‘নীল গ্রহটির মালামা’

নাসরীন মুস্তাফা
Published : 22 Jan 2017, 05:16 AM
Updated : 22 Jan 2017, 05:16 AM

বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী পল নিকলেন উত্তর মেরু অঞ্চলে ছুটে বেড়ান ক্যামেরা হাতে, ক্যামেরার চোখ দিয়ে খুঁজে ফেরেন সেখানকার বরফঢাকা প্রকৃতির অসাধারণ সব দৃশ্য। নিজের সম্পর্কে বলেন না, লেখেনও না; কেননা ছবি তোলা ছাড়া আর কোনো কাজ তাঁর নেই– এমনটিই বিশ্বাস করেন তিনি। জীবন শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী হিসেবে, বিজ্ঞান গবেষণার স্বার্থেই ক্যামেরায় চোখ দিয়েছিলেন। সেই তিনি সম্প্রতি কলম হাতে নিয়েছেন। কেননা, এবার কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করেছেন তিনি।

পল নিকলেন লিখেছেন, "গত ৪০ বছর ধরে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি, শিশু অবস্থায় যাত্রা শুরু করেছিলাম, কানাডার বাফিন দ্বীপের ইনুইট কম্যুনিটির একজন হিসেবে শিখেছিলাম পরিবেশের মাঝে কেবল টিকে থাকাই কাজের কথা নয়, সফলও হতে হবে। মেরু যে প্রতিদান দিচ্ছে, তাকে ভালবাসতে হবে।… পরবর্তী কালে বিজ্ঞানী হিসেবে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য তথ্যউপাত্তগুলো কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি। যখন আমি 'সি লিগাসি' আর 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক' ম্যাগাজিনের জন্য মেরু অঞ্চলভিত্তিক আলোকচিত্রী হলাম, তখনই আমি মানবতার মঙ্গলের জন্য এখানকার ভঙ্গুর বাস্তু রক্ষার জন্য সত্যিকারের আকুতি জানানোর পথ পেলাম।"

পল নিকলেন বলছেন, উত্তর মেরুর অবস্থা নাকি ভয়াবহ। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন সে অবস্থা। পৃথিবীর কোথাও এত দ্রুত গতিতে তাপমাত্রা বাড়ছে না, যতটা বাড়ছে এখানে, প্রায় দ্বিগুণ হারে! আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি এই পরিবর্তনকে ক্যামেরায় ধরেছেন, তাতে দেখা গেছে, বরফ সত্যিই গলছে, বরফের অসহায় বাসিন্দারা বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে শহরের ভিত্তি ডুবে যাচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার টেবিলে যত ঝড় উঠুক না কেন, সত্যিকারের ভূমিকা রাখতে পল নিকলেনের তোলা ছবিগুলো উদ্বুদ্ধ করতে পারে, যদি কেউ সত্যিই মানবতার খাতিরে উদ্বুদ্ধ হতে চায়।

পল নিকলেন লিখছেন, "প্রেসিডেন্ট ওবামার নেতৃত্বগুণে আমরা এক ধাপ এগিয়েছি।"

সদ্যসাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ভবিষ্যতের তেল-গ্যাস সন্ধানে আমেরিকার 'অভিযান' থেকে উত্তর মেরুকে সুংরক্ষিত করার জন্য সুকঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যা কিছুই হোক না কেন, কখনও উত্তর মেরুতে কোনো অভিযান চলবে না। বরং এখানকার তেল-গ্যাস যেন বরফায়িত অবস্থাতেই থাকে, সে জন্য চেষ্টা চলবে। এর ফলে উত্তর মেরুর প্রায় ১২৫ মিলিয়ন একর এলাকা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানমুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হবে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে এখানকার তেল-গ্যাসের বরফ অবস্থা।

২০৫০ সাল নাগাদ উত্তর মেরুর বরফ পুরোপুরি উবে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। বেচারা ওয়ালরাস, মেরু ভল্লুক, ধনুক মাথার তিমি, ডানাওয়ালা তিমি, চশমাপরা ইডারদের জন্য এটা অবশ্যই সুখবর। পল নিকলেন উত্তর মেরুর সব বাসিন্দার পক্ষ থেকে ওবামাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এই পদক্ষেপ আর পেছনে হটবে না বলে আশাবাদী তিনি।

পল নিকলেনের মতোই আনন্দিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন সাগর-অভিযাত্রী নাইনোয়া থম্পসন, তিনি ওবামাকে বলছেন:

"আমাদের নীল গ্রহটির মালামা।"

হাওয়াইন শব্দ 'মালামা'; এর অর্থ 'যত্নবান', 'রক্ষক', 'কাজের জন্য সম্মানিত' ইত্যাদি।

উত্তর মেরুর সুরক্ষা মানে গোটা পৃথিবীর সুরক্ষা– এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শেষ দিনগুলোতে সত্যিকারের ভালো একটি কাজ ওবামা করতে পেরেছেন। তাঁর আদেশের বলে হাওয়াইয়ের উত্তর উপকূলের পাপাহানামোককিয়া মেরিন ন্যাশনাল স্যাংকচুয়ারির আয়তন আরও বাড়ছে, এখানে গড়ে উঠছে প্রাকৃতিক গবেষণাগার। ফলে সমুদ্রের এই অঞ্চল উত্তর মেরুর সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।

