সংখ্যালঘু: ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 4 Feb 2017, 12:43 PM
Updated : 4 Feb 2017, 12:43 PM

Life is elsewhere– মিলান কুন্ডেরার উপন্যাসের আক্ষরিক সত্যতার মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি দেশ ছেড়ে অন্যত্র জীবনের খোঁজে যায়, তাহলে আদমশুমারিতে বেশুমার পরিবর্তন আসতে বাধ্য। শুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০০১ ও ২০১১ সালের জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে। বিবিএসের কর্মকর্তারা এর কারণ ব্যাখ্যা করেতে গিয়ে বলেছেন, এসব জেলার হিন্দুরা আশপাশের অন্য কোনো জেলায় চলে গেছে। তবে পরিসংখ্যান কর্মকর্তাদের এই মতকে মানা যায় না, কারণ অন্য জেলায়ও হিন্দু জনসংখ্যা বাড়েনি। কর্মকর্তারা এদের বলছেন, 'মিসিং পপুলেশন' বা 'হারিয়ে যাওয়া মানুষ'।

২০০১ সালের আদমশুমারিতে বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা এই ছয়টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা ছিল আট লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বরিশাল বিভাগের কোনো জেলাতেই হিন্দুর সংখ্যা বাড়েনি।

খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে। পাশের নড়াইল ও কুষ্টিয়া জেলার প্রবণতা আগের জেলাগুলোর মতো। ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে ।

মোট জনসংখ্যার তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যা ও হার কমেছে, মুসলমানদের সংখ্যা ও হার সবসময়ই বেড়েছে– স্বাধীনতার আগের দুটি ও পরের পাঁচটি শুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করলে এমনটাই দেখা যায়। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর হার মোটামুটি একই ছিল বা আছে। কিছুদিন আগের এই পরিসংখ্যান প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সংখ্যালঘুদের উপর শুরু হওয়া নির্যাতন এই পরিসংখ্যানের সত্যতা যাচাইয়ের অবকাশ পাওয়া যায়। সময় ও ভূগোল বদলেছে, বদলায়নি সংখ্যালঘুদের নিয়তি ।

ইদানীং রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।

বাংলাদেশের গত ২০১৩ সালের শুরুর দিকের সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে উদ্ভূত। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের সময় থেকে এ সহিংসতার শুরু। যেন বিচারের রায়ে হিন্দুদের কোনো ভূমিকা ছিল। অথচ অকারণে গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে হিন্দুদের উপর, তাদের ধর্মস্থানের উপর, ব্যবসা ও বাসস্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছে। ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়েছে। গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে হিন্দুদের আতংকিত করা হয়েছে। দেশের অনেক স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয় আদালতে; অথচ প্রাণ দিতে হয় সংখ্যালঘুদের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; আক্রমণকারীদের হাত থেকে তাদের বাঁচানো। তারা কঠোর হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। কেবল দলীয় পরিচয়ের কারণে কাউকে তোষণ করবে না। তারা দল-মত নির্বিশেষে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তারা অবস্থান নেবে আইন অমান্যকারীর বিপক্ষে। মনে রাখতে হবে, তাদের শক্তির উৎস আইনের ম্যান্ডেট ও জনগণের আস্থা। মনে রাখতে হবে, সবার উপরে দেশ ও দেশের মানুষ। সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্বায়িত পৃথিবীতে ধর্মীয়, জাতিসত্তাগত, বর্ণগত নানা শ্রেণির সংখ্যালঘু আছে। অধিকাংশ দেশেই দাবি করা হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম-অধিকার ভোগ করে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-সংক্রান্ত বাস্তবতা এর বিপরীত।। আর উপমহাদেশের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই দাবির সত্যতা আরও বেশি থাকে না। রাষ্ট্রে ও সমাজে সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতো সমান গরিমা পায় না সংখ্যালঘুরা।

সাম্প্রতিক শুরু হওয়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আর ১৯৯০ সালে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ছাড়া বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রকাশ্য সংখ্যালঘু নির্যাতন আর হয়নি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা পরিচালিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দাবি করে, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই। তবে সত্য হচ্ছে দাঙ্গা-যুদ্ধ হয় সমানে সমানে, কিন্তু লঘুদের কি সেই সামর্থ আছে গুরুদের সঙ্গে লড়ার? প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কমজোরি সংখ্যালঘুরা এখন টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত।

সংখ্যালঘু বৈষম্য-নির্যাতন নেই– এই সরল মন্তব্যের কোনো ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি সরকার। প্রকাশ্য দাঙ্গা নেই, অপ্রকাশ্য সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে; কোনোটা গনমাধ্যমে আসে কোনোটা আসে না। নাসিরনগর তার সর্বশেষ উদাহরণ। ২০০১ সালে জোট সরকারের আমলে আহমদিয়া সম্প্রপ্রদায়ের মুসলমানদের অমুসলমান ঘোষণা করে তাদের সম্পত্তি ও মসজিদের উপরও হামলা হয়েছিল। ছলে-কৌশলে হিন্দুদের সম্পত্তি গ্রাস তো নৈমিত্তিক খবর।

