মহাজোট সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য ও অগ্রগতি

Published : 18 Jan 2012, 12:26 PM
Updated : 18 Jan 2012, 12:26 PM

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ 'রূপকল্প-২০২১' বাস্তবায়নকে সামনে রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে- 'রূপকল্প ২০২১' বাস্তবায়নের মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তি সমৃদ্ধ, উন্নত ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিগণিত করা। 'রূপকল্প ২০২১' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের মাধ্যমে ২০১৪ ও ২০১৭ সাল নাগাদ জাতীয় প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ১০ শতাংশে উন্নীত করা।

২। সরকারের ক্ষমতা গ্রহণকালে চ্যালেঞ্জ

এ সরকারের সাফল্য ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরার আগে স্মরণ করা প্রয়োজন- সরকার ক্ষমতা গ্রহণকালে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কী ছিল।

 চারদলীয় জোটের পাঁচ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাসবাদ, হত্যা ও লুণ্ঠন ছিল দেশের বাস্তবতা। সংখ্যালঘু ও বিরোধীদলের নির্যাতন, রাজনৈতিক হত্যা, সম্পদ ও ব্যবসা দখল ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়।

 শাসনযন্ত্র ছিল দুর্বল ও বিপর্যস্ত। দলীয়করণের অভিশাপ আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বিনষ্ট করে। এডহক সিদ্ধান্তের ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে হয় গাফলতি ও দুর্নীতি যার ফলে জনবলে কমতি ছিল ব্যাপক।

 কমিশন ছাড়া কোন বড় ধরনের ক্রয় বা ঠিকাদারি চুক্তি সম্ভব ছিল না বলে বিদেশী ঠিকাদার ও সরবরাহকারী অনীহা প্রকাশ করে এবং উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

 বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ উপায়ে বিদেশে আয় করা ছিল প্রভাবশালীদের নেশা।

(এ ব্যাপারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিকট-আত্মীয়েরা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।)

 দেশে জ্বালানি সংকট ছিল স্বাভাবিক অবস্থা, গ্যাস তেলের অনুসন্ধান বা গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন ছিল বন্ধ। কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা বা কোন কেন্দ্রের মেরামত না করার ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।

 বিএনপি'র কৃষক ও গ্রামবিমুখ নীতির ফলে খাদ্য উৎপাদনে ছিল বন্ধ্যাত্ব ও গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত।

 ২০০৭ সালে সিডোর এবং ২০০৯ সালে আইল্যার ধ্বংসলীলায় দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকা ছিল বিপর্যস্ত।

 ২০০৮ সালে খাদ্যপণ্য, তেল ইত্যাদির মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের দুর্যোগ ছিল ভয়াবহ ও দারিদ্র্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

 ২০০৭-২০১০ সময়ের বিশ্বমন্দার শিকার হয় বাংলাদেশ।

সরকারকে একসঙ্গে দুঃশাসন ও দুর্নীতির মোকাবেলা করতে হয় এক হাতে আর অন্য হাতে বিশ্বমন্দা ও মূল্যস্ফীতিকে করতে হয় নিয়ন্ত্রণ। সরকার শক্তহাতে জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ করে ও পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করে। ৩০ বছর পরে হলেও সরকার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচার শুরু করে। সরকার দুর্নীতির অপবাদ রোধে কঠোর অবস্থান নেয় এবং অন্ততঃ উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সাথে সাথে সরকারের জনবল শক্তিশালী করতে ব্রতী হয় এবং তিন বছরে প্রায় দুই লাখ সরকারি চাকুরেদের নিযুক্তি দেয়। সরকারের কৃতিত্ব হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি।

সরকার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ক্রান্তিলগ্নে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুরুহ দায়িত্ব সাহস ও প্রজ্ঞার সাথে মোকাবেলা করেছে। গত তিন বছরে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে ব্যাপক সুদূরপ্রসারী সংস্কার কার্যক্রম, সুষ্ঠু বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং প্রণোদনার মতো কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলাও বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।

