প্রাচ্য-প্রতীচীর পথে-প্রান্তরে: উত্তর কোরিয়া সীমান্তে

শোয়েব সাঈদ
Published : 9 Jan 2017, 11:05 AM
Updated : 9 Jan 2017, 11:05 AM

বহুজাতিক কর্পোরেটে সাধারনত তিন ধরনের কর্মকর্তাদের দৌড়ের উপর থাকতে হয়। টপ ম্যনেজমেন্ট, সেলস এবং মার্কেটিং অর্থাৎ বাজার-ব্যবস্থাপনা যারা দেখভাল করেন আর টেকনিক্যাল সাপোর্ট অর্থাৎ যারা পণ্যটির শ্রেষ্ঠত্বের পেছনের কারিগরি জ্ঞান বা গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ধারণ এবং ব্যাখ্যা করেন। যোগ্যতমের উর্ধ্বতনের এই পুঁজিবাদী বৈশ্বিক আবহে স্ট্রেস ছাড়াও এই দৌড়ের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, ছুটে বেড়ানো বা পেশাগত ভ্রমণ বা বিজ-ট্রিপ। গত দেড় যুগ ধরে বহুজাতিক কর্পোরেট রুটি-রুজির অবলম্বন হওয়ার কারণে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে প্রচুর পেশাগত ভ্রমণে আর ছুটতে হচ্ছে প্রশান্ত আর আটলান্টিকের এপার-ওপার উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা, ইউরোপ আর এশিয়ার অসংখ্য লোকালয়ে। এই ছুটে চলাটা দূর থেকে 'আহা, কী মজার' মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু এই মজাটা দায়-দায়িত্ব আর পেশাদারিত্বের স্ট্রেসে বিলীন হয়ে যায়।

হোয়াইট সুপ্রিমেসির প্রমাণবিহীন অথচ পদে পদে অনুধাবনযোগ্য পশ্চিমা কর্মপরিবেশে বাদামি চামড়াওয়ালারা একটু বেশি 'বেচারা'। সাদাদের সুপ্রিমেসির তথাকথিত জন্মগত অধিকারের নীরব কূট-কৌশল, কালোদের আদায় করে নেবার সক্ষমতার মাঝে নিরীহ বাদামি চামড়াওয়ালাদের জন্যে প্রতিযোগিতার হার্ডল রেসের গার্ডটি একটু উঁচুতেই থাকে। ফলে ডিঙ্গাতে গিয়ে স্ট্রেসের মাত্রাটাও বেশি। মাঝে মাঝে সুযোগ-সাপেক্ষে চেষ্টা করি স্ট্রেসটা যতটুকু সম্ভব রিলিজ করে দিতে। বিজ-ট্রিপের মাঝে সাপ্তাহিক ছুটি পড়লে এমনিতেই সুযোগটা তৈরি হয়ে যায়।

বৈশ্বিক রাজনীতি আর ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুতে বরাবরই অনুরাগ। সেই অনুরাগের পরিচর্চায় বিজ-ট্রিপের মাঝেও নিজের মতো করে কিছুটা সময় বের করার চেষ্টা করি।

টোকিও এবং জাপানের অন্যান্য শহরে নভেম্বর ২০১৬এর তৃতীয় সপ্তাহের পুরোটাই অতিবাহিত হল পেশাগত ব্যস্ততায়। শনি-রবিবারের বিরতির পরের সোমবার থেকে আবারও ব্যস্ততা কোরিয়ার সিউলে। সিউলের ব্যস্ততা শেষে মাইসিটি মন্ট্রিয়লে দুদিন থেকে দু-সপ্তাহের জন্যে আবার ইউরোপে। ভাবছিলাম শুক্রবার রাতেই টোকিওর হানেদা থেকে সিউলের জিম্পো এয়ারপোর্টে ফ্লাই করব। হানেদা আর জিম্পো যথাক্রমে টোকিও আর সিউল মেট্রোপলিটনের নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট। অন্যদিকে নারিতা আর ইনচিয়ন যথাক্রমে টোকিও আর সিউলের দূরবর্তী এয়ারপোর্ট।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক ছোট বোন/আরেক বড় ভাই জুটি/দম্পতির অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে থেকে টোকিওতে আসার কথা শুক্রবার রাতে। টোকিওতে তাদের সাথে আড্ডা দেবার লোভ সামলাতে পারিনি, তাই সিউলে ফ্লাই করলাম শনিবারে। জিম্পো এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে ফিরবার অভিজ্ঞতাটা কিন্তু ছিল একটু বেশি বিপদজনক। ট্যাক্সি ড্রাইভার সিউলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া হান নদী আর সারি সারি স্কাইক্রেপারের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মাল্টিলেনের হাইওয়ে দিয়ে ট্যাক্সি চালাচ্ছিলেন ঘণ্টায় ১৪০-১৫০ কিমি গতিতে।

