নির্বাচন কমিশন কড়চা

সাব্বির আহমেদ
Published : 12 Feb 2017, 04:45 AM
Updated : 12 Feb 2017, 04:45 AM

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে চলা রাজনৈতিক আলোচনা-পর্যালোচনার একটা পর্ব শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সাবেক সচিব কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের অন্য চার সদস্য হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা একমাত্র রাষ্ট্রপতির। তবে রাষ্ট্রপতি একক সিদ্ধান্তে একাজ করেননি। তিনি কীভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আলোচনার সময় দলগুলো রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি সেসব পরামর্শ গ্রহণ করে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সৃষ্ট পথ অনুসরণ করে ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। সার্চ কমিটি নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পেতে পারে এমন পাঁচজনের নাম গ্রহণ করেছে। এসব নামের মধ্যে থেকে দশজনের নাম সম্বলিত একটি তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করে তারা। তালিকায় উল্লেখিত দশজনের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন।

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনার সময় অনেকগুলো প্রস্তাব আসে। মিডিয়ায় সেসব প্রস্তাবের বিষয় নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে। তবে সব দলের সব প্রস্তাব তালিকাবদ্ধভাবে পাওয়া যায়নি। সে কাজটি মিডিয়া খুব সহজেই করতে পারত। আর তা করলে এই দাবি এবং সুপারিশগুলো একটা জাতীয় দলিল হয়ে থাকত যা দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাধারা সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যেত, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক গবেষকদের কাজ সহজ হত। বড় দলগুলোর দাবি এবং সুপারিশ কিছুটা বিস্তারিত পাওয়া গেছে। অন্যদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে থেকে কিছু চুম্বক অংশ সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখলেও পরে সেখান থেকে সরে এসেছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করার বিরোধিতা করেছে। পরবর্তী সময়ে বিএনপি বলেছে, স্বল্প সময়ের মধ্যে তড়িঘড়ি করে আইন করা উচিত হবে না। আওয়ামী লীগও পরবর্তীতে সেরকম মত প্রকাশ করলে আইন প্রণয়নের বিষয়টি আলোচনা থেকে সরে যায়।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের নিমিত্তে আইন প্রণয়ন করার প্রতি ইঙ্গিত করা আছে। আইনটি প্রণয়ন করতে কোনো রাজনৈতিক দলকে আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। দেশে অনেক আইনি জটিলতার নিরসন আওয়ামী লীগ সরকারগুলোর সময় হয়েছে। এ বিষয়ে একটা আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিতে আওয়ামী লীগকে বা অতীতে বিএনপিকে দেখা যায়নি। তার মানে হতে পারে এই যে, নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলে নিজেদের সুবিধামতো কমিশন গঠন করা যাবে না।

নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন কতটা সুবিধা দেবে তা নির্ভর করে নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঘটমান আরও শত শত রাজনৈতিক উপাদানের উপর। সরকারি দলের প্রত্যাশামাফিক সম্ভাব্য ঘটনাবলী যদি ঠিকঠাকভাবে ঘটে তবেই নিজেদের ইচ্ছামাফিক নির্বাচন কমিশন গঠনের সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। তা-ও আবার নির্ভর করবে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একার উপর নয়, সব নির্বাচন কমিশনারের যৌথ ইচ্ছার উপর। একজন নির্বাচন কমিশনার যদি কোন বিষয়ে দ্বিমত করে এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করে তবে আর নিয়োগ কর্তাদের ইচ্ছা পূরণ হবে না।

নবগঠিত নির্বাচন কমিশনে একজন আছে বিএনপি প্রস্তাবিত কমিশনার। তিনি একাই অন্যান্য কমিশনারদের সম্ভাব্য 'অসৎ' ইচ্ছা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিলে পুরো কমিশন আর কিছুই করতে পারবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত হাজার হাজার রাজনৈতিক ইস্যুর উপর নিয়ন্ত্রণ এককভাবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে রাখা সম্ভব হবে তখনই, যখন অন্যান্য দলের জনসমর্থনের জোড় থাকবে না। এতসব 'যদি', 'কিন্তু', 'তবে'র কথা না ভেবে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটা আইন প্রণয়ন করতে পারলে ভবিষ্যতে অনেক অহেতুক বিতর্কের অবসান ঘটবে।

নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া আইনের মাধ্যমে সৃষ্টি করার দাবি রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে সিপিবির পক্ষ থেকে। নির্বাচনকালীন সরকার কীভাবে গঠিত হবে তা সংবিধানে উল্লেখ করা আছে। আলাদা আইন কেন লাগবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো থেকে এই দাবির মাধ্যমে সিপিবি আসলে কী চাইছে তা-ও পরিষ্কার হয়নি। তারা যদি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য ভিন্ন কোনো উপায় ভেবে থাকে তবে সেকথা জনসমক্ষে বলতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ছাড়াই বিএনপি এখন 'নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার' গঠনের কথা বলছে। তেমনি সিপিবির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা হতে পারে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো উপায় বের হলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তা আইনে রূপ দেওয়া যেতে পারে।