৩। মহাজোট সরকারের অঙ্গীকার

ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে ২০০৯-১০ সালের বাজেট প্রণয়নের সময় মহাজোট সরকার নিম্নোক্ত ঘোষণা দেয়ঃ

 "মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ওয়াদার প্রথম বিষয়টি ছিল মহামন্দার মোকাবেলা, দ্রব্যমূল্যের হ্রাসকরণ এবং দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে বা যথাসময়ে আমদানি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।"

 "আমাদের আরেকটি অঙ্গীকার ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান এবং সেই লক্ষ্যে একটি তিনসালা জরুরি কার্যক্রম বাস্তবায়ন।"

 "অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রধান খাতগুলো হল- কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিধান।" "………. কর্মসংস্থানের সুযোগ, সরকারি ব্যয়ের প্রসার এবং বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি সম্ভব নয় বলে এইসব ক্ষেত্রে আমরা সবিশেষ নজর দিয়েছি। সর্বোপরি, দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাই আমরা ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি যেমন সহজতর করতে পারে, তেমনি দুর্নীতি প্রশমনে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। সর্বোপরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে তথ্য-প্রযুক্তি বিনিশ্চায়ক ভূমিকা পালন করবে।"

৪। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সার্বিক সাফল্যের সারাংশ

সরকারের অঙ্গীকার মত প্রতিকূল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলা করে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখাই সরকারের অন্যতম প্রধান অর্জন। গত তিন বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে তার সার্বিক চিত্রটি নিম্নরূপঃ

(১) সারাবিশ্বে মহামন্দার সময়ও বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিটেন্স বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং বিনিয়োগ কখনও নিম্নগামী হয় নি (গড়ে ২৪.৫ শতাংশ)। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী পণ্য ও সেবা রপ্তানি যেখানে ২০.৪ শতাংশ সংকুচিত হয় সেখানে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় ১০.৩ শতাংশ। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহ ৫.৩ শতাংশ হ্রাস পায়, অথচ সে বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৯.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

(২) ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় পরবর্তী দুই অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রশমিত হয়। বর্তমান অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা তা কেবল বাংলাদেশে নয়, বিকাশমান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

(৩) সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক নীতিমালা অবলম্বন করেও বাজেট ঘাটতি ৪ শতাংশের সামান্য উপরে থাকে।

(৪) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ৬.১ বিলিয়ন থেকে ১০.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

(৫) সরকারি বাজেটের আকার, রাজস্ব আদায় এবং সরকারি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে (উন্নয়ন কার্যক্রমে এই ধারা বহাল থেকেছে)। রাজস্ব আদায় ৬৪,৫০০ কোটি থেকে বাড়ছে ১,১৮,০০০ কোটি ও মোট সরকারি ব্যয় বাড়ছে ৮৯,০০০ কোটি থেকে ১,৬৩,৫০০ কোটি টাকা।

(৬) বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে নতুন অর্থের যে অঙ্গীকার পাওয়া গেছে তাও দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। অঙ্গীকার ২৮০০ মিলিয়ন থেকে ৫৯০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

(৭) মন্দার মধ্যেও জনশক্তি রপ্তানি বহাল থেকেছে এবং বর্তমান বছরে তা প্রায় পাঁচ লাখে পৌঁছাবে।

(৮) কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে জোরদার রেখেছে। মানুষের আয় বাড়িয়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।

(৯) সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ফলে দারিদ্র্য কমেছে, বিশেষ করে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে এবং বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রভাব বঞ্চিতদের উপরে পড়ে নি।

(১০) অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে অর্থনীতির গতিশীলতা জোর পেয়েছে এবং শিল্পখাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানি নির্ভর সরবরাহের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু রেন্টাল সরবরাহের অবসায়নে তা তিন বছরে অনেক কমে আসবে।

(১১) বিভিন্ন কর্মসংস্থান কার্যক্রমের ফলে বেকারত্ব বাড়ে নি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য এসেছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৩১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

৫। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঃ চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