স্পিড লিমিট ৮০ কিলোমিটারের বদলে প্রায় ডাবল গতিতে ছুটে চলায় বিরক্ত হয়ে মোটরযানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রমাগত সতর্কসংকেত বাজিয়েই যাচ্ছিল। বামে ডানে লেন বদল করে ছুটে চলতে পছন্দ করা এই ড্রাইভার কোনো কিছুই পাত্তা দিচ্ছিল না, এমনকি আমার আপত্তিও। পুলিশের হাতে ধরা খেলে লাইসেন্স সিজ হয়ে যাবে জেনেও যেভাবে চালাচ্ছিল, এরকম বিপদজনক ট্যাক্সি ড্রাইভারের দেখা পাওয়া বিরল অভিজ্ঞতাই বটে। আমি নিজেও পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করে ড্রাইভারকে ঝামেলায় ফেলতে পারতাম কিন্তু শেষতক ড্রাইভারের আমায়িক ব্যবহারে কমপ্লেইন করা হয়ে উঠেনি।

আগে থেকেই পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা করা ছিল রবিবারটা কাটাব বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক এলাকা উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্তে। রোববার সকালেই সিউলের স্যামসং এলাকায় অবস্থিত হোটেল থেকে ট্যাক্সি ক্যাবে সেন্ট্রাল সিউলের সিউল সিটিহলের পাশে প্রেসিডেন্ট হোটেল এসে পৌঁছুলাম। না, এবারের ট্যাক্সি ড্রাইভারের মধ্যে অস্বাভাবিকতা ছিল না। প্রেসিডেন্ট হোটেল থেকে নির্দিষ্ট বাসে করে যেতে হবে উত্তর কোরিয়া সীমান্তে।

সিউল শহরের অন্যতম আকর্ষণ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া হান নদী আর তার উপর তৈরি করা অসংখ্য সেতু। সিউল ক্যাপিটাল এলাকায় হান নদীর উপর দৃষ্টিনন্দন মোট ২৭টি সেতু আছে। ৪৯৪ কিমি দীর্ঘ হান নদী রাজধানী সিউলের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত বরাবর গিয়ে রিমজিন নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পীত সাগরে (ইয়েলো সী) পতিত হয়। বাস দিয়ে উত্তর কোরিয়া সীমান্তে যাবার সময় একটি পয়েন্টে দক্ষিণ আর উত্তর কোরিয়ার বিভক্তিটা কেবলি হান নদীর এপার আর ওপার। বাস থেকে নদীর অপর পাড়ে উত্তর কোরিয়ার গ্রাম আর শহুরে স্থাপনাগুলো সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানী আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত আর অপমানিত কোরিয়ান জাতিগোষ্ঠীর উত্তর-দক্ষিণ নয়, শুধুমাত্র কোরিয়া পরিচয়েই বিশ্বমানচিত্রে পরিচিত হবার কথা ছিল। কিন্তু কুটিল বিশ্ব রাজনীতির ঘটনা পরিক্রমায় যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েতের স্নায়ুযুদ্ধের প্রথম বলি হল কোরিয়া। একত্রে থাকার বদলে ৩৮তম সমান্তরাল রেখা বরাবর বিভক্ত হল উত্তর আর দক্ষিণে। উত্তরের মুরব্বী সোভিয়েত আর দক্ষিণের মুরব্বী যুক্তরাষ্ট্র।

দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিনিদের পুঁজিবাদী আদর্শের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ আগস্ট। উত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় কম্যুনিস্ট সরকার। ৩৮তম সমান্তরাল রেখা কোরীয় রাষ্ট্রটিকে ভূখণ্ডগতভাবে বিভাজিত করে সম্প্রীতি আনবার বদলে ক্রমাগত রাজনৈতিক আর সামরিক বৈরিতা তৈরি করল। কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলোচনার জন্য যোগাযোগ চলতে থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৫০ সালের জুন মাস থেকে ১৯৫৩ সালের জুলাই পর্যন্ত উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধ কোরিয়ান যুদ্ধ নামে পরিচিত।

আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তার জন্যে আন্তর্জাতিক তিন লাখ একচল্লিশ হাজার সৈন্যের ৮৮ শতাংশই মার্কিনিরা প্রদান করে এবং এখন পর্যন্ত নিরাপত্তার দিতে মার্কিন সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করছে। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি অনুসারে দুই কোরীয়ার মাঝখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বাফার জোন যা ডিমিলিটারাইজড জোন বা সংক্ষেপে ডিএমজি নামে অধিক পরিচিত। স্নায়ুযুদ্ধের চড়া মাশুল কিন্তু এখনো দুই কোরিয়ার সীমান্তবাসীদের গুনতে হচ্ছে। ডিমিলিটারাইজড জোনে ঘুরতে এসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের অনেক ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হল। সমসাময়িক বিশ্বে ট্রাম্প আর পুতিনের সম্পর্ক যতই মধুর হউক না কেন, তাতে একদা আড়াল হয়ে যাওয়া স্নায়ুযুদ্ধের ক্রমশ জেগে উঠা রোধ হবে কিনা বলা মুশকিল।

চমৎকার আবহাওয়ার সৌজন্যে ডিএমজি এলাকা ভ্রমণে একধরণের স্বস্তি ছিল। উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে ২৪১ কিমি লম্বা, ৪ কিমি প্রশস্ত ডিমিলিটারাইজড জোন কার্যকরী হয় কোরিয়া যুদ্ধের পরপর ১৯৫৩ সালে। এর পর থেকে মানুষের চলাফেরা না থাকায় এটি এখন বিশ্বের অন্যতম ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম, প্রাণীদের অভয়ারণ্যে। পরিবেশগতভাবে ইউনিক এই ডিএমজি। মনুষ্য বসবাসের ৫ হাজার বছরের ইতিহাসের পর হঠাৎ করেই বিশাল এলাকা জুড়ে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার ৬০ বছরে ব্যবধানে এখন জীববৈচিত্রের স্বপ্নপুরীই বটে। হিসেব মতে ১১০০ প্রজাতির উদ্ভিদ আর ম্যামালের বসবাস এই অভয়ারণ্যে। যুদ্ধ আর সীমান্ত সংঘর্ষে চল্লিশ লক্ষ মানুষের হতাহতের জন্যে কুখ্যাত এই ডিএমজি এলাকায় হাজার হাজার মাইন পাতানো রয়েছে। প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় মাইন বিস্ফোরণে এখন মানুষ না মরলেও সবুজে সবুজে সয়লাব এই অভয়ারণ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে মধ্যেই মাইনের আঘাতে জীবন হারাতে হয়। বিলিয়ন ডলারের মাইন অপসারণ প্রকল্প ঝুলে আছে উভয় পক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে।

ডিএমজিতে যাবার পথে প্রথম যাত্রা বিরতিটি হয় ফ্রিডোম সেতু এলাকায়। ইমজিনগাক এলাকাটির সঙ্গে কোরিয়ানদের অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে। কোরিয়ার বিভক্তি যেভাবে অনেক পরিবারকে, ভাই-বোনদের, স্বামী-স্ত্রীদের, সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করেছে একে অপর থেকে তার যন্ত্রণাটুকু জানা যায় হাতে লিখে ঝুলিয়ে রাখা আবেগঘন অসংখ্য চিঠি থেকে। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই সেতুটি খুলে দেওয়া হয়। কোরিয়া যুদ্ধের অনেক স্মৃতি এই সেতু ঘিরে। দক্ষিণ কোরিয়ার পান্মুঞ্জম থেকে উত্তর কোরিয়া যাবার সড়ক আর রেল-যোগাযোগের ঐতিহাসিক সাইট এটি। ১৯৯৮ সালে ইউনিফিকেশন ব্রিজ তৈরি হবার পূর্ব পর্যন্ত এটি ছিল উত্তর কোরিয়ার সাথে যোগাযোগের মূল পয়েন্ট।

ফ্রিডম ব্রিজ এলাকাটি খুব জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট। কাঠের উচু টাওয়ার ডেক থেকে উত্তর কোরিয়ার গ্রামগুলো দেখা যায়। কোরিয়া যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি বাস্পচালিত রেল ইঞ্জিন হাজার খানেক বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় সাক্ষ্য হয়ে আছে কোরিয়া-বিভক্তির নির্মম ইতিহাসের। বিংশ শতাব্দী প্রত্যক্ষ করেছে কোরিয়ার বিভক্তি আর একবিংশ শতাব্দীর প্রত্যাশা বিভক্ত কোরিয়ার সংযুক্তি। দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী প্রদেশ কিয়ংগীর যে জায়গার বিভক্ত হয়েছিল উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়া। ঠিক সেখানে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জানুয়ারি ২০০০ সালে কিয়ংগীর প্রায় এককোটি জনগনের ঐক্যবদ্ধ কোরিয়ার প্রত্যাশায় আর প্রার্থনায় স্থাপিত হয় ২১ টন ওজনের পিসবেল। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রকাশ করা হয় সংযুক্তির আকুতি।