পৃথিবীর সব দেশের মতো আমাদের দেশেও সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ। কে তাদের নিরাপত্তা দেবে? রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, রাজনৈতিক দলগুলো নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, নাগরিক সমাজ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। সবাই ব্যর্থ হয়েছে। একটি সমাজ কতটা সভ্য তা নিরূপিত হয় সেই দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আছে কি না তার উপর। একটি দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা নিরূপিত হয়ে সেই দেশে ভিন্নমত গ্রাহ্য করা হয় কি না তার উপর।

এত সহিংসতার পরও মনে হয় দুঃখের রজনী এখনও শেষ হয়নি; শঙ্কা, বিহ্বলতা ও অনিশ্চয়তা এখনও সংখ্যালঘুদের ঘিরে রেখেছে অক্টোপাসের মতো। আমরা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এই জটিল ও কঠিন সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধে সবাইকে সক্রিয় ও সজাগ থাকা এবং সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সরকার, প্রশাসন বলছে, প্রচলিত আইনে আক্রমণকারীদের বিচার করা হবে। তবে সংখ্যালঘুরা মনে করে, সংখ্যালঘু নির্যাতনবিরোধী একটি সুস্পষ্ট আইন প্রবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

আপামর বাংলাদেশিদের এসব নির্যাতনের ঘটনায় কোনো সমর্থন নেই। তবে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকাও নেই, ঘটনার আকস্মিকতায়, অভূতপূর্ব হিংস্রতায়, মানুষ আতংকিত, বাকরুদ্ধ, উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত ।

বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক; মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে, একে অপরের পাশে দাঁড়াবে, অবশেষে মনুষ্যত্বই জয়ী হবে। এই ক্রান্তিকালের ধ্বংসস্তূপে আশার আলো জ্বালাবার কিছু প্রয়াস আমাদের প্রাণিত করে। মাননীয় হাইকোর্ট সাম্প্রতিক কিছু সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ কেন আমলে নেওয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে সংখ্যালঘুরা। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করেছে। এসব মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্যতা দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। 'সেক্যুলার' ঘরানার রূপ দিতে তখনকার আইনপ্রণেতারা চেষ্টা করেছিলেন আন্তরিকভাবেই, কিন্তু রাজনীতিতে তার চর্চা শুরু থেকেই অনুপস্থিত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পর তথাকথিত ইসলামী ভাবাদর্শ দ্রুত ভিত গড়তে শুরু করে বাংলাদেশে। একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি ভাবাদর্শ বিতাড়িত করা যায়নি, বরং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে সেই সময়ে।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করার জন্য আপস করলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সঙ্গে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন। ধর্মভাবাপন্ন পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংবিধানে ধর্মীয় ভাব নিয়ে আসা হয়। আর 'কপট' ধার্মিক এরশাদ তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করেন।

আগের সংশোধনী বাতিল ও নতুন সংশোধনী 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম' পরস্পর বিরোধী প্রপঞ্চ পাশাপাশি রেখেছে। আওয়ামী লীগও ধর্মের 'ব্যাটন' নিয়ে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল কেতাবি বিষয় হয়েই আছে বাংলাদেশে।

এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের একটি যৌথ সমাজ ছিল। সত্যি বলতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে। ব্রিটিশ আমলে এমনকি পাকিস্তান আমলেও এই ভূখণ্ডের দুই প্রধান জাতি– হিন্দু ও মুসলমান– দুই সহোদরের মতো বসবাস করত। জাতীয়তাবাদী শক্তির বিশ্বাসঘাতকতা ও বাম শক্তির ব্যর্থতায় সাম্প্রদায়িকতাও ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে বাংলাদেশে।

সংখ্যালঘু নাগরিক ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, একটি ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের দ্রুত পাকড়াও করে আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার না করা ও রাজনীতির মোড়কে ঢেকে ঘটনাটি থেকে নানা রকম ফায়দা লোটার চেষ্টা করা। সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের প্রেক্ষাপট ও রাজনীতি বিশ্লষণ করে একথা বলা যায়, সংখ্যালঘুদের নিয়ে এখন রাজনীতি চলছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালানো হচ্ছে। এটা সংখ্যালঘুমুক্ত দেশ গড়ার একটি অংশ।

ঐতিহ্যগত সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ যে নির্যাতন সংখ্যালঘুদের উপর হয়েছে, তা তদন্ত এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হলে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনকে অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। সাম্প্রদায়িক বা ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির চর্চা জারি রেখে রাষ্ট্র ও প্রশাসনে সাম্প্রদায়িক উপাদান জিইয়ে রেখে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার আশা বাস্তবসম্মত নয়। কতিপয়ের মানসভূমিতে যদি সাম্প্রদায়িকতার বীজ না-ই থাকত তবে বাংলাদেশের সমাজভূমিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ দেখতে হত না।