বিএনপি এবং সিপিবির মতো ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে কথা বলছে না আওয়ামী লীগ। তারা একদিকে যেমন সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে, অন্যদিকে তারা নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে–

নির্বাচনকালে নির্বাহী বিভাগের দ্বায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবল অত্যাবশ্যকীয় দৈনন্দিন কার্যাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা; জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং ব্যবস্থা চালু করা; ছবিযুক্ত নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন; ভোট গ্রহণের দিন এবং তার আগে ও পরে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নির্বাচনী কাজে নিয়োগ না করা; দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে মিডিয়া ও সুশীল সমাজের নির্মোহ তৎপরতা নিশ্চিত করা; নির্বাচনে পেশিশক্তি এবং অর্থের প্রভাব বন্ধ করা; ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সব পর্যায়ের ভোটারদের অবাধ ভোটদানের সুযোগ নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যাস্ত করা।

এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পাওয়া সম্ভব। বাস্তবায়ন করাটাই চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশন একা নয়, সব পক্ষকেই মোকাবিলা করতে হবে।

অনেক নির্বাচনী তত্ত্ব নিয়ে বহুকাল ধরে বিভিন্ন রকমের গবেষণা বাংলাদেশে হয়েছে। তার কোনো কোনোটি ভালো ফলও দিয়েছে। কিছুকাল পরে সে তত্ত্ব আবার অপপ্রয়োগ করে সেখান থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে; সে চেষ্টা ব্যর্থও করে দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন তত্ত্ব দিয়ে ভালো নির্বাচন পাওয়া যাবে এমন আশা আর জাতি করে না। করে না এজন্য যে যতদিন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হবে ততদিন কোনো তত্ত্বই কার্যকর হবে না। যতদিন রাজনৈতিক দলগুলো মনে-প্রাণে ভালো নির্বাচন না চাইবে; যতদিন দলগুলো নিজেরা নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত না হবে ততদিন কোনো নির্বাচনী ফরমুলা বা নির্বাচন কমিশন স্থায়ীভাবে ভালো ফল দেবে না।

নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংবিধান এবং আরপিওতে যেসব আইন বিদ্যমান রয়েছে তা যে কোনো বিচারে আন্তর্জাতিক মানের। পৃথিবীর বহু দেশ একই নিয়মে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে; বাংলাদেশ পারছে না। বাংলাদেশ পারছে না তার কারণ আর কিছু নয়, এখানকার নির্বাচনী সংস্কৃতি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে সামরিক শাসকেরা এবং তাদের অনুসারীরা এখানকার নির্বাচনী সংস্কৃতি বিনষ্ট করেছে 'হ্যাঁ'-'না' ভোট, 'মাগুরা মার্কা' নির্বাচন, 'আজিজ মার্কা' নির্বাচন কমিশন এবং বিচারপতিদের বয়সের সীমা বাড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের লোকদের দিয়ে গঠনের চেষ্টা করার ফলে। এতে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে।

২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ ৭,০০০ সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করে দেখালেও জামায়াত-বিএনপি জোট এবং তথাকথিত সুশীল সমাজের কথার তোড়ে সে সাফল্য রাজনীতির মাঠে ধোপে টেকেনি। ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেশকিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে।

সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে জনমনে নতুন আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। এই নির্বাচনে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা ধরে রাখতে হলে আগামী নির্বাচনগুলোও সুষ্ঠু হতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের বাকি এখনও প্রায় দুই বছর। এসময়ের মধ্যে যতগুলো স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচন হবে তা সুষ্ঠু হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হবে। অতীতের নির্বাচনগুলো ভালো হয়নি বলে আগামীতেও তা ভালো হবে না– এমন বদ্ধমূল ভাবনা থেকে বের হতে না পারলে 'নষ্ট' নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে বেড় হওয়া যাবে না।

এখনই সময় আগামী নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করার। এমন সময়ে বিএনপি নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি করছে তা অশুভ ভবিষ্যতের পথ তৈরি করছে। এই বিতর্ক এখনই শেষ না হলে তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পথ রুদ্ধ করবে।

একটা ভালো নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভর করে না। এর জন্য দরকার সব পক্ষের আন্তরিক অংশগ্রহণ। নির্বাচনের মাঠে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যদি সুস্থ মানসিকতা নিয়ে অংশগ্রহণ করে তবে তা প্রতিযোগিতামূলক হবে। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নির্বাচন কমিশন কেন প্রশাসনিক কর্তাদেরও কিছু করার থাকে না। নির্বাচনের মাঠে খেলোয়াড় নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন নয়, রাজনৈতিক দলসমূহ। খেলোয়াড়েরা ভালো খেললে রেফারির পক্ষে বা পাহারাদারের পক্ষে ফলাফল ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ নিতান্তই কম থাকে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, আগামীর জন্য সুস্থ ও টেকসই নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই পক্ষেরই উচিত আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পথ তৈরি করা। অন্যথায় আমরা শুধু নষ্ট নির্বাচনী সংস্কৃতির ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে থাকব; সোনার বাংলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।