ইউনিফিকেশন ব্রিজের কথা আগেই বলেছি। সামরিক বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর এই ব্রিজটিতে যেন যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। আমেরিকান সেনাদের ক্যাম্পও এই ব্রিজের নিকটে। ব্রিজটির আরেকটি নাম হচ্ছে কাউ ব্রিজ যার উদ্বোধনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১০০১টি গরুর উত্তর কোরিয়া যাত্রা। ব্রিজটি তৈরির পেছনে ইতিহাসটি হতদরিদ্র থেকে বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের বনে যাওয়া একজন জাতীয়তাবাদী এন্টারপ্রিনিউরের দেশপ্রেমের উপাখ্যান।

হুন্দাই কোম্পানি এখন কমবেশি সব দেশেই পরিচিত। হুন্দাই আর কিয়া গাড়ি বিশ্বে কোরিয়াকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। হুন্দাইএর প্রতিষ্ঠাতা চুংগ-জু-ইয়ংগ ১৯১৫ সালে জন্ম নেন যে গ্রামে সেটি এখন উত্তর কোরিয়ার অংশ। সাত সন্তানের একটি খুবই দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে চুংগএর স্বপ্ন ছিল স্কুলশিক্ষক হওয়া। পরিবারটির মূল সম্বল ছিল কয়েকটি গরু। চুংগ কয়েকবারই বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন এবং একবার বাবার একটি গরু চুরি করেন পালানোর হাত খরচ যোগাবার জন্যে। দারিদ্র্যতার সঙ্গে পরিবারটির লড়াই করবার উপাখ্যান আর গরু চুরির কথা চুংগ ভুলেননি আমৃত্যু।

কোরিয়ার বিভক্তি আর উত্তর কোরিয়াস্থ নিজ গ্রামের দারিদ্রতায় বরাবরই বিচলিত ছিলেন চুংগ। অনেক পরিশ্রম, ব্যর্থতা, সফলতার পর অবশেষে জাপানি আগ্রাসনের অবসানে ১৯৪৬এর দিকে প্রতিষ্ঠা করেন হুন্দাই। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর বড় বড় কন্ট্রাক্টগুলো অর্জন করার সক্ষমতা হুন্দাইকে নিয়ে যায় সাফল্যের শীর্ষে।

দুই কোরিয়ার সংযুক্তির মায়াবী স্বপ্নে জীবন সায়াহ্নেও বিভোর ছিলেন চুংগ। ১৯৯৮ সালে নিজ খরচে ডিমিলিটারাইজড জোনে তৈরি করেন স্বপ্নের সেতু ইউনিফিকেশন ব্রিজ। চার লেনের এই সেতুটি দুই কোরিয়ার সেতুবন্ধন; কী ব্যবসায়িক, কী আত্মিক। সেতুটি উদ্বোধনের পর পর হুন্দাইয়ের কিছু দামি গাড়ি আর ১০০১ টি গরুর বহর নিয়ে চুংগ যান উত্তর কোরিয়ার, দেখা করেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জংগের সঙ্গে। উত্তর কোরিয়াকে ১০০১টি গরু উপহার দেবার পেছনে তার বাল্যকালের সেই গরু চুরির ঘটনাটি ঋণ শোধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

ডিএমজি এলাকায় দুই কোরিয়ার মধ্যকার উত্তেজনার অন্যতম কারণ হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার গোপনে ভূগর্ভস্থ টানেল তৈরি করে দক্ষিণ কোরিয়ায় আগ্রাসন চালানোর প্রচেষ্টা। এই পর্যন্ত চারটি টানেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সব টানেল খুঁজে বের করা খুব সহজসাধ্য নয়। ভূগর্ভে পাইপ ঢুকিয়ে চাপ তারতম্যের মাধ্যমে ফাঁকা প্যাসেজ খুঁজে বের করা হয়। চারটি টানেলের অন্যতম হচ্ছে তৃতীয়টি। পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর সীমান্তের এই অংশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই কঠোর। অনুমতিসাপেক্ষে, বিশেষ ব্যবস্থায় ডিমিলিটারাইজড জোনের এই অংশে প্রবেশ করা যায়। ব্যক্তিগত যানবাহনের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

