ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল জাতীয় শিক্ষানীতির অন্তর্ভুক্ত হোক

সালেক উদ্দিন
Published : 1 Feb 2017, 10:18 AM
Updated : 1 Feb 2017, 10:18 AM

বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন লাখ। উচ্চবিত্তের শিশুদের উন্নত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবসা হিসেবে এদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের যাত্রা শুরু হলেও, বর্তমানে এসব স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী মধ্যবিত্ত পরিবারের। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের কথা ভেবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা নিজেরা অভুক্ত থেকেও সন্তানদের এসব স্কুলে ভর্তি করান।

বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মানেই লক্ষাধিক টাকা দিয়ে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা, তের-চৌদ্দ হাজার টাকা মাসিক বেতন দেওয়া, বিশ কী পঁচিশ কেজি ওজনের বই-খাতার স্কুলব্যাগ পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে ক্লাসে ঢোকা, ইত্যাদি ইত্যাদি। শিশুদের বইয়ের বোঝা বইবার বিষয়টি অমানবিক হলেও কারও তাতে মাথাব্যথা নেই। ফলে লেখাপড়া শিশুদের কাছে বিষাদময় রূপ ধারণ করছে। তাছাড়া পড়াশোনার চাপ বাড়তে বাড়তেও সেটা দুঃসহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। শিশুরা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বইয়ের ভার বহন করে তারা মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়ার মতো মারাত্নক ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে।

শিশুদের বইয়ের বোঝা টানার এই কালচার বাংলা মিডিয়ামের কিছু স্কুলেও রয়েছে। তবে সেটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মতো কঠিন নয়।

শিশুরা ভারী ব্যাগ বহনের ফলে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাওয়াসহ কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা তুলে ধরে হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে। মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট এই মর্মে রায় দিয়েছেন যে, শিশুদের ওজনের দশ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন করা চলবে না। এই নির্দেশনা সম্বলিত আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন কোর্ট। আইন প্রণয়ন সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া– এই বিবেচনা থেকে হাইকোর্ট সরকারকে এমন নির্দেশও দিয়েছে যে, আইন প্রণয়নের আগ পর্যন্ত সরকারি সার্কুলারের মাধ্যমে শিশুদের ভারী ব্যাগ বহনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে হবে।

হাইকোর্টের এই নিষেধাজ্ঞা সর্বস্তরে কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে জানি না, তবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যে কার্যকর হয়নি সে ব্যপারে আমি নিশ্চিত। কারণ আমার মেয়ে রাজধানীর তথাকথিত নামকরা একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বইয়ের বোঝা বইতে বইতে সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও লাভ হয়নি। তিনি বলেছেন, 'এটাই স্কুলের নিয়ম। নিয়ম মানতে হবে'।

শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মানেই লক্ষাধিক টাকা দিয়ে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা এবং চৌদ্দ-পনের হাজার টাকা মাসিক বেতন দেওয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভর্তি, সেশন ফি ও মাসিক বেতন শুধু বেমানান বললে ভুল হবে, এটা রীতিমতো নির্যাতন। এটা সম্ভব হচ্ছে এসব স্কুলের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে।

দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো সরকারের নিয়ম-নীতির ধার ধারে না। বলা যেতে পারে যে, সরকারও পুরোপুরি নির্বিকার। সরকারি নীতিমালা না থাকায় স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে বলারও কিছু নেই। এগুলো চলছে মর্জিমাফিক। ইচ্ছেমতো টিউশন ফি আদায় করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধন বাধ্যতামূলক মনে করছে না। ভাড়াবাড়িতে স্কুল বসিয়ে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে গিয়ে অভিভাবকরা যত বাধার সন্মুখীন হন না কেন, এর প্রতিকার নেই। কারণ শিক্ষা প্রশাসন এর কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঢাকার ধানমণ্ডিতে অবস্থিত পাঁচ তলাবিশিষ্ট যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আমার মেয়ে পড়ে সেখানে ওর ক্লাসের মাসিক বেতন চৌদ্দ হাজার টাকা। ছোট ছোট বাচ্চাদের পিঠে চাপাতে হয় পনের-বিশ কেজি ওজনের স্কুলব্যাগ। এই ভারী ব্যাগ পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে শিশুদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় চার-পাঁচ তলা। স্কুলে লিফট আছে, তবে তা ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না– তা ব্যবহার করেন শিক্ষকরা।

