বইমেলার বিভ্রান্ত বয়ান এবং আমরা

অনীক আন্দালিব
Published : 14 Feb 2017, 04:02 AM
Updated : 14 Feb 2017, 04:02 AM

বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মাসটি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা একাডেমির বইমেলার প্রতীক হলেও গত এক যুগে সে পরিচয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। দুই বছর আগে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং ১৩ বছর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার নিকটেই ঘটে যাওয়া ভয়ানক আক্রমণের ঘটনা দুটি খুব স্পষ্টভাবে বইমেলার আবহে এক অশনি-চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। গত দুই বছরে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে একাধিক বই ও প্রকাশনী। এই ঘটনাগুলোর প্রভাব ও কারণ বিশ্লেষণের নিমিত্তেই এই লেখার অবতারণা।

এটি স্পষ্ট যে, বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক বলয় স্পষ্টতই কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এমন বিভাজন আগেও ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে মতামতের যোগাযোগ বা মিথষ্ক্রিয়া জারি ছিল। এক পক্ষ অন্য পক্ষগুলোর মতিগতি বুঝতে পারত। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছরে, বিশেষ করে শাহবাগ আন্দোলনের পর থেকেই এই বিভাজনগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। একাধিক পক্ষের মধ্যে মতাদর্শিক দূরত্ব বাড়তে শুরু করে।

এখন অবস্থাটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো পক্ষই অন্য পক্ষের মতামত সহ্য করতে পারে না। সহ্য করা দূরে থাকুক, একে অপরের বিনাশ চাইতেও পিছপা হয় না। পার্থক্য এটুকুই যে কোনো কোনো পক্ষ মনের সেই সুপ্ত ক্ষোভকে রক্তপাত অবধি টেনে নিয়ে যায়, আর অন্যান্য পক্ষগুলো তত দূর যায় না। এখন দেখার বিষয় হল এই যে, এই পক্ষগুলো কারা এবং তাদের সার্বিক উদ্দেশ্য কী? সেটা নিরূপণ করা গেলেই এদের মতপার্থক্যের জায়গাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

প্রথমেই সবচেয়ে বড় যে ভাগটি, সেটির কথা বলি। নিতান্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ, আটপৌরে ৯টা-৫টা অফিস করা মানুষ, কিংবা উদয়াস্ত গৃহে শ্রম দিয়ে চলা মধ্যবিত্ত গৃহিনীরা অধিকাংশই এই ভাগে পড়েন। জীবনযুদ্ধের প্রতিটি দিন তারা ব্যস্ততায় কাটায়। পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতার দেখভাল, আর চাকরি-বাকরির প্রমোশন বা ঘর-গেরস্থালির উন্নয়নেই তাদের প্রায় সম্পূর্ণ জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। প্রাত্যহিক যানজটে তাদের ক্লান্ত লাগে। মাসের শেষ কটি দিন টাকার চিন্তায় পার করতে হয়। এদের কাছে বইমেলা কেবলই একটি মেলা। এদের অনেকেই বইমেলাতে যান নির্মল একটু সময় কাটাতে। কয়েকটি বই নেড়ে-চেড়ে দেখে। প্রিয় লেখকদের বই কেনে। তারপর কয়েকটি ছবি তুলে চলে আসে। পুরো মাসে তারা হয়তো দুই-তিন দিন বইমেলাতে যাওয়ার সময় বের করতে পারে, অনেকে সেটাও পারে না।

সম্প্রতি বইমেলা ঘিরে বই ও প্রকাশনী নিষিদ্ধ করার খবর তারা অনেকেই পায়নি, পেলেও সে বিষয় নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা খুব একটা নেই। কেউ কেউ হয়তো নাখোশ হবে, কিন্তু সে পর্যন্তই। বাংলাদেশের জনজীবনে এরকম নাখোশ হওয়ার মতো ঘটনা অহরহই ঘটে। তাই এতে খুব একটা বিচলিত হবে না তারা।

