বুশ-ওবামার পথেই ট্রাম্প

পিটার ভ্যান বিউরেন
Published : 29 April 2017, 03:28 PM
Updated : 29 April 2017, 03:28 PM

যাঁরা বলছেন, 'এরা আমরা নই', তাঁরা একটু পেছনে তাকান। দুঃখজনকভাবে আমরা সবসময় এরকমই ছিলাম।

মুসলমান অধ্যুষিত সাত দেশের শরণার্থী ও নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ নতুন নয়। দীর্ঘকাল আমেরিকায় থাকা অন্ধকার দিকেরই নতুন রূপ। এই নির্বাহী আদেশ নজিরবিহীন নয়; এটা নতুন সংস্করণ মাত্র।

এই আদেশের আওতায় থাকা ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেন– এ দেশগুলো নাইন-ইলেভেনের পর থেকে আমেরিকার অভিবাসন আইনের আওতায় ভিন্নভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যাক। ট্রাম্পের আদেশে শুধু সিরিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য দেশগুলো এসেছে ওবামা আমলের ২০১৫ সালের একটি আইন, '৮ ইউ.এস.সি. ১১৮৭(এ)(১২)'-এর কথা উল্লেখ করায়। (এই তালিকায় ট্রাম্পের ব্যবসায়ী স্বার্থের কিছু নেই। তিনি এটা তৈরি করেননি। নাইন-ইলেভেন-পরবর্তী স্ক্রুটিনি থেকে সৌদি আরবকে বাদ রাখা প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্টও নন তিনি।)

২০১৫ সালের 'ভিসা ওয়েভার প্রোগ্রাম ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড ট্যুরিস্ট ট্রাভেল প্রিভেনশন অ্যাক্ট'-এ কেউ কখনও নির্দিষ্ট কতগুলো দেশ ভ্রমণ করে থাকলে তার জন্য আমেরিকার 'ভিসা-ফ্রি' ভ্রমণ সুবিধা বন্ধ হয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রিটিশ নাগরিকরা ভিসা ছাড়া কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য যোগ্যে হলেও তাকে জেরার মুখে পড়তে হবে এবং আমেরিকান কোনো দূতাবাস বা বিদেশের কোনো কনস্যুলেট থেকে পাসপোর্টে ভিসার জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে। সাংবাদিক বা স্বেচ্ছাসেবী, স্বাস্থ্যকর্মীদের দলের সদস্য হিসেবে তার ভ্রমণ হলেও এই বিধান কার্যকর হয়।

ট্রাম্প তাঁর রূঢ় ভঙ্গিতে কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের (এক্সট্রিম ভেটিং) প্রস্তাব করেছেন; একই ধরনের প্রক্রিয়া জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন থেকে চালু রয়েছে, যা বারাক ওবামার সময়ও অব্যাহত ছিল এবং এখনও চলছে। এর একটি অরওয়েলিয়ান নাম রয়েছে– 'অ্যা ডমিনিস্ট্রেটিভ প্রোসেসিং'। এর প্রভাব যে দেশগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ে, সেগুলো এই সাত দেশই। এসব দেশের নাগরিকদের একটি বিকল্প ভিসা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যাতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার যাচাই-বাছাইয়ের কারণে তাদের ভ্রমণ বিলম্বিত হয়। কিছু আবেদন অনির্দিষ্টকালের জন্য পড়ে থাকে।

পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মীদের তৈরি করা নথিতে এসব পদক্ষেপ নিয়ে এর চেয়ে উদার কিছু ছিল না। চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে বিশেষ কোনো শরণার্থীদের সম্পর্কিত প্রকৃত ঘটনা যখন শোনা গেল তখন তা নেওয়া হল গভীর আবেগ দিয়ে। এতে অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কম লোককে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার বাইরে থেকে গেল।

শরণার্থী নেওয়ার বিষয়ে আমেরিকা বছরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করে; ২০১৬ অর্থবছরে এটা ছিল ৮৫ হাজার। ৮৫ হাজার ১ নম্বর শরণার্থীর বিষয়টি যত জরুরিই হোক না কেন তাকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত।

২০০৬ সালে ফিরলে দেখা যায় শরণার্থীর সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ৭০ হাজারে, যদিও প্রকৃতপক্ষে ৫০ হাজারের কম লোককে আনা হয়েছিল। আমেরিকানরা ঐতিহাসিকভাবে শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর বদলে তাদের নিয়ে আতংকে ভুগলেও কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের ঢল নামে– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ (সাড়ে ছয় লাখ বাস্তুচ্যুত, অর্ধেক আমেরিকানই বিরোধিতা করেছিল) এবং ভিয়েতনামের 'বোট পিপল' (এক লাখ ৩০ হাজার, সে সময় আপত্তি জানায় ৫৭ শতাংশ আমেরিকান)।

১৯৮০ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র সব মিলিয়ে ২০ লাখের কম শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের ৪০ শতাংশই শিশু, যারা শরণার্থী মা-বাবার হাত ধরে এসেছিল। সেই তুলনায় শুধু ওবামা প্রশাসনই ২৫ লাখ মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়।

সব মিলিয়ে ৩০ জন আমেরিকান গভর্নর বলেছেন, পারলে নিজেদের স্টেটে সিরীয় শরণার্থীদের ঢুকতে দিতেন না তাঁরা। আমেরিকার ৬০ শতাংশ নাগরিকই সিরীয় শরণার্থীদের নেওয়ার বিপক্ষে। 'সন্ত্রাসপ্রবণ অঞ্চলগুলো' থেকে অভিবাসন বন্ধের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে আমেরিকার অর্ধেকের সামান্য কম জনগণ।

