মিলেনিয়ালস প্রজন্ম কি ‘আপনারে লয়ে বিব্রত’?

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 17 Jan 2017, 01:32 PM
Updated : 17 Jan 2017, 01:32 PM

ছোটদের পড়ার বই হেফাজতিকরণ করা হয়েছে। তা নিয়ে তুমূল হৈচৈ হচ্ছে ফেসবুকে। এ নিয়ে রাস্তাঘাটে কী হচ্ছে প্রবাসে থেকে কিছু বুঝতে পারছি না। তেমন কিছু হলে প্রযুক্তির কল্যাণে তা চোখে পড়ার কথা। ফেসবুকে ছাত্র ইউনিয়নের একটি পোস্ট দেখলাম যেখানে 'পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও নজিরবিহীন ভুলের প্রতিবাদে এনসিটিবি ঘেরাওএর কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহরেও হয়তো তারা নানা কর্মসূচি দিচ্ছে।

বাষট্টির ছাত্রআন্দোলনের কথা শুনে আমরা বড় হয়েছি। আইয়ুব খানের আমলে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্ররা পথে নেমেছিল, দেশব্যাপী ধর্মঘট ডেকেছিল। সেটি ছিল আইয়ুব খানের মসনদে আহরণের পর প্রথম ধর্মঘট। হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের সঙ্গে বর্তমান বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তককে এক করছি ভেবে হয়তো অনেকে তেড়ে আসবেন। সেটি না-হয় বাদ দিলাম।

১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের আমলে 'পাকিস্তান: কৃষ্টি ও সভ্যতা' নামের একটি পাঠ্যবই প্রকাশের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের বিক্ষোভের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী প্রজন্ম নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। স্কুলের উচ্চশ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত সেই বইয়ে বাঙালি সংস্কৃতি বিকৃতি উপস্থাপন করার অভিযোগ এনেছিল শিক্ষার্থীরা। বইটিতে শুধু মুসলিম শাসনের জয়গান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বাঙালিদের ইতিহাস শুরু করা হয়েছিল ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের মাধ্যমে। এর আগের পাল, সেন রাজত্ব নিয়ে কোনো লেখাই ছিল না।

বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাস ধামাচাপা দেওয়ার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে, সেই বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে প্রশাসন বাধ্য হয়েছিল সেই বই উঠিয়ে নিতে।

ইয়াহিয়ার সেই ভুত হেফাজতিদের মাধ্যমে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আবার হানা দিল কি না কে জানে। যদি হানাই দেয় সেই ভূত নামাতে শিক্ষার্থীরা কী করছে? বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি সে উচ্ছ্বাস আর আবেগ কি ইসলামি চেতনার কাছে হার মেনে গেল?

'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।' কবি হেলাল হাফিজের কবিতার এই পংক্তি-যুগল বারবার মনে পড়ছে। যৌবন মানে অনাচার আর অন্যায়ে শুধু 'না' বলা নয়, এর প্রতিকার ও প্রতিবাদ করা। পৃথিবীর সকল বিপ্লব, পরিবর্তন সবই সম্ভব হয়েছিল স্ব স্ব দেশ বা স্থানের যুবশ্রেণির কারণে। এসব চর্বিত-চর্চিত কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ ক্ষেত্রে একটু গরমিল ধরা পড়েছে, যৌবনের দূর্ধর্ষতায় সমাজের গতানুগতিকতা ও অনাচার ভেঙ্গে যাবে, তেমন নজির তো দেখা যাচ্ছে না।

'মিলেনিয়ালস প্রজন্ম' (Millennials Generation) নামের এখন যে প্রজন্ম প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্র দাবিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা একত্রিতভাবে সমাজের পরিবর্তন সাধনে সেভাবে এগিয়ে আসছে না– এ অভিযোগ গুরুতরভাবে না এলেও মৃদুভাবে অনেক আলোচনায় উঠে আসছে। ব্যাপারটি বিশ্লেষণের আগে 'মিলেনিয়ালস প্রজন্ম' শব্দবন্ধের উৎপত্তি নিয়ে কিছু বলা যেতে পারে। ১৯৮২ থেকে থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যাদের জন্ম তাদেরকে পাশ্চাত্য মিডিয়া ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা 'মিলেনিয়ালস জেনারেশন' নাম দিয়েছে, তা হয়তো অনেক পাঠকই জানেন। উইলিয়াম স্ট্রাউস ও নিল হাউ ১৯৮৭ সালে প্রথম এ নামের উদ্ভাবন করেন। ২০১৩ সালে 'টাইম' ম্যাগাজিন মিলেনিয়ালস প্রজন্মের উপর একটি কভার স্টোরি করে। এ প্রজন্মের তারা আরেক নাম দেয়্র, 'মী মী মী', অর্থাৎ 'আমাকে আমাকে আমাকে' বা 'আমার আমার আমার'। বোঝাই যাচ্ছে কোন অর্থে তা ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ একে 'নার্সিসাস প্রজন্ম' নামে আখ্যায়িত করেছে।

নিঃসন্দেহে এ প্রজন্ম মানবসভ্যতা দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশেও তাই। যুক্তরাষ্ট্রর প্রতিষ্ঠান এটি কার্নি আট দেশের 'মিলেনিয়ালস প্রজন্ম' বা সহস্রাব্দ প্রজন্মের উপর গবেষণা করে দেখেছে যে, বাংলাদেশের এ প্রজন্ম দেশের উন্নতিতে বিস্ময়কর অবদান রাখবে।