তৃতীয় টানেলটি দক্ষিণ কোরিয়ার নজরে আসে ১৯৭৮ সালের অক্টোবরে। তৃতীয়টি দ্বিতীয়টির অনুরূপ কাঠামোতে তৈরি। টানেলটি ১.৬৩৫ কিমি লম্বা ১.৯৫ মিটার উচ্চ আর ২.১ মিটার প্রশস্ত। টানেলটি মাটির ৭৩ মিটার নিচ দিয়ে উত্তর কোরিয়া থেকে ডিমিলিটারাইজড জোনের দক্ষিণ কোরিয়ার অংশে ৪৩৫ মিটার পর্যন্ত প্রবেশ করে। টানেলটি দিয়ে অস্ত্রসমেত একটি পুরো ডিভিশনকে এক ঘণ্টায় মোবিলাইজ করা সম্ভব। দক্ষিণ কোরিয়ার দাবি, সিউলে অকস্মাৎ আক্রমণের জন্যে এই টানেল তৈরি করেছিল উত্তর কোরিয়া।

কয়লা খনিতে প্রবেশ করার কায়দায় রেলট্রলিতে টানেলের ভেতর যাওয়া যায়। হেলমেট পড়ে নিচু হয়ে টানেলের ভেতরে স্যাঁতস্যাঁতে প্যাসেজে হাঁটতে হয়। জায়গায় জায়গায় ডিনামাইটের বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট গর্তগুলো চিহ্নিত করা আছে হলুদ সার্কেল দিয়ে। পাইপ ঢুকিয়ে যে জায়গা ভেদ করে এই টানেল সম্পর্কে প্রথমে ধারণা পাওয়া যায় সেই স্থানও সংরক্ষণ করা আছে। টানেলটিসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর সামরিক স্থাপনাগুলোর ক্ষেত্রে ছবি তোলার অনুমতি নেই। উত্তর কোরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি টানেলটির মাঝে কংক্রিটের অনেকগুলো দেওয়াল তুলে সিল করা আছে। দর্শনার্থীদের একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ দূরত্ব পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়। তৃতীয় টানেল এলাকায় একটি বিশেষ শিল্পকর্ম দৃষ্টিনন্দন। দ্বিখণ্ডিত গ্লোবটি জোড়া লাগাতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা সাধারণ কোরিয়ানদের হৃদয়ের আকুতির সাবলীল প্রকাশই বটে।

ডিমিলিটারাইজড জোনে ডোরা অবজারভেটরি থেকে উত্তর কোরিয়ার অন্যতম বড় শহর গেসুংগ দেখা যায়। এলাকাটি 'প্রোপাগান্ডা গ্রাম' হিসেবে অধিক পরিচিত। উত্তর কোরিয়ার গ্রামগুলো থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যদের প্রভাবিত করতে উচ্চস্বরে গান বাজানো প্রোপাগান্ডার প্রধান হাতিয়ার। সৈন্যদের প্রভাবিত করতে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে তেমন প্রচারণা ছিল না। তবে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া এটি শুরু করেছে। উচ্চপ্রযুক্তির মাধ্যমে মাইলের পর মাইল বিশাল এলাকাজুড়ে উচ্চস্বরে গান বাজানোতে দক্ষিণ কোরিয়া অনেকটাই এগিয়ে আছে উত্তর কোরিয়ার চেয়ে।

আমার এক দক্ষিণ কোরিয়ান সহকর্মী বলছিলেন, তিনি যখন বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিসে অংশ নিতে প্রশিক্ষণ শেষ করে সীমান্তে নিয়োগ পান, প্রথম দিনেই উত্তর কোরিয়ার প্রোপাগান্ডা প্রান্ত থেকে তাঁর নাম-ঠিকানা উল্ল্যেখ করে অভিনন্দন জানানোর ঘটনায় ভড়কে যান। এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় উত্তর কোরিয়ার ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সক্ষমতা।

ডিএমজি এলাকায় আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে অত্যাধুনিক ডোরাসান রেল স্টেশন। স্টেশনটি কিয়নগুই লাইনে উত্তর কোরিয়া সীমান্তবর্তী। সুসম্পর্ক সাপেক্ষে সিউল আর পিয়ংইয়ন এর মধ্যকার সরাসরি রেল-যোগাযোগের আশা বাঁচিয়ে রাখছে স্টেশনটি। স্টেশনটির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। কোরিয়ার উপদ্বীপের সঙ্গে চীন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া ফেডারেশন আর ইউরোপের স্থল-যোগাযোগের আকর্ষণীয় রুট হচ্ছে এই রেলপথ।