ঐতিহাসিক রায় কার্যকরের দিন

মারুফ রসূল
Published : 28 Jan 2017, 07:28 AM
Updated : 28 Jan 2017, 07:28 AM

আজ ২৮ জানুয়ারি। বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কমুক্তির একটি দিন। ২০১০ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বস্তুত এই দিন থেকেই বাঙালি জাতি ইতিহাসের প্রতি তার দায় শোধ করতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল– পঁয়ত্রিশ বছর পর, ২০১০ সালে, তার বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে আমরা দায়মুক্তির পথে হাঁটতে শুরু করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যে চূড়ান্ত রায় হয়েছিল, এখনও তা পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা হয়নি।

২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ কর্তৃক ঘোষিত চূড়ান্ত রায়ে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের দেওয়া ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। এর মধ্যে বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও সাত আত্মস্বীকৃত খুনি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন– খন্দকার আবদুর রশিদ, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, আবদুল আজিজ পাশা ও ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ। এই নরপিশাচদের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান।

জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ সময় ধরে একদিকে যেমন এই খুনিদের রক্ষার নানা সামরিক ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অক্ষ থেকে সরিয়ে একটি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র বিয়াল্লিশ দিন পর অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। জিয়াউর রহমান তখন সেনাপ্রধান। 'দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি' লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক ছাড়াও স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমান। দুটি ভাগে বিভক্ত এই অধ্যাদেশবলে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের আইন ও বিচারের আওতামুক্ত রাখা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সামরিক আইনের আওতাভুক্ত চার বছরের সকল অধ্যাদেশ ও ঘোষণার আইনি বৈধতা দেয় জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি। পঁচাত্তরের পর প্রতিটি সরকার এই খুনিদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বৈরাচারী এরশাদ ১৯৮৬ সালে খুনি কর্নেল ফারুককে তথাকথিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করেন। পরের বছর ফারুক-রশিদকে দিয়ে 'ফ্রিডম পার্টি' নামে একটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল গঠন করান এরশাদ। পরে, ১৯৮৮ সালে তথাকথিত সংসদ নির্বাচনে মেহেরপুর থেকে খুনি বজলুল হুদাকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করিয়ে আনেন।

১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে খুনি কর্নেল রশিদকে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত করে তথাকথিত বিরোধী দলের নেতা বানানোর অপচেষ্টা করে বিএনপি।

এভাবেই তাদের প্রতিষ্ঠিত করার সামরিক ও রাজনৈতিক কূটকৌশল অব্যাহত রেখেছিল যথাক্রমে বিএনপি ও স্বৈরাশাসক এরশাদ।

দুই.

১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসে। ২৪ জুন শপথ গ্রহণের পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার, পনেরোই আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা এবং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করার জন্যে 'দ্য ইনডেমনিটি (বাতিল) বিল' ১৯৯৬ উত্থাপন করেন। জাতীয় সংসদে তা পাস হয়। ১৪ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়।

সংসদ ও আদালত কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির (বঙ্গবন্ধুর) তৎকালীন আবাসিক একান্ত সহকারী এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে পনেরোই আগস্ট, ১৯৭৫এর ঘটনাবলী উল্লেখপূর্বক ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১০ (১০) ৯৬ ইং তারিখ ২-১০-৯৬ ইং। মামলাটি দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/১০৯/১২০বি ধারায় রজু করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি তদন্ত শেষ করে পুলিশ ২৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

একই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি পলাতক আসামিদের নামে গেজেট নোটিশ জারি হয়। স্বাধীনতার মাস মার্চের প্রথম দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে বিশেষ এজলাস গঠন করে এই মামলার কাজ শুরু হয়। বিচারক করা হয় কাজী গোলাম রসুলকে। রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি হন সিরাজুল হক। ২৪ আসামির মধ্যে ৪ জন মারা যাওয়ায় ২০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে বিচারকাজ শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ।

দেড়শ কার্যদিবস শুনানি শেষে ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। একই দিনে ব্যাংকক থেকে ফেরত্ আনা হয় খুনি বজলুল হুদাকে। এই রায়ের পর কারাবন্দী চার আসামি, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে.কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেপটেন্যান্ট কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও লেপটেন্যান্ট কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমদ হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০০ সালের ৩০ মার্চ ডেথ রেফারেন্স ও আপিল হাইকোর্টের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

কিন্তু এরপর শুরু হয় হাইকোর্টের বিচারপতিদের বিব্রতবোধের নামে ন্যাক্কারজনক সময়ক্ষেপণ। ১০ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত কয়েক দফা হাইকোর্টের বিচারপতিরা বিব্রত হবার পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৬৩ কার্যদিবস শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ মামলায় বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অপরদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ দেন।

১২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ৩০ এপ্রিল চূড়ান্ত রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। কারাবন্দী চার আসামি একই বছর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। এরপর দীর্ঘ সময় এ মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

২০০৭ সালের ১৩ মার্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হলে ১৮ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৪ জুন তিনি জেল আপিল করেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের দায়ের করা লিভ টু আপিলের ওপর শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করা হয় ২ আগস্ট। ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর আপিলেল ওপর ২৯ দিনের শুনানি শেষে ২৯ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।

নির্ধারিত দিনেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করেন।

২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি অবশেষে এই রায় কার্যকর করা হয়।

তিন.

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো বিষয় সুস্পষ্টভাবে জাতির সামনে প্রতীয়মান হয়েছে। এই মামলার শুনানির বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিগণ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। তিনি আদালতের কাছে এই মর্মে একটি পর্যবেক্ষণ চেয়েছিলেন যে, বিচারপতিদের কেউ যেন আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের (সিএমএলএ) মতো পদ গ্রহণের শপথ পাঠ না করেন। রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে বিচারপতিরা দৃঢ় অবস্থানে না থেকে অন্যায় ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের শপথ পাঠ করানোর মতো অপমানজনক কাজে ধিক্কার জানিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আপিল শুনানির ২৭তম দিনে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিগণ সুপ্রিম কোর্টের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে স্বীকৃতি ও পর্যবেক্ষণ চেয়েছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, দীর্ঘ সময়েও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া সংবিধান-পরিপন্থী ও বেআইনি। হত্যার একুশ বছর পর্যন্ত মামলা পর্যন্ত করতে না পারার বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁরা জানিয়েছেন– দেশের পুলিশ প্রশাসন, সরকার, বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগসহ সকলেই চাকুরির শর্ত ভঙ্গ করেছেন, শপথভঙ্গ করেছেন। পঁচাত্তরের পর সুপ্রিম কোর্টে অন্তত ১২টি 'রিপোর্টেড' জাজমেন্ট হয়েছে; কিন্তু তার একটিতেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এটা যে আইনের শাসনের প্রতি একটি প্রহসন, তা এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রতিফলিত হয়েছে।

এই রায়ের ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখ করার মতো বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিগণ। তাঁরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে, তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কখনও 'হাইজ্যাক' হতে পারে না। পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আদর্শহীনতাই বিপর্যয় তৈরি করেছিল।

এই প্রসঙ্গে বর্তমান সময়টি আমরা চিন্তার কাঠামোতে আনতে পারি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্রগুলো আমরা বিগত বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। যে কোনো সময়ে বাংলাদেশে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সামরিকতন্ত্রের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে মাত্র।

জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে এক মধ্যযুগীয় চিন্তাধারায়, যে ধারা এখনও এই ২০১৭ সালেও তীব্রভাবে বিরাজমান। এই মামলার বাকি আসামিদের বিষয়ে এখনও রাষ্ট্র সুস্পষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। এই রায়ের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তগুলো আমাদের রাজনৈতিক গতিধারায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।