৫.১. ২০১১-১২ সালে বাজেট উপস্থাপনাকালে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং দেশের সমৃদ্ধির জন্য এই সরকার তাদের কৌশল বিবৃত করে এই বলে-

দুইটি বছর বিশ্ব মহামন্দার সফল মোকাবেলা করে দেখা গেল যে, ২০১১-১২ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য এবং তেলের দাম যেভাবে বাড়তে থাকলো তাতে মূল্যস্ফীতি একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে সামনে আসলো। এই অবস্থা অনুধাবন করে ২০১১-১২ সালের বাজেটে মহাজোট সরকার ঘোষণা দিল যে, খাদ্যপণ্যের মূল্য এবং জ্বালানি তেলের বৃদ্ধিজনিত "অভিঘাত মোকাবেলার জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন- হয়তো বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হতে পারে। (ক) ভর্তুকিসহ কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় হ্রাস,

(খ) প্রয়োজনে কৃচ্ছ্রতা সাধন, (গ) রাজস্ব আয় বাড়ানো, (ঘ) মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যক্তিখাতে ঋণ সরবরাহ কমানো এবং (ঙ) বিনিময় হারের যথাযথ বিন্যাস (exchange rate alignment) করা।"

৫.২. অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ অভিঘাত মোকাবেলা করে বাংলাদেশ গত তিন বছর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাসহ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জিডিপি'র ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়ার সাথে সাথে আয়-দারিদ্র্যের হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে (Inclusive growth)। পাশাপাশি, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের ফলে বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাত পরিস্থিতির উন্নতি, তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স-এর প্রবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অর্জন প্রণিধানযোগ্য।

৫.৩. ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে অর্থনৈতিক নীতিমালা সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির জন্য কাজ করে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা, মহামন্দার মুখে রপ্তানি ধরে রাখা, ঋণখেলাপি থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেয়া, কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং সামাজিক ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা – এইসব উদ্যোগের জন্য মুদ্রা ও ঋণনীতি থাকে মোটামুটি সম্প্রসারণশীল। সম্প্রসারণশীল ধারার পরিবর্তন সূচিত হয় ২০১১-১২। মুদ্রা সংকোচন হয় অপরিহার্য, ঋণপ্রদানেও আসে কড়াকড়ি। কিন্তু সরকারের ভর্তুকির দায় তত দ্রুততার সঙ্গে কমানো হয় কষ্টকর। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারে গাফলতি ও শ্লথগতি। এতে নির্ধারিত ঘাটতি বাজেটে টানপোড়ন চলে। আবার আমদানি বাণিজ্যে নিম্নগতিও আসতে দেরি হয়। এজন্য সাময়িকভাবে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যায় এবং মুদ্রামানে দ্রুত অবচিতি ঘটে। অন্যদিকে পর পর আড়াই বছর অর্থনৈতিক ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রত্যাশার হয় বিস্ফোরণ এবং ভর্তুকির জন্য চাহিদা, বাজেট বরাদ্দের জন্য দাবি বাড়তেই থাকে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের সাবধানতা গ্রহণ করতে হয়েছে।

৫.৪. বর্ণিত পরিস্থিতিতে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং এ সকল ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন নীতি-কৌশল গ্রহণ করেছে।

ক) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রচেষ্টা জোরদার

 এনবিআর রাজস্ব আদায়

 'বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি' ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়ন;

 ভ্যাট আদায়ের compliance বৃদ্ধি;

 কর-ফাঁকি রোধে কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ;

 গ্রোথ সেন্টারসমূহকে ভ্যাট ও আয়করের আওতাভুক্তকরণ।

 নন-এনবিআর ও এনটিআর রাজস্ব আদায়

 ২০০০ সালের পূর্বে নির্ধারিত ফি/রেটসমূহ বর্তমান বাজারমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আবশ্যিকভাবে পুনঃনির্ধারণ;

 ২০০০-০৬ সময়ে নির্ধারিত ফি/রেটসমূহ বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা ও পুনঃনির্ধারণ।

