ট্রাম্প একা নন

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 29 Jan 2017, 04:25 AM
Updated : 29 Jan 2017, 04:25 AM

ম্যাসাচুসেটস থেকে উইসকনসিনে উড়ে এসে নেমেছি ম্যাডিসন এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে মেয়ের অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখি নানা বয়সী নারীরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মনে পড়ল দিনটি ২১ জানুয়ারি। ট্রাম্পের শাসনগ্রহণের পরের দিন, প্রতিবাদী নারী-যাত্রায় অংশ নিয়ে ওরা এখন ঘরে ফিরছেন। মনটা খুশিতে ভরে উঠল। অসমতা, গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এক প্রস্থ বেড়ে গেল। সেই যাত্রায় বহু পুরুষও ছিলেন। একজন বিবেচক পুরুষের মনে নারীর সমানাধিকার নিয়ে সংশয় থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। নারীর অধিকার মানবাধিকার।

দুঃখের বিষয়, এই শ্লোগানের হোতা হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে হেরে গেলেন, নারী হওয়ার কারণেই হয়তো-বা। মার্কিনিরা নাকি নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে এখনও প্রস্তুত নয়। এ নিয়ে যত কথা হচ্ছে এই গ্রহে তা জমা করলে হয়তো স্থান দেওয়া সম্ভব হত না। অনেক নারীবাদীও হিলারিকে ভোট দেননি। অনেক তরুণ ডেমোক্রেটও নয়। ভোটের হিসাব-নিকাশ অনেক জটিল। যুক্তরাষ্ট্রে এই জটিলতা আরও বেশি বলে মনে হয়।

একুশে জানুয়ারির নারী-যাত্রাকে মার্কিন ইতিহাসে একদিনের বৃহত্তম প্রতিবাদ সমাবেশ বলে আখ্যায়িত করেছে মিডিয়াসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। ঠিক কত মানুষ সেই প্রতিবাদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন তার চুলচেরা হিসাব নির্ণয় কঠিন। তবে মনে করা হচ্ছে সেটি ন্যূনতম তিন দশমিক সাত মিলিয়ন হতে পারে। সাঁইত্রিশ লাখ? ৫০০টি শহরে এই সমাবেশের আয়োজন হয়। কানেকটিকাট ও ডেনেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিশেষজ্ঞ এই হিসাবটি দেন। তাদের মতে, সমাবেশে মানুষের জমায়েত সর্বনিম্ন তিন দশমিক সাত মিলিয়ন এবং সর্বোচ্চ চার দশমিক ছয় মিলিয়ন অর্থাৎ ছেচল্লিশ লাখ।

ইউএস সেনসাস ব্যুরোর হিসাব মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা এখন ৩২৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ বত্রিশ কোটি চল্লিশ লাখ। এ হিসাবে ন্যূনতম নারী-যাত্রার লোকের সমাবেশের সংখ্যাটা ধরলে প্রতি ১০০ জন মার্কিনির একজন এই সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। ভাবা যায়?

তবে এত বড় সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্রে সমানাধিকার রক্ষার ব্যাপারে কতটা অবদান রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কর্মক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার এখনও। সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। পুরুষের তুলনায় নারীদের বেতন কম, নিম্ন পর্যায় থেকে চিকিৎসকের মতো এলিট পেশাতেও এ বৈষম্য রয়েছে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি ছবি দেখেছিলাম, ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতায় আসার পর যখন নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হল তখন তেহরানে লাখ লাখ নারী প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমে এসেছিলেন। ছবিতে দেখছিলাম বোরকাবিহীন স্মার্ট ইরানি নারীদের প্রতিবাদ। কিন্তু কী হল? প্রতিবাদ করেও প্রতিকার হয়নি।

মৌলবাদী বা চরম ডানপন্থীরা আবার জেগে উঠছে, আগামী পৃথিবীর জন্য এটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ বিপর্যয় বা নিউক্লিয়ার পাওয়ারের অপব্যবহারের উদ্বেগের চেয়েও বেশি। কারণ ডানপন্থী মানেই কিছু গোঁড়ামি। সমাজ আবার পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়া। মানবাধিকার হেয় করা। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অনেক সাধারণ মানুষ এদিকে ঝুঁকছেন।

ট্রাম্পকে সাধারণ মানুষই ভোট দিয়েছেন। আমরা যতই পুতিনের ইন্টারনেট হ্যাকিংএর কথা বলি, কিছু মানুষ ট্রাম্পের সমর্থক। এ ধরনের প্রাচীনপন্থী গোঁড়াদের সমর্থকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশেও। তার বিশ্লেষণ পরে দিলাম।

এ বছর ইউরোপে তিনটি দেশে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গত বছর ব্রিটেনে হল ব্রেক্সিট। এটি কিন্তু ছিল বুড়ো গোঁড়া ইংরেজদের সমর্থনের ফসল। যুবক ইংরেজরা এর ফলে ই্ইউতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারালেন। ট্রাম্পকে যারা ভোট দিয়েছেন তাদেরও বেশিরভাগই মধ্যবয়সী সাদা আমেরিকান।

২০১৭ সালে ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেখানে যদি মার্কিন নির্বাচনের মতো ফল হয়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