এই ঘটনাগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে বইমেলাকে ধ্যান-জ্ঞান করা মানুষজন। এদের মধ্যে আছে প্রকাশনীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। আছে বইয়ের লেখক, যাদের বই এবার বইমেলায় আসতে পারল না। আছে উদারনৈতিক মতাদর্শের মানুষ, যারা মনে করে বাক-স্বাধীনতা ও সাহিত্যচর্চা মানুষের মৌলিক অধিকারের সমতুল্য। আছে সংস্কৃতিমনা পাঠক ও সাহিত্যানুরাগী, যারা প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপে প্রচণ্ডভাবে আহত হয়। এদের প্রায় সবাই অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেই পড়ে।

প্রথম ভাগের মানুষদের মতোই এরা অনেকেই নিতান্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, গৃহিনী। এদের অনেকেই কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক। অনেকেই বিখ্যাত বা অখ্যাত সাহিত্যিক। প্রথম ভাগের মানুষের মতোই এদের দৈনন্দিন টানাপোড়েন আছে, চাল-ডালের হিসাব আছে, যানজটের ক্লান্তি আছে। তারাও আর দশজনের মতোই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে জীবন-নির্বাহের নিমিত্তে।

শুধু পার্থক্য এটুকুই যে বইমেলা তাদের কাছে নিছকই একটা হাঁপ ছাড়ার জায়গা নয়; এখানে তারা হয়তো প্রায় প্রতিদিনই ঢুঁ মারে। বিকেল থেকে রাত ঢলে যাওয়া অবধি স্টলে স্টলে ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধবসহ বইমেলার পেছনের ক্যান্টিনে চা খেতে যায়, খাওয়া শেষে ফের বইমেলায়। একটা সময় এদেরই কাউকে কাউকে দেখা যেত কোনো স্টল থেকে বই কিনে মেলার মাঠে বসে পড়েছে। এখন স্টলের প্রাচুর্যে সে মাঠটি দখল হয়ে যাওয়ায় তারা হয়তো বাসায় ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

বই-পিপাসু ও সাহিত্যপ্রেমী এই ছোট অংশটির অনেকেই এই ঘটনায় বিপর্যস্ত ও বিপন্ন বোধ করেছে। কেউ কেউ বইমেলার কর্তাব্যক্তিদের প্রতি নাখোশ হয়েছে। কেউ কেউ ঠিক আগের মতো উচ্ছ্বাস বা আনন্দ অনুভব করছে না। তারা হয়তো এবারও বইমেলায় যাবে, কিন্তু আগের মতো নিয়মিত হবে না, কিংবা পুরোটা সময় থাকবে না। অর্থাৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা প্রথম দলটির কাতারে নাম লেখাবে।

আরেকটি দল আছে এই দলের পুরোপুরি বিপরীতে। যারা অনেকেই সমাজের উঁচুতলায় বাস করে। যাদের অধিকাংশই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছে। ইংরেজি সাহিত্যে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে তাদের প্রায় কারোই আগ্রহ নেই। যে বইগুলো পড়ার আগ্রহই নেই, সে বইয়ের মেলায় ভিড়ভাট্টা ঠেলতে তারা কেন যাবে? তবে বইমেলার ব্যাপারে তাদের অনাগ্রহ অনেকাংশেই নিস্পৃহতার ফলাফল।

এদের মতোই বইমেলা সম্পর্কে অনাগ্রহী আরেকটি দল আছে, যারা এদের মতো অতটা নিস্পৃহ নয়। বইমেলাকে তারা দেখে একপ্রকার উপদ্রব হিসেবে। বাংলা সাহিত্য তথা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে যে সংস্কৃতির স্ফূরণ ঘটে তার মূল দর্শন বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু গত দুই যুগ ধরে ধীরে ধীরে এর পাশাপাশি উত্থান ঘটেছে ধর্মীয় দর্শনের। সাধারণত গণতান্ত্রিক বা উদারনৈতিক রাজনৈতিক আদর্শ ক্ষমতার কেন্দ্রে বা কেন্দ্রের কাছে থাকলে সে শক্তির বিরোধিতা করতেই ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ঘটে। দেশ-জাতি-রাষ্ট্র নির্বিশেষে আমরা এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ দেখতে পাই। এমন আদর্শ অতীতেও এসেছে, বর্তমানে আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