 নতুন ভ্যাট ও আয়কর আইন প্রণয়ন

 ভ্যাট আইনের খসড়া জানুয়ারি ২০১২ এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থাপন।

খ) সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা ও ব্যয় সংকোচন

 অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় ব্যয় সীমিত রাখা

 সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়িক্রয়, নতুন ভাতা প্রচলন না করা এবং বিদ্যমান ভাতার হার বৃদ্ধি না করা;

 খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় খাদ্য আমদানি (চাল) হ্রাস করা।

 বর্তমান আর্থিক সীমাবদ্ধতার বিষয় বিবেচনা করে এডিপি'র ব্যয় অগ্রাধিকারভিত্তিক করা

 পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক চিহ্নিত 'উচ্চ অগ্রাধিকার', 'অগ্রাধিকার' ও 'কম অগ্রাধিকার'- এ তিন ধরনের প্রকল্পের মধ্যে উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান।

 বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্প সাহায্যের ব্যবহার

 পাইপলাইনে থাকা প্রতিশ্রুতি প্রকল্প সাহায্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও দাতা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা।

গ) ভর্তুকিজনিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা

 জ্বালানি খাতে ভর্তুকিজনিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশীয় বাজারে জ্বালানি পণ্যের মূল্য পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা;

 বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সীমিত রাখার লক্ষ্যে-

 পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের ট্যারিফ adjustment অব্যাহত রাখা;

 জ্বালানি খাত সম্পর্কিত পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কয়লা, গ্যাস, তাপবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বাস্তবায়ন।

 কৃষি ভর্তুকি লক্ষ্যভিত্তিক করার জন্য জ্বালানি বাবদ প্রদত্ত ভর্তুকি সুবিধা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সরাসরি প্রদানের কৌশল নির্ধারণ;

 কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে বিতরণের কৌশল নির্ধারণ;

 আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন প্রকার সারের স্থানীয় বিক্রয়মূল্য পুনঃনির্ধারণ।

ঘ) ব্যাংক উৎসের উপর চাপ কমাতে ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস হতে প্রাপ্তি বাড়ানোর উদ্যোগ

 জরুরি ভিত্তিতে, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র হতে প্রাপ্তি বাড়াতে বিশেষ প্রচারণা (compaign) চালানো এবং প্রয়োজনে সুদের হার (সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়ামসহ) বাড়ানো।

ঙ) মুদ্রাখাতসহ লেনদেন ভারসাম্য রক্ষা

 মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের অবচিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ ও ঋণের প্রবৃদ্ধি (বিশেষ করে সরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ) সীমিত রাখা;

 দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অনুদান ও concessional ঋণের পাশাপাশি বিকল্প অর্থায়নের উৎস বিবেচনা;

 উন্নয়ন সহযোগী দেশ বা সংস্থার সম্ভাব্য অর্থায়নে বৃহৎ প্রকল্পসমূহ [যেমন- পদ্মা সেতু,

এমআরটি-৬] বাস্তবায়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যা লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে;

 জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে

 বিদেশ-গমনেচ্ছু শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহকে সম্পৃক্ত করা।

৫.৫ গৃহীত এবং চলমান বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণ (নীট ওভার ড্রাফট) ডিসেম্বর ২০১১ এর শুরুতে যেখানে ছিল ১৪,১২০ কোটি টাকা তা ডিসেম্বর ২০১১ শেষ নাগাদ ১০,০০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। পাশাপাশি যৌক্তিক মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান নিরুৎসাহিত করার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং খাদ্যপণ্য আমদানি হ্রাসের ফলে সার্বিকভাবে আমদানি কমে আসছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানি ব্যয় হ্রাস এবং জনশক্তি রপ্তানির এ ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ হ্রাস পাবে। একইসাথে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হতে প্রাপ্ত সহজশর্তে ঋণ ব্যবহার বেগবান হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ মুদ্রাবাজারে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়বে যা টাকার বিনিময় হারকেও স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবে। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজন ও অসহিষ্ণুতা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী