মোদির আচ্ছে দিন ও নোটবন্দি ভারত

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 16 Jan 2017, 06:38 AM
Updated : 16 Jan 2017, 06:38 AM

স্বাধীনতাত্তোর ভারতের ৭০ বছরে মোদি নোটবন্দি করে ভারতকে ৭০ দিনে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছেন। এই অভিমত ১৩০ কোটি দেশবাসীরই নয়, বিশ্বের তাবড় অর্থনীতিবিদদেরও। বিশ্ব ব্যাংক এই নোটবন্দির ফলে ভারতের বৃদ্ধি যে পিছিয়ে গেল সে ব্যাপারে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আসেনি, পাশও হয়নি। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বলেছেন, যদি আলোচনা হয়ও, তাহলে তার বিবরণী প্রকাশ্যে আসতে হবে।

এই ৭০ দিনে ভারতের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। তার ফল এখন ভারতের ১৩০ কোটি লোক হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। শুধু সামরিক বাহিনীর নয়– রিজার্ভ ব্যাংক, সিবিআই, গোয়েন্দা সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবই তিলে তিলে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। মোদি এখনও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে যাচ্ছেন, তিনি যা করেছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু সবই যে তার খুশিমতো হয় না, দেশের আইন আছে।

ভারতের শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ সাম্প্রতিককালে এক রায়ে বলেছেন, নির্বাচন এলেই কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে খ্রিস্টান, কে শিখ, কে আদিবাসী, কে দলিত– এ প্রসঙ্গ আনা যাবে না। তা যদি হয়, তাহলে প্রার্থী ও দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন।

এই আদেশ পাওয়ার পরই ভারতের নির্বাচন কমিশনার নাসিম জাইদি সব রাজনৈতিক দলকে জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। নির্দেশ অমান্য করে আরএসএস তথা বিজেপির সাংসদ সাক্ষী মহারাজ উত্তর প্রদেশের এক জনসভায় বলেছেন, "ভারতের জনসংখ্যা বাড়ার মূল কারণ মুসলমানরা। তারা একাধিক বিয়ে করেন।"

তার এই উক্তি সংবিধানবিরোধী বলে তাকে শো-কজ করেছে নির্বাচন কমিশন। শো-কজ করতেই আরএসএস-বিজেপি রে রে করে উঠেছে। কিন্তু জাইদিও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি আইন ও সংবিধানের মধ্যেই নির্বাচন পরিচালনা করতে চান। প্রসঙ্গত, আগামী মাসের ২ তারিখ থেকে উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জার, গোয়া, উত্তরখণ্ড ও মণিপুরে বিধান সভা নির্বাচন।

মোদি ভেবেছিলেন, এই রাজ্যগুলিতে জেতার জন্য তিনি সার্জিকাল স্ট্রাইক ও নোটবন্দিকে হাতিয়ার করবেন। ৮ নভেম্বর মধ্যরাতে নোট বাতিল ঘোষণার পর থেকে বলে আসছিলেন, এই নোটবন্দি করার দায় সবই ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর উর্জিত প্যাটেল সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছেন, তার দায়দায়িত্ব নেই। কারণ মোদি সরকারই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৭০ দিন হয়ে গেলেও দেশের সাত শতাংশ মানুষের কোনো সুরাহা হয়নি। হওয়ার আশাও নেই।

এই নোটবন্দির ব্যাপারে একটি বেসরকারি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, নোটবন্দি করে দেশের কতবড় সর্বনাশ মোদি করেছেন, তা বুঝতে আরও সময় লাগবে। শুধু আর্থিক সর্বনাশই নয়, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরও চরম আঘাত হেনেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দল তো দূরের কথা, নিজের সহকর্মীদের সঙ্গেও নোট বাতিলের ব্যাপারে আলোচনা করেননি তিনি। অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে গোলমালের জেরে বিরোধীরাও ঠিকমতো প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেননি।

তিনি বলেছেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। কিন্তু সে যুদ্ধে জিততে পারবেন না বুঝেই এখন আর কালো টাকার কথা মুখেও আনছেন না। এখন নগদহীন অর্থনীতির ধুয়ো তুলেছেন। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তে ক্ষতি হয়েছে কিনা, সে আলোচনার অবকাশ আর নেই।

এখন দেখা দরকার কতটা ক্ষতি করে দিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মতে, কিছু মানুষ এখনও নরেন্দ্র মোদির সিদ্ধান্ত সমর্থন করে চলেছেন। যখন তারা বুঝতে পারবেন ততক্ষণে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে যাবে। তিনি বলেছেন, রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদে যদি ড. মনমোহন সিং বা রঘুরাম রাজনের মতো ব্যক্তিত্ব থাকতেন, তাহলে এত সহজে নোট বাতিলের রাস্তায় যেতে পারতেন না মোদি।

