রাজীব হায়দার: উদ্ভাসিত দীপের দ্যোতনা

মারুফ রসূল
Published : 15 Feb 2017, 02:02 PM
Updated : 15 Feb 2017, 02:02 PM

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল– পঞ্জিকার পাতা থেকে বেরিয়ে ভাবলে বুঝতে পারি, কতটা রক্তাক্ত মহাযাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পেরিয়ে এসেছে চারটি বছর। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহাবাগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করে বাংলার মানুষ। তীব্র গণ-আন্দোলনে বারবার উচ্চারিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক উৎস বন্ধ করার দাবি।

স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার সুযোগে যেভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি, তার বিরুদ্ধে আঘাত হানে শাহাবাগ আন্দোলন। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিও একাত্তরের মতোই ধর্মের ধুয়া তুলে হত্যা আর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে সূর্যমুখী আন্দোলনগুলো হয়েছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই জামায়াত-শিবিরের এই অপপ্রয়াস লক্ষ্যণীয়।

একাত্তরের মতোই ২০১৩ সালেও তারা 'টার্গেট কিলিং' শুরু করে। উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ও সরকারের মৌলবাদ তোষণনীতির সম্মিলিত প্রয়াস ছিল ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা, যে তালিকা ধরে গত চার বছরে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, ব্লগার, লেখক, শিক্ষক, প্রকাশক, গণমাধ্যমকর্মী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা, এমনকি ইসলাম ধর্মের তত্ত্বগত ভিন্ন তরিকার মানুষদেরও হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং এই পূর্ব-পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডগুলো যে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। আর সেই আদর্শ হল পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী আদর্শ, যা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে অনুমোদন করে না, সমাজে ভিন্নমতের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।

এই কূপমণ্ডুক পাকিস্তানি দর্শনের বিরুদ্ধে লড়াই করে অসাম্প্রদায়িক, সাম্য আর মানবিক মর্যাদার মুক্তিযুদ্ধের দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এই তাত্ত্বিক অবস্থানে দাঁড়িয়েই শাহাবাগ আন্দোলনের সূচনা; আন্দোলনের এই দর্শনগত দিকটিকে দুর্বল করে দিতেই ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে হত্যা করা হয় আমাদের সহযোদ্ধা, লেখক, ব্লগার ও স্থপতি রাজীব হায়দারকে।

মানবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মানুষের মননবোধ জাগ্রত করার সৃজনশীল সংগ্রামের পথ রুদ্ধ করতে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার উদ্দেশে আক্রমণ, ২০০৪ সালে বইমলোয় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ, একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসকে হত্যা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা হারাই রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ফয়সল আরেফিন দীপনসহ রক্তজবার মতো অনেকগুলো নাম।

২.

রাজীব হায়দারের পুরো নাম আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন। ব্লগে তিনি লিখতেন 'থাবা বাবা' ছদ্মনামে। ১৯৭৮ সালে জন্ম নেওয়া রাজীব হায়দারের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায়। স্কুল-জীবন কাটে ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে। পেশায় ছিলেন একজন স্থপতি। স্থাপত্যবিদ্যার পাশাপাশি দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল। মূলত দার্শনিক প্রেক্ষাপটে ঘটনার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের কারণেই ব্লগে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আলোকচিত্র নিয়েও তিনি কাজ করেছেন নিজের মতো। মোবাইল ক্যামেরায় চলতি পথের নানা বিষয় তিনি ধারণ করতেন। তাঁর মাথায় থাকতো স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে ধৃত বিষয়টির সামঞ্জস্য। ফেসবুকে তিনি আলোকচিত্রের একটি সিরিজ পোস্ট করতেন 'থাবাগফুর কম্পোজিশন' নামে। এতে স্থাপত্যবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রবল।

রাজীব হায়দার কাপাসিয়া উপজেলায় তাঁর নিজ গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট তিনি স্মৃতিসৌধের নকশা জমা দেন। ২০১১ সালে নকশাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। প্রায় ৮০ শতাংশ জমির ওপর আটতলা ভবনের সমান উঁচু এই স্মৃতিসৌধটি রাজীব হায়দার বিনা পারিশ্রমিকে করে দিতে চেয়েছিলেন।

মূল নকশায় মাটি থেকে ২১টি সিঁড়ি পেরিয়ে আট ফুট উঁচু বেদি। এই ২১টি সিঁড়ি অমর একুশের চেতনার স্মারক। স্মৃতিসৌধটিতে মুক্তিযুদ্ধকে তিন ভাগে তুলে আনার পরিকল্পনা করেছিলেন রাজীব। স্মৃতিসৌধের ২৬টি স্তম্ভ একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের কথা বলবে। থাকবে সাতটি উঁচু দেওয়াল, যা প্রতিনিধিত্ব করবে সাত বীরশ্রেষ্ঠের কৃতিত্বের। আর ১৬টি সিঁড়ি আমাদের ১৬ই ডিসেম্বরের অম্লান স্মৃতি স্মারক।