হাওয়াইতে জন্মগ্রহণ করা নাইনোয়া থম্পসন সমুদ্রপথে ভেসে বেড়ানো জীবনে যে সূর্য-চাঁদ-নক্ষত্রের সাহায্যে পথ খুঁজে ফিরেছেন, পলিনেশিয়ান ঐতিহ্যে সমুদ্রপথ খুঁজে বেড়ানোর শত বছরের পুরনো অভ্যাস তাঁর মজ্জাগত, সেসব কিছুর উল্লেখ করে ওবামাকে নিজের ভাষায় 'মালামা' না বলে আর পারেননি তিনি।

নাইনোয়ার পূর্বপুরুষরা বহু বছর আগে শিখেছিলেন, যদি তারা তাদের ডিঙি নৌকা আর একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখেন, তাহলেই কেবল সাফল্যের সঙ্গে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। দ্বীপে থাকা আর ডিঙি নৌকাতে থাকা, একে অন্যের প্রতি যত্নবান হওয়া, নিজেদের সম্পদের সুরক্ষা করার শিক্ষা তাদের সংস্কৃতিগত বিষয়। আর তাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করা তাদের ঐতিহ্য।

নাইনোয়ার মনে হয়েছে, এই এক শিক্ষা নিয়ে পৃথিবী রক্ষায় হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। পৃথিবীর বহু সমুদ্র তিনি ঘুরেছেন, বন্দরে বন্দরে ভিড়েছে তাঁর জাহাজ, দেখেছেন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব কীভাবে গিলে ফেলতে চাইছে নীল গ্রহটিকে। ওবামা একুশ শতকের সবচেয়ে বড় এই চ্যালেঞ্জ সামলানোর যাত্রাপথে সুযোগ্য ক্যাপ্টেনের মতো পৃথিবীবাসীকে পথনির্দেশনা দিয়ে গেলেন।

হাওয়াইয়ের হনুলুলুতে গত ১ সেপ্টেম্বর 'ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন কংগ্রেস'-এ প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছিলেন:

"আমার মা-বাবা যেখানে সাক্ষাৎ করেছিলেন, সম্ভবত এখান থেকে কয়েক শ গজ দূরে… এখান থেকে প্রায় এক মাইল দূরের স্কুলে আমি গিয়েছি। আসলে প্রায় এক মাইল দূরেই আমি জন্মেছিলাম। আমার নানী আর নানা এখান থেকে অল্প দূরত্বেই তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। আর আমার বড় সন্তান মালিয়া যখন জন্ম নিল, তখন থেকে গত ১৮ বছর প্রতি বড়দিনে ওদের এখানে নিয়ে আসি আমি। ওরা যখন ওদের সন্তানদের নিয়ে আসবে, ওদের নাতিপুতিদের, তখন আমি নিশ্চিত ওরা এই দ্বীপ– প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ শুধু নয়– প্রতিটি দ্বীপের বিস্ময় আর সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে।"

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে 'মালামা' চীনে যখন গেলেন, সেই সেপ্টেম্বরেই, তখন কী হল? জি-২০ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছেন, তার অন্যতম ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। দুদেশ মিলে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের হার শতকরা ৪০ ভাগ কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন ওবামা। এর ফলেই ত্বরান্বিত হয় প্যারিস চুক্তির সঙ্গে আমেরিকার আর চীনের একাত্মতা প্রকাশ করা। কার্বন নিঃসরণকারী ৫৫টি দেশ মিলে এই হার শতকরা ৫৫ ভাগ কমিয়ে ফেলার আশা নিয়েই কিন্তু প্যারিস চুক্তিকে আইনে পরিণত করা হয়েছে গত ৪ নভেম্বর। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এতটুকু যে করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে এত কাল সন্দেহ কি ছিল না? ছিল।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমেরিকার ইতিবাচক ভূমিকা রাখার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ওবামা যত উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা এর আগে আর হয়নি। কার্বন নিঃসরণের হার কমিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে আমেরিকান সম্মতি মিলেছিল (২০১৬ সালে আমেরিকার জ্বালানী খাত যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে তা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি আইনে পরিণত হতে পেরেছিল, আমেরিকান সম্মতির কারণেই চীনের মতো বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশকেও সম্মত হতে হয়েছিল পৃথিবীর স্বার্থে।

আমেরিকা যদি এসব কিছু থেকে সরে আসে, উল্টো রথে চড়ে আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত হতে হবে পৃথিবীকে– এ সত্য এড়ানোর কোনো উপায় নেই।

আমেরিকা কি সরে আসবে? নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বার বার কিন্তু বলছেন, প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেবেন তিনি। স্টেট সেক্রেটারি হিসেবে ট্রাম্প মনোনিত করেছেন এক্সন মোবিল কোম্পানির সিইও রেক্স টিলারসনকে। জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী যতই সোচ্চার হোক না কেন, ট্রাম্প আর টিলারসন জুটি সেই আওয়াজ কানে নেবেন কি না, সে সন্দেহ এখন সবার মনে।

উত্তর আমেরিকার নিরীহ বাসিন্দারা এত কিছু টের পাচ্ছে না। তবে দ্রুত গলে যাওয়া বরফের তাপ মানুষের চেয়ে ওরা বেশি টের পাচ্ছে– এ কিন্তু সত্য। চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার মুখে পড়ে যাওয়া এই এদের সঙ্গে সবার বিপর্যয় এক হয়ে গেছে বলেই বলছি–

আমাদের এই নীল গ্রহটির প্রিয় 'মালামা', আপনাকে আমাদের মনে থাকবে।