নোট বাতিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে অমর্ত্য সেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। বলেন, রাশিয়া দখল করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন নেপোলিয়ন। কয়েক হাজার সেনা বাদে সকলকেই প্রাণ দিতে হয়েছিল সেই যুদ্ধে। রুগ্ন, হতোদ্যম কয়েক হাজার সেনাকে নিয়ে ফিরে এসে নেপোলিয়ন যদি বলতেন, আমরা রাশিয়ায় বরফ দেখতে গিয়েছিলাম, তাহলে যা হত, নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রেও তাই হবে। নোট বাতিল কাণ্ডে লেজেগোবরে হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি অন্য কিছু একটা বলে গা-বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।

ভারতের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত দিন যাচ্ছে তত ভেঙ্গে পড়ছে। মোদি সারা দেশে ঘুরে কংগ্রেস পার্টিকে যে ভয় দেখাচ্ছেন, তা উড়িয়ে দিয়ে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেছেন, মোদিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোনোভাবেই মাথায় চড়তে দেওয়া হবে না।

এই পরিস্থিতিতে ভারতবাসী কবে কীভাবে মুক্তি পাবে, তার কোনো দিশা দেখা যাবে না। রাহুল বলেছেন, মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনতে পারলেই ফিরবে আচ্ছে দিন। গরিবের টাকা, চাষীর টাকা নিয়ে আরএসএস বিজেপির তহবিল ভারী করা দেশের মানুষ মেনে নেবে না।

ইতোমধ্যে দেশের ২৫ কোটি লোক কর্মচ্যুত হয়েছেন। মোদি বলেছেন, প্রতি বছর এক কোটি লোককে চাকরি দেবেন। কিন্তু তার শাসনকালে কর্মসংস্থানের যে ভয়াবহ চিত্র তৈরি হয়েছে, তা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এদেশে কোনো দিন জাতপাত সামনে রেখে মানুষকে দুর্বল করা যাবে না। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে যে 'আচ্ছে' দিনের কথা বলেছিলেন, তা যে দুর্দিনে পরিণত হবে তা দেশের মানুষ বুঝতে পারেননি।

রাহুল আরও বলেছেন, বিপুল অর্থের মালিক নরেন্দ্র মেদি ভারতের মিডিয়াকে সেদিন তার দিকে টানতে পেরেছিলেন। এ দিন সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, আপনারা মানুষের কথা লিখুন।

নরেন্দ্র মোদি উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে যাদব পরিবার (বাবা মুলায়ম ও ছেলে আখিলেশ) মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য আরেক দাউদ ইব্রাহিমকে কাজে লাগিয়েছেন। তার নাম অমর সিং। এই অমর সিং যাদব পরিবারের একতা ভাঙ্গার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন। তার অভিযোগ, নোটবন্দির আগে বিজেপি এত টাকা কীভাবে সরিয়ে রাখল তা-ও দেখা দরকার।

প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরাও। তাদের আশঙ্কা, গোটা দেশে আর্থিক দাঙ্গা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে দিয়েছে। ভারতের শীর্ষ আদালতও একই মন্তব্য করেছে। বিজেপি ও আরএসএস আড়াই বছর আগে জাতপাতের নামে যে বজ্জাতি শুরু করেছিল, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। মানুষ এখন তা ধরে ফেলেছে। তিনি যা বলেন, করেন তার উল্টোটাই। তিনি নিজে যে একজন দুর্নীতিপরায়ণ লোক, তা আগেই ফাঁস করেছিলেন রাহুল গান্ধী। যার গোপন নথিপত্র এখন সামনে এসে গেছে। এখন কংগ্রেস থেকে প্রশ্ন উঠেছে, "আপনি স্বীকার করুন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় সাহারা আর রিচলার থেকে কত টাকা নিয়েছেন।"

বিজেপির মুখ্যপাত্ররা জবাব এড়িয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত কুৎসায় নেমে পড়েছেন। এটাও একটা মারাত্মক প্রবণতা।

১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে বিজেপির হাত ধরে দিল্লি পৌঁছেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। নোটবন্দি দিয়ে তিনি গোটা পশ্চিমবঙ্গে সভা করে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। তার নেপখ্য কারণও উঠে আসছে। তিনি চাইছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে দিল্লির ক্ষমতা দখল করতে। আর পাঁচ রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট কেটে বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়া।

সুতরাং ভারতের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বলা যায়, 'আচ্ছে' দিনের স্লোগান এখন দুর্দিনে পরিণত হয়েছে।