এরপরও প্রজন্মটি আত্মকেন্দ্রিক বলে মনে করা হচ্ছে। সব সময় আগের প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মকে 'বাঁকা চোখে' দেখে। 'আমাদের সময়টাই ভালো ছিল'– এ অহমিকা থেকে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে খুব কম প্রবীণ। এরপরও মানবইতিহাস ঘেঁটে দেখলে প্রজন্ম প্রজন্মান্তরের তফাৎ বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না। সে কারণে কিছু কিছু উদ্ধৃতি সময়সীমা পার হয়ে সকলের বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। আমরা এখনও বলি, 'সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'।

অবশ্যই কারও বিপদে-আপদে এ প্রজন্মও ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা চাঁদা তুলে সহপাঠীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। টোকাইদের জন্য সংগঠন করে তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু এ প্রজন্ম ষাট দশকের মতো কোনো রেনেসাঁ আনতে পারছে না। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা কি আমরা রেনেসাঁ বলব? প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আর সামাজিক অগ্রযাত্রা কি এক হতে পারে?

সমাজের কুসংস্কার বা পশ্চাৎপদতা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারে তরুণ সমাজই। সেই তরুণ সমাজ যদি সমাজ আরও পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিজেদের যুক্ত করে তাহলে সেটা কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার নয়? ধর্মের নামে যে তরুণরা জঙ্গি গোষ্ঠীতে নাম লিখাচ্ছে, তার মানে তারা তো সমাজ পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্রত হয়েছে। এটা বিপ্লব নয়। যখন কোনো ধর্মের আর্বিভাব হয়, তখন সেটি অবশ্যই সে সময়ের জন্য রেনেসাঁ। হাজার বছর পরে সে ধর্মের অনেক অনুশাসন সমাজ পিছিয়ে দেয়।।

জরিপে বলা হয়েছে, ষাট দশকের তুলনায় পাশ্চাত্যের যুবসমাজ ধর্মকর্ম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।। বাংলাদেশে মনে হয় উল্টোটা ঘটছে। এখনকার যুবসমাজ ষাট দশকের যুবসমাজের চাইতে বেশি ধার্মিক। শহরের শিক্ষিত শ্রেণির কথা এখানে প্রাসঙ্গিক। এ কারণে কি পাঠ্যবইয়ে হেফাজতিকরণের প্রতিবাদে যত না যুব-তরুণদের সমাগম দেখি, পাঠ্যবইকে হেফাজতিকরণের পক্ষে কোনো এক হুজুরের বক্তৃতাকালে দাড়ি-টুপিওয়ালা যুবকদের সমাগম আরও বেশি।

এ ব্যাখ্যা একান্ত ব্যক্তিগত। ধর্মপালন অবশ্যই দোষের নয়। ধর্মপালনে মানুষের মনে শান্তি আনতে পারে, জীবন শৃঙ্খলাভুক্ত হয়। ধর্ম পালন করতে গিয়ে ধর্মান্ধ হয়ে গেলেই বিপদ। ধর্মপালনের নামে সমাজের কিছু অসমতায় প্রশ্রয় দিলে, অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা তৈরি করলে এবং তা যদি যুবসমাজ মেনে নেয় তখন সমাজ অবশ্যই প্রগতিশীল না হয়ে রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত হয়।

'মী মী মী' প্রজন্ম নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর সেই প্রজন্মের একজন 'টাইম' পত্রিকায় চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল তারা ফেসবুকের মাধ্যমে কীভাবে একত্রিত হয়ে আন্দোলনে নেমে থাকে। সেই তরুণ সমকামী বিয়ের সমর্থনে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকে রঙ্গধনুর রং ব্যবহার বা ফ্রান্সের সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সেদেশের পতাকা প্রোফাইল পিক করার বয়ান দিয়ে বলছিল, এগুলো হচ্ছে তাদের একত্রিত হওয়ার পন্থা।মিসরের আরব বসন্ত নিঃসেন্দেহে ফেসবুক জেনারেশনের অবদান। কিন্তু সেটার পরিণতি কী হল? কীভাবে যেন সেই আন্দোলন মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে গেল।

আমাদের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পরিণতি কী হল? গণজাগরণ ছিল তরুণ প্রজন্মের কৃতিত্ব। পরে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। সেই আন্দোলন যদি সফলভাবে পরিচালিত হত আজ হেফাজতিদের এত সাহস হত কি? তারা লেজ গুটিয়ে চলে যেত। অনেকে হয়তো বলবেন যে, অন্যরূপে তারা ফিরে আসত। ধর্ম এমন এক অস্ত্র যার ব্যবহার সবচেয়ে সহজ এবং সফলভাবে করা যায়।

ধর্মভিত্তিক শাসন নয়, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা একটা সমাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। এ সকল প্রগতিশীল মতবাদের দিক থেকে বর্তমান যুবসমাজ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটি আমার কথা নয়। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, পুরো পৃথিবীর যুবসমাজ গণতন্ত্রর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। সে কারণেই হয়তো তারা স্বৈরতন্ত্র বা সামরিকতন্ত্রর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না। অবশ্য এ জরিপ শুধু উন্নত বিশ্বের যুবসমাজের উপর নেওয়া। আমরা যারা উন্নয়নশীল বিশ্বে বাস করছি, তাদের ক্ষেত্রে জরিপের এ ফল একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

আমাদের এ প্রজন্মর শিক্ষাথীদের দেখেছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে শান্ত অহিংস আন্দোলন– দেখেছি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। এ সকল আন্দোলন সফল হয়েছে। এখন নিজ বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে হেফাজত-প্রভাবিত ও জিপিএ ফাইভ-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা কি প্রতিহত করতে পারবে আমাদের মিলেনিয়াম প্রজন্ম?