২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত কাপাসিয়া উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দীন আলির ভাষ্য অনুযায়ী নকশাটি অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো তথ্য জানা যায়নি।

তবে লেখনীর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বক্তব্যবাদী; মূল বক্তব্যটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আলোকে তুলে ধরাটাই তাঁর কাছে মুখ্য। ফলে তাঁর লেখাগুলো ছিল একটি সহজবোধ্য স্পষ্টবাদিতার বহিঃপ্রকাশ। সমালোচনা থাকতেই পারে, সেটা যে কোনো লেখকের ক্ষেত্রেই সত্য; কিন্তু সেই সমালোচনাকেও রাজীব হায়দার সম্মান করতেন।

দীর্ঘ সময়ের প্রতিষ্ঠিত যে কোনো বিষয়কেও তিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তার আলোকে চ্যালেঞ্জ করতেন। সেটা দর্শন হোক, সাহিত্য হোক বা হোক কোনো মতাদর্শ– স্পষ্টভাবে যুক্তি দিয়ে তিনি নিজের মতামত তুলে ধরতেন। ফলে তাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করা যেত, আলোচনা করা যেত। সমাজে বহুত্ববাদের (Pluralism) গুরুত্ব সম্বন্ধেও তিনি সচেতন ছিলেন।

আমার মনে আছে, ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাবলিক লাইব্রেরিতে 'ব্লগার অ‌্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান)' কর্তৃক আয়োজিত বাংলা ব্লগ দিবসের অনুষ্ঠান শুরুর আগে অনির্ধারিত আড্ডায় বই নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি আমার একটি মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আমার দেওয়া যুক্তি তিনি খণ্ডন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে ভুলগুলো কোথায়। রাজীব হায়দার ধরিয়ে না দিলে আমি হয়তো কিছু ভুল যুক্তি নিয়ে এখনও আলোচনাটি করতাম। এমন স্মৃতি হয়তো অনেকের সঙ্গেই আছে। এভাবেই রাজীব হায়দার যুক্তি তুলে যেমন আমাদের প্রচলিত ধারণা বা প্রথাগত জীবনযাপনের নানা অসঙ্গতি ধরিয়ে দিতেন, তেমনি তাঁর সামনে যৌক্তিকভাবে একটি বিষয় তুলে ধরলেও তিনি তা গ্রহণ করতেন।

মানুষের চিন্তার জগতের যে বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন চিন্তাধারার সহাবস্থান একটি সভ্য সমাজের জন্য যে জরুরি– সেটা রাজীব হায়দার যেমন জানতেন তেমন মানতেনও। দর্শনের বিরুদ্ধে তিনি দর্শনের লড়াই চেয়েছিলেন, ভালোবাসতেন যুক্তি দিয়ে যুক্তিকে খণ্ডন করতে। চিন্তার স্বাধীন যৌক্তিক প্রকাশের পথ রুদ্ধ হলে গোটা সমাজব্যবস্থা কীভাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় পর্যবসিত হয়, সেটা তিনি জানতেন।

বস্তুত, এখন আমরা তা দেখতেই পাচ্ছি। অথচ কী নির্মম! এই উদারনৈতিক মানুষটি মুক্তবুদ্ধি চর্চা, মুক্তচিন্তার প্রকাশ আর জাতির ইতিহাসের দায় শোধের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার জন্য চাপাতির আঘাতে নৃশংসভাবে নিহত হলেন।

৩.

২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার 'দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩'-এর বিচারক সাঈদ আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ড মামলার রায় ঘোষণা করেন। রাজীব হায়দারের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিনের দায়ের করা মামলায় নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রেদোয়ানুল আজাদ রানা (পলাতক) ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ে মাকসুর হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। এছাড়া আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানিকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসামি সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।

আত্মস্বীকৃত খুনিদের এই লঘু দণ্ড প্রত্যাখ্যান করেছে গণজাগরণ মঞ্চ এবং রাজীব হায়দারের পরিবার। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আপিল করেন রাজীব হায়দারের বাবা। ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর এ মামলার শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি শেষ হয় রাজীব হায়দার হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি।

আমরা অপেক্ষা করছি রায়ের জন্য, ন্যায়বিচারের জন্য।

একাত্তরের ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি নিয়ে ৩০ লক্ষাধিক শহিদের পক্ষে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় লাখো মানুষের সঙ্গেই স্লোগান ধরেছিলেন রাজীব হায়দার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর তীব্র লেখনীগুলো কত নাম না-জানা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানবিক মর্যাদাবোধসম্পন্ন হতে। তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার কি আমরা পাব না?