি ছিল না।সে অবস্থায় কোন দলিলের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে দাবি জানিয়েছিল ডায়েরিতে যাদের নাম রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের?

প্রাকবিচার চলাকালে এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সমঝোতা চুক্তি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। যদিও প্রাকবিচার পরিচালিত হয়েছে এসএনসি-লাভালিনের দুই প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, কিন্তু পরিশেষে এর পরিধি বিস্তৃত হয়েছিল তাদের বাইরে। একজন অভিযুক্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মোহাম্মদ ইসমাইলের কোনো অর্থ প্রদানের ক্ষমতাই ছিল না এবং অন্যজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত রমেশ শাহের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া যে ধরনের আর্থিক লেনদেনের কথা উঠেছে, সেটার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

রমেশ শাহের আইনজীবী ডেভিড কাজিন রায়ের পরে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন–

"আরসিএমপির উচিৎ ছিল পরিষ্কারভাবে ইমেইলকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে কাজ করা, যাদের একজন– পরে আবিস্কার হল– এসএনসির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। জনাব শাহ গত চার বছর ধরে এক ভয়ানক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি চাকরির অযোগ্য হয়েছেন; তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিল। তাঁর স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছে।"

মোহাম্মদ ইসমাইল গতকাল আমাকে জানালেন, তাঁর উজ্জ্বল কর্মজীবন কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর মামলা থেকে অব্যাহতি পান, কিন্তু সব সংগঠনই তাঁকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার বিবেচনা করার পরও এসএনসি মামলার সঙ্গে তাঁর সংযোগের কারণে তারা তাঁকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়নি। কীভাবে তাঁর উজ্জ্বল জীবন এসএনসি দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে সে করুণ কাহিনি তিনি বললেন।

বিনা দোষে যারা তাদের উজ্জ্বল পেশাজীবন ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের শাস্তি কে দেবে? সেটা পুননির্মাণের এবং যে মানসিক দুর্ভোগ ও আর্থিক ক্ষতির এই দীর্ঘ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁরা গেলেন, সেসবের যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ কে দেবে?