বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে সুখের বাড়বাড়ন্ত ও উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গি

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 25 Jan 2017, 07:26 AM
Updated : 25 Jan 2017, 07:26 AM

বেতন-ভাতা বাড়ুক, তাতে হয়তো অনেকের আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে কার কতটুকু বেতন বাড়ল, কার বাড়া উচিত ছিল কিংবা দেশের সব শ্রেণির বেতনের মধ্যে কতটুকু সমতা আছে, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি বলেই মনে হয়।

কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী মহোদয়দের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হয়েছে। বেতন শুধু দ্বিগুণই হয়নি, তাদের বিভিন্ন রকমের ভাতাও বাড়ানো হয়েছে। এর আগে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে সরকারের সব পর্যায়ের কর্মকতা-কর্মচারীদের; শুধু বাড়েনি, বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তার মানে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই এখন সুখের গলা বাড়বাড়ন্ত।

দেশের মোট ৬ কোটি ১০ লাখ শ্রমশক্তির মধ্যে মাত্র ২১ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদের জীবন কীভাবে চলবে, তা বিবেচনা করা হয়নি! সাধারণ মানুষের মজুরি ও আয় কীভাবে বাড়বে? তা ভাবা হয়নি। এর ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম। বাড়িভাড়া বাড়ছে, যাতায়াত ভাড়া বাড়ছে, বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। যাদের বেতন বাড়ল, তারা হয়তো সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু যাদের বেতন-ভাতা বাড়ল না, আয় বাড়ল না, তাদের কী হবে?

এই বেতন বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে মনে হয়, "আমরা সরকারে আছি, আমরা বেতন বাড়িয়ে নেব, কার কী"– এমন দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে। আর যারা সরকারের বাইরে আছে, কিন্তু সরকারি দল করছে, তাদের অনেকে আখের গুছিয়ে নিতে পিছপা হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে একটা সাধারণ প্রশ্ন– যাঁরা মন্ত্রী ও এমপি, তাঁরা কি শুধু সরকারি বেতন থেকেই জীবন নির্বাহ করেন? তাদের আর কোনো আয় নেই?

সাধারণ মানুষও জানে তাদের কত রকমের আয়-উপার্জন! দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধিতে উল্লিখিতদের কতটুকু অবদান, তা বিবেচিত হতে পারে। এই বিবেচনায় তারা কতটুকু সুযোগ পেতে পারেন, তা বিবেচনায় টেনে আনা উচিত। পাশাপাশি আর কাদের অবদানে এই প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী, তা-ও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রণোদনায় বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখে প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন।

অর্থনৈতিক অনেক সেক্টরের সম্মিলিত অবদানও কম নয়। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি হলেই এর সুফল ভারসাম্য নিয়ে সবাই ভোগ করতে পারছেন, তা-ও না। সমাজে বৈষম্যও বাড়ছে।

যে শাসনব্যবস্থাই প্রবর্তন করা হোক, তাতে জনগণের কল্যাণ কতটুকু রক্ষা করা হয়, তা জনগণ দ্বারা কতটুকু সমর্থিত হয়, তা বিবেচনায় আনা একটি দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের অন্যান্য মানুষের আয়-রোজগারের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার সংশ্লিষ্টরা নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জোরে যেভাবে দ্বিগুণের বেশি হারে বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়ে অন্যদের বৈষম্যের মধ্যে ঠেলে দিল, তা শাসক সম্প্রদায়ের বিমাতাসুলভ উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জোরালো করে।

আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি, সেই উন্নয়ন কার জন্য হচ্ছে, কতটুকু হচ্ছে, সেই বিবেচনা থেকে মানুষকে বেশিদিন ভুলিয়ে দূরে রাখা যাবে না।

এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সীমিত চর্চায় বারবার ভোটে অংশ নিয়ে বৃহত্তর জনগণ একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছেই বন্দি হয়ে পড়ছে। এই গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে লুটপাট করার প্রবণতায় এমনভাবে উদগ্র থাকে, যার ফলে জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তিস্বার্থ জাতীয় স্বার্থের উপরে স্থান দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে শাসকদলের মধ্যে যে গোষ্ঠী ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে থাকে তারা আদর্শ, নৈতিকতা ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা কতটুকু পরিচালিত হয় তার ওপরও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অনেকটা নির্ভর করে। ক্ষমতা না হারানোর আগ পর্যন্ত তা অবশ্য তারা বোঝেন না; ক্ষুৎকাতর স্বভাবের তারা বিভোর হয়ে দিনানিপাত করতে থাকেন।