সবচেয়ে কাছে নেদারল্যান্ডের নির্বাচন– মার্চের ১৫ তারিখে। গিরট ওয়াইল্ডারস (Geert Wilder) সেদেশের ট্রাম্প। তিনি ২০১৪ সালে পিপল পাটি ফর ফ্রিডম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি থেকে বের হয়ে এসে পাটি ফর ফ্রিডম গঠন করেন। তিনি ইইউ এবং মুসলিমবিরোধী। কোরান নিষিদ্ধ করতে বলছেন। মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে ইমিগ্র্যান্ট নেওয়া বন্ধ করতে চান। যে মুসলিমদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে তারা যদি নেদারল্যান্ডের কোনো আইন অমান্য করে তবে তাদের ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার কথাও বলেছেন গিরট। নেদারল্যান্ডের রাজনৈতিক আশ্রয় কেন্দ্র, মসজিদ ও ইসলামি স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে তিনি। নেদারল্যান্ডে যদি তাঁর দল ক্ষমতায় আসে তাহলে কী হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়।

ফ্রান্সে আছেন ট্রাম্পের সদৃশ, মেরিন লা পেন (Marine Le Pen)। সেখানে নির্বাচন ২৩ এপ্রিল। তাঁর কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে ট্রাম্পের বাণী। দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও বাইরের পৃথিবী থেকে দেশের মানুষের চাকরি ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন তিনি। নিজস্ব ফরাসি মুদ্রা চালুর উপর জোর দিচ্ছেন যেমন তেমন ইইউএর সঙ্গে থাকতে নারাজ। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, পেনের পিতা যিনি তাঁর রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি একবার এক বক্তৃতায় হলোকাস্টকে তুচ্ছ করায় বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পেনকে খুব একটা তাচ্ছিল্য করা যাচ্ছে না।

জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মেরকেলের চতুর্থবার চ্যান্সেলর হবার সম্ভাবনা নিয়ে হিসাব-নিকাশ চলছে। সেখানে নির্বাচন ২২ অক্টোবর। শরণার্থী নিয়ে মেরকেল বিপদে আছেন। ৪১ বছর বয়স্ক ডক্টরেট ডিগ্রিধারি ব্যবসায়ী ফ্রাউক পেট্রির (Frauke Petry) দল অলটারনেটিভ জার্মান পার্টি মিডিয়ার মনোযোগ কাড়ছে। তাঁর এক ভয়াবহ উক্তি, 'বেআইনিভাবে যে অভিবাসী জার্মানিতে ঢুকবে পুলিশকে তাকে গুলি করার অধিকার দিতে হবে'– চমকে দিয়েছিল মিডিয়াকে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের বক্তব্য কানে না বাজলেও উন্নত বিশ্বে তা বাজে। কিন্তু সেসব দেশের মানুষজনও চরমপন্থীদের ভালোবাসতে শুরু করেছেন। মুসলিমদের পেট্রির অপছন্দ। তাঁর মেনিফেস্টোতে রয়েছে, 'ইসলাম ইজ নট আ পার্ট অব জার্মানি'– অর্থাৎ, ইসলাম জার্মানির অংশ নয়।

২০১৭ সালে ইউরোপের এই তিন দেশের নির্বাচনের ফল যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো হয়, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সাধারণ মানুষ যদি এভাবে চরম ডানের দিকে ঝুঁকতে থাকেন, তার জন্য অবশ্যই দায়ী এখনকার বিশ্ব-নেতৃত্ব।

বাংলাদেশও ডানদিকে ঝুঁকছে। ২০০৮ সালে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার দেখে ভোট দিয়েছিলেন, তারা কি ২০১৭ সালে পাঠ্যবই সাম্প্রদায়িকীকরণ বা মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর বিষয়টি সমর্থন করবেন? নব্ব্ই দশকে যে নারী সংগঠনগুলো সিলেটের নূরজাহানের ফতোয়ার বিরুদ্ধে পথে নেমে বিশাল আন্দোলন করেছিল তারা ২০১৩ সালের হেফাজতিদের তেঁতুল হুজুরের বিরুদ্ধে তেমন নারী-সমাগম করতে পারেনি কেন? একটা ইউনিফরম ফ্যামিলি ল' চালু করা নিয়ে আশির দশকে যে আন্দোলন দেখেছি আজ তা কেন এত নিশ্চুপ?

বাংলাদেশের ২০১৯ সালের নির্বাচনে দলগুলোর মেনিফেস্টোতে 'ইসলাম' অনেকখানি জায়গা করে নেবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এমনকি দেশের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথা বলার মতো দুঃসাহসও যদি কোনো দল দেখায় বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি কোনো 'প্রগতিশীল' দলও যদি বলে! বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বিভিন্ন লেখার যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই তাতে মনে হয়, এদেশের মানুষ ক্রমশ চরম ডানপন্থী হতে চলেছে।

শুধু লেখার প্রতিক্রিয়া নয়, হিজাবের আধিক্য ও কিছু মানুষের মানসিকতা দেখে এ উপলদ্ধি আরও বেশি করে আসছে। কোনো দল এসে যদি বাংলাদেশের নারীদের হিজাব বা বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করে তখন তার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উইমেন মার্চ বা তেহরানের নারীদের বিক্ষোভের মতো অত বিশাল সমাবেশ হবে তা আশা করা যাচ্ছে না।

যে দলগুলো প্রগতিশীল বা বামপন্থী তারাও যে চরম ডানে ঝুঁকবে তা তো এখনই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।