২০১৬ সালে সিরীয় শরণার্থীদের জন্য আমেরিকার কোটা ছিল ১০ হাজার। ওই বছর কানাডা শুধু সিরীয় শরণার্থীই নিয়েছিল ২৫ হাজার। আর জার্মানি ২০১৫ সালে সিরীয়সহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী নেওয়ার পর ওই বছর নেয় আরও তিন লাখ।

'৮ ইউ.এস.সি. ১১৫২ সেকশন ২০২(এ)(১)(এ)'-তে 'জাতীয়তা, জন্মস্থান বা বসবাসের স্থানের' কারণে অভিবাসীদের (বৈধ স্থায়ী বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত, গ্রিন কার্ডধারী) নিষিদ্ধ করা আইনসিদ্ধ নয়। তবে ট্যুরিস্ট বা শিক্ষার্থী এবং শরণার্থীদের মতো নন-ইমিগ্রান্টদের একই ধরনের কারণে নিষিদ্ধের বিষয়ে এ আইন নিশ্চুপ।

আবার জাতীয়তা বা জন্মস্থানের বিচারে বৈধ অভিবাসীরা নিষিদ্ধ না হলেও নির্দিষ্ট কিছু দেশ থেকে কতজনকে ইমিগ্রান্ট করা হবে তার যে সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তা 'ভার্চুয়াল' নিষেধাজ্ঞার কাছাকাছি। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান নাগরিকদের আত্মীয় অনেক ফিলিপিনো ও মেক্সিকানকে গ্রিন কার্ড পেতে ২৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা (আরেকটি অরেলিয়ান টার্ম–'প্রায়োরিটি ডেট') করতে হয়। এমন ঘটনা বিরল নয় যে, নিজের পালা আসার আগেই আবেদনকারী মারা গেছেন।

ট্রাম্পের আদেশ চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হবে। ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল স্যালি ইয়েটসের নিজের দপ্তর ট্রাম্পের আদেশ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করার পরও তিনি আদালতে এর পক্ষে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানানোর পর বরখাস্ত হয়েছেন, তাঁর আপত্তি দেখা গেছে আইনি দিকের চেয়ে আদেশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এই আদেশ 'বিচক্ষণ বা ন্যায়সঙ্গত' কি না তা নিয়ে ব্যক্তিগত আপত্তি তুলেছেন তিনি।

বিদেশি মিশনগুলোতে নেওয়া ভিসা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বিচারিক পুনর্বিবেচনার সুযোগ না রাখার দীর্ঘদিনের যে বিধান তা ২০১৫ সালে পুনর্বহাল রাখে আমেরিকার আদালত। অর্থাৎ ওইসব সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আমেরিকার আইনে বিদেশিদের সুরক্ষার যে দিক রয়েছে সেগুলোও যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত দেশের বাইরে প্রয়োগ করে না। সুপ্রিম কোর্ট ইমিগ্রেশন আইনের 'অবাধ ক্ষমতার' নীতি স্বীকার করে নেয়, যাতে অধিকাংশ স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থেকে যায়।

গত ফেব্রুয়ারিতে যে আইনি জয় এসেছে তা শুধু আমেরিকার ভেতরে ট্রাম্পের আদেশের কার্যক্রম স্থগিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা কোনো নীতির ভিত্তিতে হয়নি। সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।

যাহোক, অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্পের আদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল এর মূল চালক: আতংক। ২০০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকার আতংকের শিখায় হাওয়া দিচ্ছে। আমেরিকানদের দেশের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলার চেয়ে অন্য কারণে মারা পড়ার সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেশি থাকলেও ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের মতো জনগণকে স্বদেশে হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছেন সেই আতংক ব্যবহার করে– বিদেশি জঙ্গিরা যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়ছে। নির্বাহী আদেশের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ট্রাম্পের মুখপাত্র শন স্পাইসার বলেছেন:

"যদি আমরা বসে থাকি এবং কেউ নিহত হয় তাহলে কী হবে?"

ইমিগ্রেশন আমেরিকাকে নিরাপদ করবে এমন কোনো কিছু ট্রাম্প করেননি। নাইন-ইলেভেন পরবর্তীতে মঞ্চস্থ নিরাপত্তা বিষয়ক (সিকিউরিটি) অনেক নাটকের মতোই নিরাপত্তা এর মূল বিষয় নয়। আতংক বজায় রাখা এবং রাজনীতিচালিত কল্পকথা যে দেশের নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে সরকার– এটা টিকিয়ে রাখাই এর মূল উদ্দেশ্য। ট্রাম্প এটা জানেন, যেমনটি করেছিলেন ওবামা ও বুশ।

কদর্য সত্য হচ্ছে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হওয়া সত্ত্বেও অনেক আমেরিকানই বিদেশিদের নিয়ে আতংকিত এবং ট্রাম্প যা দিচ্ছেন তা তাদেরও চাওয়া। এরা সবসময়ই আছে।

[রয়টার্সে ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত পিটার ভ্যান বিউরেনের 'Trump's visa ban isn't as new as you think' লেখাটি ভাষান্তর করেছেন আজিজ হাসান]