ফুয়েন্তেসের মৃত্যু ও তাঁকে ঘিরে একটি সুখস্মৃতি

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 21 May 2012, 09:45 AM
Updated : 21 May 2012, 09:45 AM

লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ও শক্তিমান কথাসাহিত্যিক কার্লোস ফুয়েন্তেসের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে শোকানুভূতির পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে একটি সুখস্মৃতিও জাগ্রত হলো মনে। পাঠকের সঙ্গে সেই স্মৃতিটুকু ভাগ করে নেওয়ার জন্যই এই ছোট্ট লেখাটুকুর অবতারণা।

১৯৯৫ সালের কথা। আমি তখন ন্যুয়র্কবাসী। ন্যুয়র্ক-এর প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটনে 92nd St. Y নামে চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। সংবৎসর সেখানে বসে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতের আসর। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসেন ডাকসাঁইটে সব শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক, নর্তক, বিপ্লবী, বক্তা। তাঁরা কেউ কবিতা পড়েন, কেউ অভিনয় করে দেখান, কেউবা আলোচনা করেন গুরুগম্ভীর সব বিষয় নিয়ে। ন্যুয়র্কের সংস্কৃতি-অনুরাগী নাগরিকেরা তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েন সেই সব রথী-মহারথীদের চোখে দেখতে, তাঁদের কথা শুনতে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এসব অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, যে-কেবল তারকাদেরকে চোখে দেখেই তৃপ্ত হয় না তাঁদের দুর্লভ ভঙ্গিগুলোও বন্দী করে নেয় তার অনুসন্ধানী ক্যামেরার ফ্রেমে।

তো সেই মামুনের কাছ থেকেই একদিন খবর পেলাম শিগগিরই সেখানে দেখা দেবেন সমকালীন বিশ্বের তাবড় তাবড় ক'জন সাহিত্যিক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সল বেলো, অড্রিয়েন রিচ, কাজুও ইশিগুরো, উমবের্তো একো, কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রমুখ। অড্রিয়েন রীচের কবিতা পাঠ আগে শুনেছি, আগ্রহ ছিল তাই বিশেষ করে বেলো, ফুয়েন্তেস ও একোর ব্যাপারে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বেলো ও একোর অনুষ্ঠানের টিকিট এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেছে। তাই আর কালবিলম্ব না করে কার্লোস ফুয়েন্তেসের অনুষ্ঠানের টিকিট কাটি। ফুয়েন্তেসকে এর আগে একবার জাতিসংঘের বইয়ের দোকানে এক ঝলকের জন্য দেখেছিলাম তাঁর মেহিকোর ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ Buried Mirror এর স্বাক্ষর উৎসবে। তাছাড়া তাঁর ওপর নির্মিত চমৎকার প্রামাণ্যচিত্র Crossing the Border টিও দেখা ছিল। কিন্তু সামনাসামনি তাঁর কথা শোনার অভিজ্ঞতাই যে আলাদা!