আমার জানামতে একবার এক অভিভাবক এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, শিক্ষকদের পিঠে কত মণ ভারী বোঝা থাকে যে, শিক্ষকদের বাদ দিয়ে তাদের লিফটে যেতে হবে– আর ছাত্রছাত্রীদের আধামণি ব্যাগ পিঠে নিয়ে ৪ তলায় উঠতে হবে সিঁড়ি বেয়ে?

এ রকম প্রতিবাদ অনেকেই করেন। কোনো লাভ হয় না। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে শিক্ষক ও অফিস স্টাফরা এসির মধ্যে থাকলেও ক্লাসরুমে এসি চলে না। প্রতি বছরই দুয়েকজন শিশু হিটস্ট্রোক করে এই স্কুলে। তারপরও ক্লাসরুমে এসি চালানো হয় না। অভিভাবকরা এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ করলেও লাভ হয় না। বলা হয়, 'স্কুল তার নিজস্ব নিয়মে চলবে'।

প্রতিকার চাওয়ার জায়গা নেই!

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে শিশুর মাসিক বেতন বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। তারপরও স্কুলগুলো ইচ্ছেমতো বেতন ও সেশন ফি বাড়িয়েই চলছে। কিন্তু প্রতিকার চাওয়ার জায়গা নেই।

বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন ও সেশন ফির সঙ্গে ভ্যাট নেওয়ার রীতি না থাকলেও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে শিশুর বেতনের সঙ্গে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। চিকিৎসা ও শিক্ষা ভ্যাটমুক্ত খাত হলেও এসব স্কুলের শিশুর বেতনের সঙ্গে ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছেই। প্রতিকার চাওয়ার জায়গা নেই।

আমাদের শিক্ষানীতিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ নেই। আর সে কারণেই নেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ। তারা চলছে তাদের মতো। ইচ্ছামতো বেতন ও সেশন ফি নির্ধারণ করছে এবং যথারীতি তা আদায়ও করছে। তোয়াক্কা করছে না কারও কথা। কিন্তু যদি আমাদের শিক্ষানীতিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবেই শিক্ষা ক্ষেত্রের এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব।

যতদূর মনে পড়ে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নীতিমালা তৈরির জন্য নির্দেশনা চেয়ে দুই অভিভাবক হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট নীতিমালা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। গত ৩ বছরে সেই নীতিমালার কী দশা হয়েছে জানি না। তবে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে দেখলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেছেন,

"ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এটি ভেটিংএর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয় কিছু পরিমার্জন করতে বলেছে। পরিমার্জনের কাজ শেষ। দ্রুততার সঙ্গে তা আবার আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তাদের মতামতের পর পরিপত্র আকারে নীতিমালা জারি করা হবে। নতুন নীতিমালায় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো।"

এ প্রসঙ্গে যে কথা না বললেই নয় তা হল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশের পর নীতিমালাটি প্রথমবারের মতো আইন মন্ত্রণালয় ঘুরে আসতে সময় লেগেছে তিন বছর। এটি দ্বিতীয়বারের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে। সেখানে পরিক্রম করে ফিরে আসতে এবার কতদিন লাগবে কে জানে।

তারপরও আশা করব, শিক্ষানীতিটি দ্রুততার সঙ্গে আবার আইন মন্ত্রণালয়ে যাক। দ্রুত তাদের মতামত নিয়ে ফিরে আসুক এবং এ বছরই পরিপত্র আকারে জারি হোক। আর সেই নীতিমালায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসুক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো।