‘নতুন’ কমিশন, প্রত্যাশা পুরনোই

ইমতিয়ার শামীম
Published : 10 Feb 2017, 06:10 PM
Updated : 10 Feb 2017, 06:10 PM

খুব বেশি দিন হয়নি– গত বছরের ২৬ নভেম্বর বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (প্রনিক) ও তাঁর চার নির্বাচন কমিশনার আদালতে হাজির হয়েছিলেন। হলফনামা দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। বলতে গেলে সচেতনভাবেই যার প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন তারা নিজেরাই। সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় স্মরণকালের অনিয়ম, হত্যা আর গোলযোগ ঘটেছে। কিন্তু প্রার্থীদের নির্বাচনী অনিয়ম-সংক্রান্ত অভিযোগ বিবেচনায় নেওয়া দূরে থাক, নির্বাচন কমিশন একটি চিঠি দিয়ে অভিযোগকারীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন আদালতে যেতে।

এমন পরামর্শ দেওয়াই রকিব কমিশনের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কেননা এই কমিশনই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ থেকে ২০১৩ সালে এমন একটি ধারা বাদ দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, যাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। তীব্র সমালোচনার মুখে রকিব কমিশন অবশ্য সে উদ্যোগ থেকে সরে এসেছিলেন, কিন্তু অন্তর থেকে তারা যে ধারাটি বাদই দিয়েছিলেন, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনপরবর্তী পরিস্থিতি তেমনই বলছিল।

এমন প্রেক্ষাপটে সবাই হাল ছেড়ে দিলেও 'বিপত্তি' বাঁধিয়েছিলেন চাঁদপুরের চর ভৈরবী ইউনিয়নের এক প্রার্থী। হাইকোর্ট পর্যন্ত ছুটেছিলেন তিনি। আদালত তাঁর অভিযোগ নিষ্পন্ন করার নির্দেশ দিলেও নির্বাচন কমিশন সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। ফল হয় এই যে, হাইকোর্ট কমিশনারদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন আর রায়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয় নির্বাচন কমিশনের প্রনিক থেকে শুরু করে সব সদস্যকে। এটি সত্যি, এই কমিশন অনেক নির্বাচন করেছে; আট হাজারের বেশি নির্বাচন করা তো মুখের কথা নয়, অতীতের কোনো কমিশনই এমনটি করতে পারেননি। কিন্তু রকিব কমিশন যত নির্বাচন করেছে তত সাংবিধানিক ক্ষমতার নিষ্ক্রিয়তাও প্রদর্শন করেছে। নির্বাচন আর সাংবিধানিক ক্ষমতার নিষ্ক্রিয়তা যেন রকিব কমিশনের এপিঠ ওপিঠ।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনেও এখন একই চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, ভবিষ্যতেও কি আমরা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতার নিষ্ক্রিয়তাই দেখব?

এই যে প্রশ্ন, কিংবা প্রশ্নের নেপথ্যে ঝুলে থাকা দ্বিধা-সংশয়, তা কি এই জন্য যে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যত 'নিরপেক্ষতা' নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? তেমন মনে করা আদৌ ঠিক হবে না। কার্যত অতীতের অভিজ্ঞতাই আমাদের এমন একটি প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে এই নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো লুকোচুরি খেলা নেই; অনুসন্ধান কমিটির ভূমিকা এবং তৎপরতায়ও কোনো সন্দেহ-সংশয় জাগানিয়া কিছু নেই। কালক্ষেপণও করেনি অনুসন্ধান কমিটি। বরং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সম্ভাব্য কমিশনার হিসেবে ১০ জনের নামের তালিকা জমা দিয়ে তারা প্রকারান্তরে এই বার্তাই দিয়েছে, দ্রুত নিজেদের কাজের জায়গায় ফিরে যেতে চায় তারা। বরং এটি একটি নতুন দিক যে, অনুসন্ধান কমিটি দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে বেশ কিছু নির্দেশনা ও বার্তা রেখে গেছে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য। ভবিষ্যতে এইসব নির্দেশনা ও বার্তাকে নতুন কমিশন কীভাবে কাজে লাগাবে, তা-ও এখন দেখার বিষয়।

অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া ১০ জনের তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যে পাঁচজনকে বেছে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তালিকা থেকে নেওয়া। কোন রাজনৈতিক দল কোন নাম জমা দিয়েছে, তা থেকে এটুকু জোর দিয়েই বলা যায়, তার চিন্তাধারা ও কার্যক্রম ওই রাজনৈতিক দলের নিরপেক্ষতার সংজ্ঞার সঙ্গে মেলে। কিন্তু নিশ্চয়ই এ-ও তারা বিবেচনায় নিয়েছেন, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তার ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না।

তারপরও অনুসন্ধান কমিটি নাম প্রকাশের ক্ষেত্রে, আমি বলব, দুর্বলতার উদাহরণই তৈরি করেছে, তারা জানায়নি, কোন নাম কোত্থেকে এসেছে এবং এসব নামের কোনোটি তাদের নিজস্ব তালিকাতেও ছিল কি না। সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, সার্চ কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশে যাদের নাম রয়েছে, তাদের কোন নাম কোন রাজনৈতিক দল করেছে। উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেছেন, "তা রেকর্ড চেক করে বলতে হবে, আমার মেমরিতে নেই।"

এই লুকোচুরি অনুসন্ধান কমিটি না করলেও পারত। কিন্তু লুকোচুরির যে 'প্রয়োজন' ছিল, সেটি অনুভব করা যায়, যখন দেখি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের নামই এসেছে (সাবেক সচিব কে এম নূরুল হুদা, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম ও অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী) ১৪ দলভুক্ত বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন থেকে। অনুসন্ধান কমিটি অনেক কিছুই করেছে, বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে বৈঠক করেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ১২৮টি নাম সংগ্রহ করেছে, সেইসব নাম ছেঁকে তোলার পর রাষ্ট্রপতি আবার বেছে নিয়েছে এমন কয়েকটি নাম, যেগুলো পাঠিয়েছিল কি না তরিকত ফেডারেশন!

সিইসি হিসেবে নূরুল হুদার নাম প্রস্তাব করেছে শুধু তরিকত ফেডারেশনই নয়, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও (ন্যাপ)। তাঁর নাম কমিশনার হিসেবেও ছিল জাতীয় পার্টি ও বিএনএফের তালিকাতে। শাহাদৎ হোসেন চৌধুরীর নাম সাম্যবাদী দলও করেছিল। বিস্মিতই হতে হয়, অনুসন্ধান কমিটি তরিকত ফেডারেশন ও ন্যাপের মতো সংগঠনের প্রস্তাবিত নামকে ভীষণ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে আর যেন-বা সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের মুখ বাঁচাতে দুই দলের প্রস্তাবিত দুজনকে (মাহবুব তালুকদার ও কবিতা খানম) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে! তা হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব যে বললেন, "পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশনে বড় বড় সব দলের প্রস্তাবিত নামই আছে", তা কত দূর সত্য? আমরা কি ধরে নেব যে, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনই একাই এ দেশের 'প্রধান-প্রধান দল'?

অতীতে বিএনপি যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে নীরব থেকে কিংবা পরোক্ষে বিরোধিতা করে, বিদেশি পত্রপত্রিকায় দলীয় প্রধানের পক্ষ থেকে সরাসরি আপত্তিকর নিবন্ধ লিখে এবং দেশের রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি দিয়ে যে গণবিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে, তাতে নিশ্চয়ই কোনো শুভবোধসম্পন্ন মানুষ দলটিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। কিন্তু সে জন্য এমন পদক্ষেপও কেউ প্রত্যাশা করে না, যা নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল করে দেবে। অথচ সেরকমই বার বার করা হচ্ছে। সবচেয়ে জরুরি ছিল, নির্বাচন কমিশন গঠন-সংক্রান্ত আইনটিই প্রণয়ন করে ফেলা। তবে কার্যত কোনো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে তা নিয়ে তীব্র ইচ্ছে প্রকাশ করেনি।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার ফসল, এ সংসদ থেকে এ আইন অনুমোদন করানো ঠিক হবে না– এমন যুক্তি এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ জাতীয় সংসদের বাইরে এ আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত কমিটি করে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠনগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগও নেওয়া যেত। কিন্তু বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এর প্রমাণ রেখেছে যে, আইনের অনুপস্থিতির সুযোগটি তারা ভবিষ্যতেও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে আগ্রহী। আমাদের এক আওয়ামী ঘরানার বন্ধু প্রায়ই বলেন, "আওয়ামী লীগকে এইটা বুঝতে হবে, তার সামনে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসার কোনো পথ নেই, আর সে জন্যই দলটির প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে তোলা, যাতে কখনও প্রতিকূল সরকার ক্ষমতায় থাকলেও জনগণের মুখোমুখি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথ তার জন্য খোলা থাকে।"

দুঃখজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগ নিজেই সে পথ বন্ধ করে চলেছে। রকিব কমিশন তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এখন নূরুল হুদা কমিশন নিয়ে আওয়ামী লীগ স্বস্তির সঙ্গে কথা বললেও আর বিএনপি অনেক সমালোচনা করলেও 'বেহুলার বাসরঘরে' কোনো ছিদ্র আছে কি না, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

এমন নয় যে, প্রনিক নিয়োগে বিএনপির কোনো খেলাধূলা নেই। বিএনপি নেতারা প্রনিক পদে কারও নাম সরাসরি প্রস্তাব না করলেও ২০ দলীয় জোটেরই এলডিপি থেকে প্রস্তাব করা হয় আলী ইমাম মজুমদারের নাম। এসবের সঙ্গে বিএনপির আপাত কোনো যোগসূত্র নেই, কিন্তু নূরুল হুদাকে নিয়ে বিভিন্ন জনসমালোচনা শুরু করে ওই যোগাযোগের সম্ভাবনাই তীব্র করে তুলছে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের প্রধান গণমাধ্যমে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে 'আত্মরক্ষা'য় ব্যস্ত।

তবে তার জন্য আশাপ্রদ ঘটনা হল, জনতার মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্তির অভিযোগ আনলেও বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট তাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘোষণা করেনি। তার মানে অন্তত এইটুকু পরিসর রয়েছে, তিনি সবাইকে আস্থায় নেওয়ার সুযোগ পাবেন। বিদায়ী বক্তব্যে অবশ্য সাবেক প্রনিক রকিব উদ্দিন নতুন কমিশন তাদের মতোই ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করেছেন। তাই যদি হয়, তা হলে অবশ্য আমরা সামনে বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু দেখি না, আরও একটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নির্বাচন ছাড়া আর কিছু দেখি না।

আমরা চাইব, নতুন কমিশন দ্রুতই অন্তত এমন পদক্ষেপ নেবে, যাতে জনগণের মধ্যে আশা জাগে। জনগণ আশাবাদী হলে রাজনৈতিক দলগুলোও আশাবাদী হতে বাধ্য। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া নির্দেশনা ও বার্তা নতুন নির্বাচন কমিশন কীভাবে নিচ্ছে তাও দেখার বিষয়।

নতুন কমিশনের প্রথম নির্বাচন হবে আগামী ৬ মার্চ। দেশের ১৮টি উপজেলায় এ নির্বাচন হবে। তিনটিতে হবে সব কয়টি পদে সাধারণ নির্বাচন আর অন্যগুলোয় হবে বিভিন্ন পদে উপ-নির্বাচন। এরপর হবে ২২ মার্চ গাইবান্ধায় উপনির্বাচন।

এ কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু আস্থার সঙ্গে নিয়েছে, কমিশনই-বা কতটুকু আস্থা জাগাতে পারছে, প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে, তার পরীক্ষা হয়ে যাবে এ উপনির্বাচনের মধ্যে দিয়েই। বোঝা যাবে, নতুন হলেও তা কতটা নতুন, নাকি নতুন হলেও তা পুরনোই।

তবে আমাদের প্রত্যাশা পুরনোই– সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।