এ পরিসরে বলে রাখা যায় যে, যুগে যুগে উল্টোটাও ঘটে, অর্থাৎ ধর্মীয় রাজনীতি ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করলে তার বিরোধিতায় উদারনৈতিক আদর্শ ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে যে ধারার ধর্মীয় রাজনীতির প্রসার ঘটেছে তা আদর্শিকভাবে নিজ মতধারার বাইরের সব মতাদর্শকে নাকচ করে দিতে চায়। এটি একধরনের 'টোটালিটারিয়ান' ব্যবস্থা, যেখানে বহুদলীয়, বহুমাত্রিক আদর্শের কোনো স্থান নেই। নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা এই আদর্শের চোখে তাই ছকের বাইরের সবকিছুই হুমকিস্বরূপ। সেজন্য 'অপর' বা 'ভিন্ন'কে এখানে দেখা হয় নেতিবাচক হিসেবে।

এখানে একটি কথা বলে রাখা জরুরি। যারা উদারনৈতিক আদর্শ ধারণ করে, তারা প্রায়শই ধর্মীয় রাজনীতিকে বুঝে ওঠার কোনো চেষ্টাই করে না। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, এখন বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কোন যোগাযোগ তো নেই-ই, বরং একে অপরের প্রতি বিরোধিতামূলক মনোভাব বাড়তে বাড়তে ঘৃণার পরিণত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ বলয়ের ভেতরে থাকায় তা একটি 'ইকো-চেম্বার' বা প্রতিধ্বনি-কক্ষে পরিণত হয়।

মানুষের সহজাত প্রবণতা হল অচেনা যে কোনো কিছুকে ঘৃণার চোখে দেখা। আর ঘৃণা বা ভয় এমন অনুভূতি যা সহজে সংক্রামিত হয়। উদারনৈতিক আদর্শের মানুষদের অনেকেই ধর্মীয় রাজনীতির কোপানলের শিকার হয়েছে। তাই অন্যদের শঙ্কা ও ঘৃণার কারণ যৌক্তিক এবং সহজেই অনুমেয়। তা সত্ত্বেও অপর পক্ষের প্রকৃতি না বুঝলে অনেকাংশেই বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাছাড়া উদারনৈতিক আদর্শে মানুষের বহুমাত্রিকতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তাই আমরা মনে করি নাকচ করার আগে ভিন্নমত ও ভিন্নপন্থা যাচাইবাছাই করুন। এতে করে সেই মতাদর্শের ত্রুটিগুলো যেমন আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, তেমনি নিজস্ব চিন্তাধারাও সুদৃঢ় হবে।

কেন আপনি আর সব মতধারার চেয়ে নিজ মতধারাটিকে ভালো মনে করেন, সেটাও পরীক্ষিত সত্য হিসেবে আপনার কাছে প্রমাণিত হবে। কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:

"দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?"

দরজা বন্ধ করে সত্যকে দূরে সরিয়ে রাখার রূপকটি বইমেলাকে কেন্দ্র করে চলমান ঘটনাবলীর সঙ্গে দারুণভাবে মিলে যায়। বই ও প্রকাশনী নিষিদ্ধ করা মূলত দমনমূলক বিষয়। যেন কতিপয় মানুষের মুখ চেপে ধরা হচ্ছে। এরকম আচরণ কেবলমাত্র কোনো টোটালিটারিয়ান কর্তৃপক্ষেরই মানায়।