অনুষ্ঠানের রাতে তাই আগেভাগেই গিয়ে হাজির হই মিলনায়তনে। সঙ্গে চাটগাঁর ছেলে জুয়েল, যে কিনা আবার ইংরেজিতে কবিতা লিখে এবং শিল্পসাহিত্যের প্রবল অনুরাগী। মঞ্চের কাছাকাছি আসন বেছে নিয়ে বসি। সময়মতোই শুরু হল অনুষ্ঠান। কার্লোস ফুয়েন্তেসকে দর্শকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর Christopher Unborn, The Campaign ইত্যাদি উপন্যাস ও প্রকাশিতব্য ছোট গল্পগ্রন্থ The Crystal Frontier এর অনুবাদক কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের শিক্ষক আলফ্রেড ম্যাক অ্যাডাম। তুমুল করতালির মধ্যে মঞ্চে প্রবেশ করেন বর্তমান মেহিকোর প্রধান কথাসাহিত্যিক, বিশ্বমাপের একগুচ্ছ উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের রচয়িতা ৬৭ বৎসরের টগবগে তরুণ কার্লোস ফুয়েন্তেস। খাকি প্যান্ট, হাতা গোটানো শার্ট সুপুরুষ ফুয়েন্তেস স্মিতমুখে দর্শকদের অভিবাদন জানালেন। বললেন, এই মিলনায়তনে শেষ তিনি এসেছিলেন পাবলো নেরুদার মৃত্যুর পর তাঁর শোকসভায়। আবার এতদিন পরে ন্যুয়র্কের ভক্তদের কাছে ফিরে আসতে পেরে যে ভীষণ খুশি হয়েছেন তিনি একথা জানাতে ভুললেন না। শৈশব-কৈশোরে কূটনীতিবিদ বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিন তিনি এদেশে ছিলেন। ফলে ইংরেজিটা আয়ত্ত করেছেন চমৎকার। তাঁর সেই দ্রুতলয়ের, স্প্যানিশের গোপন টানে-ভরা, ইংরেজিতে তিনি যে গল্পখানা পড়বেন তার পটভূমি বর্ণনা করলেন সংক্ষেপে। তিনি জানালেন, যুক্তরাষ্ট্র ও মেহিকোর সম্পর্কের টানাপড়েন তার বরাবরের প্রিয় বিষয়। প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যবর্তী সীমান্ত রেখাটিকে তিনি কেবল ভৌগোলিক অর্থে না দেখে আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও দার্র্শনিকতার আলোকে দেখতে ভালোবাসেন। এই বিষয়ের বহুমাত্রিকতাকে আশ্রয় করে লেখা তাঁর আসন্ন প্রকাশিতব্য গ্রন্থ, তাঁর ভাষায় 'A Novel in nine stories', The Crystal Frontier এর প্রথম গল্প 'The line of oblivion' কে তিনি তাই সেদিনের পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করেছেন বলে জানালেন।

ফুয়েন্তেস খুব ভালো বক্তা জানতাম কিন্তু পাঠ এবং অভিনয়েও যে এতটা দক্ষ তিনি সেটা তাঁর গল্পপাঠ না শুনলে অজানাই থেকে যেত। ফুয়েন্তেস গভীরভাবে চলচ্চিত্রের অনুরক্ত মানুষ এবং তাঁর প্রথম স্ত্রীও ছিলেন মেহিকোর একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। সেই জন্যই সম্ভবত তিনি প্রায় পেশাদার কথক/অভিনেতার ভঙ্গিতে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে একটানা পড়ে শোনালেন আশ্চর্য, সুন্দর সেই গল্পখানা। এক বৃদ্ধ কম্যুনিস্ট তার জীবনের শেষ পর্বে এসে স্বজন পরিজন পরিত্যক্ত অবস্থায় হুইল চেয়ারে বসে যে দীর্ঘ স্বগত সংলাপে তার জীবনের স্মৃতি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে ভাষা দেয় সেটাই মূর্ত হয়ে ওঠে ফুয়েন্তেসের আবেগাপ্লুত প্যাশনপূর্ণ, একাত্ম পাঠে। আমরা বুঝতে পারি এ গল্পের মূল রাজনৈতিক দার্শনিক প্রণোদনাটুকু ফুয়েন্তেসেরই নিজের জীবনাভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে পওয়া। তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এমন দুর্নিবার আবেগে উদ্বেল হয়ে মেহিকোর যন্ত্রণাকে সর্বজনীন করে তোলা। সুলেখক ফুয়েন্তেস এতকাল লেখার গুণেই আমাকে অনুরক্ত করে তুলেছিলেন, সেদিন তাঁর এই অপর নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে সেই অনুরাগটুকু বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিলো। আজ ফুয়েন্তেস নেই, রয়েছে তাঁর অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থরাজি, আর সেইসঙ্গে তাঁকে ঘিরে আমার এই এক টুকরো অমূল্য স্মৃতি। পাঠকের সঙ্গে সেই স্মৃতিটুকু ভাগ করে নিতে পেরে তাঁর না-থাকার বেদনাটুকু বুঝিবা কিছুটা প্রশমিত হলো!