আগেই বলছিলাম, ধর্মভিত্তিক টোটালিটারিয়ান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহুমাত্রিক মতাদর্শগুলোর কোনো স্থান নেই। এই আদর্শের চোখে বাংলা ভাষায় মনুষ্যনির্মিত কল্পিত 'মিথ্যা'-সাহিত্য ক্ষতিকর। প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতার মতো 'অবৈধ' বিষয়ে ভরা উপন্যাস, গল্প, কবিতা; কিংবা মুক্তচিন্তা, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক তথ্যনির্ভর প্রবন্ধ ইত্যাদির বইগুলো মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও আদর্শ ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, ওই আদর্শের চোখে মানুষের বহুমাত্রিকতা একটা নেতিবাচক জিনিস। অতএব বইগুলোকে রুখে দাও। এদের প্রতিবাদের প্রথম ঢেউটি ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

২০০৪ সালে ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যার চেষ্টা এবং ২০১৫ সালে অভিজিৎ রায়কে হত্যা ও বন্যা আহমেদকে আহত করার মাধ্যমে তাদের লেখনীকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারও আগে শাহবাগ আন্দোলনের সময়েও বাংলা ব্লগ জগতের বিরুদ্ধে নাস্তিকতা ও ধর্মবিদ্বেষিতার অভিযোগ এনে নির্দিষ্ট কয়েকজন লেখক-ব্লগারকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এগুলো ছিল অল্প কিছু লেখকের বিরুদ্ধে আঘাত, যা অন্যান্য লেখকসহ সব প্রগতিশীল মানুষের মনে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়েছিল।

যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি লেখালেখির সঙ্গে জড়িত নয় এবং দৈনন্দিন জীবনের চাপে মতাদর্শের এই সংঘাত নিয়ে যাদের মাথাব্যাথা নেই, তারাও তখন আস্তে আস্তে এই লড়াই থেকে সরে গেছে। এর পরের ধাপের কৌশল হল বই নিষিদ্ধকরণ। এতদিনে নির্দিষ্ট লেখকগোষ্ঠীকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন লেখার পথ রুদ্ধ করতে হবে। তবে হ্যাঁ, লেখার বিষয়ের নির্দিষ্ট তালিকা আছে, সে তালিকার যে কোনো বিষয়ে যত ইচ্ছা লেখা যাবে। শুধু কয়েকটি বিশেষ বিষয়ে একেবারেই লেখা যাবে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।

শুধু তাই না, সেসব বই প্রকাশ করার অপরাধে প্রকাশনা সংস্থাকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে! অর্থাৎ একটি বই কতটা ভয়ানক, কতটা বিধ্বংসী, কতটা 'অপরাধী' যে সেই অপরাধের মাশুল গুণছে ওই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অন্যান্য 'নিরীহ ও নিরাপরাধ' বইগুলোও! এর মাধ্যমে একটা জোরালো নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। শুধু নিজে নিরীহ বিষয়ে লিখলেই হবে না, আপনার প্রকাশনীকেও বাধ্য করুন তারা যেন কেবল আপনার মতো নিরীহ লেখকদেরই লেখা ছাপায়।

এরকম কর্তৃপক্ষীয় ক্ষমতার পরের ধাপ সহজেই অনুমেয়। প্রথমে লেখক, তারপর বই, তারপর প্রকাশনী। এখন তার পরের ধাপ হিসেবে পুরো বইমেলাকেই দখল করে নেওয়া হয়েছে! এবারের বইমেলায় প্রকাশিতব্য সব বই খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ পুলিশ। অর্থাৎ এখন আর বিষয়টি গুটিকয় লেখক ও প্রকাশকের নেই। এখন এতে সব বইয়ের সব প্রকাশককেই নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে।

এই যে ধাপে ধাপে বিস্তার, এ প্রক্রিয়াটি খুব পরিচিত কিন্তু! যে কোনো সন্ত্রাসী আক্রমণে কিছু নিরাপরাধ মানুষকে বন্দি করা হয়। তারপর বাইরে ঘিরে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের 'মুলোমুলি' শুরু হয়, ইংরেজিতে যাকে বলে 'hostage negotiation'। এরকম পরিস্থিতির জন্য একটি কথা আছে, "আমরা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো রকমের মুলোমুলি করি না!"

তার মানে তুমি অমন নিরীহদের মেরে ফেললেও কিছু যায় আসে না, তুমি যা দাবি করছ তা কোনো অবস্থাতেই মানা হবে না। দেখা গেছে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নমনীয়তা দেখিয়ে কখনও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং সন্ত্রাসীরা নিরাপদে পগারপার হয়ে গেছে। অন্যদিকে মধ্যস্থতার পথে না গিয়ে জোরের সঙ্গে প্রতিরোধ করলেই তাদের ঠেকানো সম্ভব হত। বইমেলাকে ঘিরে আমরা সেই একই 'হস্টেজ নেগোসিয়েশনে'র ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি দাবি মেনে নিয়ে ভাবছি হয়তো এখানেই তারা থামবে। কিন্তু পরের দিনই দেখা যাচ্ছে নতুন দাবি-দাওয়া। এভাবে ছাড় দিয়ে কতদিন টিকে থাকা যাবে, তা ভাবনার বিষয়।

পেছন ফিরে দেখলে মনে হয় উদারনৈতিক মতাদর্শের দলটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যে বহুমাত্রিকতা কেন্দ্র করে এই মতাদর্শ পরিস্ফূটিত হয়, সেই বহুমাত্রিকতাকে বাদ দেয়া হয়েছে। ভিন্নকে, অপরকে, প্রান্তিককে, বৈচিত্র্যকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যা কিছু সাধারণের বাইরে, একটু অন্যরকম তাকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। বিনিময়ে প্রায় সবাই বেঁধে দেওয়া কিছু বুলি ও প্রথায় খাপ খাইয়ে নিয়েছে। মতাদর্শিক লড়াইয়ে এই সিদ্ধান্তকে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক মনে হচ্ছিল। এর পেছনে যুক্তিও ছিল হয়তো। তবে তার সবই বিভ্রান্তিমূলক 'কুযুক্তি'।

দাবি করা হয়েছিল যে উদারনৈতিকতার বিপরীতে দাঁড়ানো ধর্মভিত্তিক আদর্শকে যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। 'বৃহত্তর স্বার্থে'র প্রয়োজনে উদারনৈতিকতার বৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে সবাইকে একই মতামতে সমর্থন দিতে হবে। এর ফলে ধর্মভিত্তিক আদর্শকে পরাজিত করা যায়নি। বরং কোন ফাঁকে টুপ করে প্রগতিশীলতার জায়গায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতা, ছদ্ম প্রগতিশীলতার মোড়কে।

এই ছদ্ম প্রগতিশীলতা ক্ষমতার কেন্দ্রের তাঁবেদার, দমনমূলক নিয়মনীতিতে উদ্যত, মানুষের বৈচিত্র্যময়তার শত্রু। বইমেলাসহ আমাদের জনজীবনে গত কয়েক বছরে আমরা এই ছদ্ম প্রগতিশীলতারই ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। বাস্তবতার নিরিখে এই পরিস্থিতির সহসা উন্নতি ঘটবে– এমন আশা করি না। মারফির সূত্র মোতাবেক: "এনিথিং দ্যাট ক্যান গো রং, উইল গো রং"।

এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন উদার ভাবধারায় বিশ্বাসীদের নিজেদের দিকে আয়না ফেরানো। এই আদর্শের শক্তি মানুষের বহুমাত্রিকতায় এবং মানুষ স্বভাবতই বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যময়। আমাদের চারপাশের ভিন্নতাই আমাদের সৌন্দর্য; এর মধ্যেই আমাদের শক্তি নিহিত। একে তুলে ধরলেই কেবল এই ঘোর অমানিশা থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়া হবে।