এক টুকরো বাংলাদেশ, সিডনী ক্রিকেট গ্রাউন্ডে

শামারুহ মির্জা
Published : 5 Jan 2012, 02:43 PM
Updated : 5 Jan 2012, 02:43 PM

৩রা জানুয়ারি, ২০১২ সাল। সিডনী ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১০০ তম টেস্ট ম্যাচ শুরু হোলো, ইন্ডিয়া আর অস্ট্রেলিয়ায় মধ্যে। প্রচণ্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠছে। তারপরেও তুমুল উত্তেজনা, এর মধ্যেই ইন্ডিয়ার ৪ টা উইকেট পড়ে গেছে ! হঠাৎ এক মুঠো বাংলাদেশ যেন জেগে উঠলো গ্যালারীতে। কিছু প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ পড়েছে দাঁড়িয়ে ! হাতে ব্যানার: " No Indian Dam @ Tipai, Save Bangladesh". মোক্ষম শ্লোগান, ছোট্ট পরিসরে উঠে আসলো পুরো জাতির আবেগ। ছেলেমেয়েগুলোর মুখ উত্তেজনায় উদ্ভাসিত, আর পাশের দর্শকরা শ্রদ্ধায় নত।

এই ছেলেমেয়েগুলোর কোনও রাজনৈতিক পরিচয় নেই, দেশ আমাকে কী দিলো, তার কোনো হিসেব কখনও করে নি এরা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে, মুখে কিছু গুজে দিয়েই ক্লাসে দৌড়ায়, ক্লাস থেকে সরাসরি সুপার মার্কেট কিংবা পেট্রোল পাম্পে, কাজে। বাসায় ফিরে কিছু একটা রান্না করেই কম্পিউটার খোলে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ঘোরাফেরা। উপলব্ধি করে, দেশটা বোধ হয় হাতছাড়া হয়েই গেলো (পাঠক! এ যুগে দেশ হাতছাড়া অন্যভাবে হয়, তা আপনারা জানেন)। এদেরই কেউ কেউ ক্রিকেটে ইন্ডিয়ার দারুণ সমর্থক, টেন্ডুলকারের বিশাল পোস্টার ছোট্ট ঘরটার দেওয়ালে। এরা সবাই ছিল মাঠে। কষ্টার্জিত ডলার দিয়ে কাগজ, পেইন্ট আর ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের টিকেট কিনে হাজির হোলো মাঠে। তীব্র রোদ আর প্রচণ্ড গরমে মুখগুলো সব শুকিয়ে গিয়েছিলো। তাতে কী হয়েছে? হৃদয়ে বাংলাদেশ। বুক ভরা সাহস নিয়ে এরা দেখিয়ে দিলো, তারুণ্যের তেজ। অস্ট্রেলিয়ানরা এসে প্রশ্ন করছিলো, জানতে চাচ্ছিল টিপাইমুখ কী? হচ্ছেটা কী সেখানে? কিছু ইন্ডিয়ান এগিয়ে এলো। জানলো আসাম, ত্রিপুরার মানুষগুলোর কষ্টের কথা, জানলো তাদের কতকালের সংগ্রামের কথা। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আসলে বাংলাদেশ বলুন, ইন্ডিয়া, কিংবা পাকিস্তান, সবখানে একই চিত্র। সাধারণ মানুষের কষ্টগুলোর একই রূপ, একই বেদনা সবার। ঠিক যেভাবে নেতাদের চেহারা এক, মুখোশটাও এক! শোষণের, ধোঁকাবাজির। জনতার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খায় এরা সকলেই।


টিপাইমুখের বাঁধ নিয়ে কত আলোচনা – বৈজ্ঞানিক, অবৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞানের কত শাখা থেকেই না এর বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। রীতিমতো বিতর্কের মঞ্চ; পক্ষে সরকারী দল, তার্কিক: ডক্টর রিজভী, জনাব সর্বজ্ঞ আরাফাত এবং জনাব পানি সম্পদ মন্ত্রী (সাধারণত তিনজনেই বিতর্কের একটি দল হয়, নতুবা পক্ষে প্রায় ৪০/৫০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা যেত!) বিপক্ষে বাংলাদেশের মানুষ। দুপক্ষের লেখাই পড়ছি, সেই সাথে ব্যারেজ, ড্যাম সম্পর্কে জানছি; বই পড়ে, বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন করে, বিশ্বের অন্যান্য ড্যাম কিংবা ব্যারেজ নির্মাণ পরবর্তী ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে। এ বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবে যতটুকু জেনেছি ও বুঝেছি, এই প্রজেক্টটিকে যুক্তি দিয়েও সমর্থনের কোনও সুযোগ নেই, সস্তা আবেগ তো অনেক পরের কথা! দেশে কিছু রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে কিছু কর্মসূচী নিয়েছে। যেমন, বিএনপি সিলেটে হরতাল করেছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছে, জাতীয় পার্টি ও কিছু ইসলামিক দল লং মার্চ করেছে, বামপন্থী দলগুলোর মানব বন্ধনও চোখে পড়েছে।

তবে একটা ব্যাপার আমাকে খুব অবাক করেছে। এই আন্দোলনে তরুণ সমাজের সম্পৃক্ততার অভাব। এমন কেন হোল? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে '৫২, '৬৯, '৭১ এবং '৯০ এই সাল কটিকে মাইলফলক বলা হয়, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। প্রতিটি আন্দোলনেই তরুণেরা ছিল সামনের সারিতে। স্বীকার করছি, সময় বদলে গিয়েছে, পৃথিবী বদলে গিয়েছে। পুঁজিবাদ আর ভোগবাদ এর প্রভাবে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি আর উত্তেজনার চেহারাটাও হয়ে গেছে রূপান্তরিত। কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার, অধিকার আদায়ের সংগ্রামের রূপ কি বদলে গিয়েছে? মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা – সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোর মূল চালিকা শক্তি – এখনও সে তারুণ্যই।

ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে অবশ্য এরা ঝড় তুলেছে, তবে তা কতটুকু কার্যকরী আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে চেঁচামিচি করে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটা খুব কঠিন না এবং এ সহজ কাজটা প্রায় শেষ, এখন দরকার ঐক্যবদ্ধ হয়ে, হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়ানোর।

শুধু কি টিপাইমুখ? ঘরে ফিরছে না অনেকেই। লাশ ভেসে উঠছে ধলেশ্বরীতে। তিতাসের কান্না বাতাসে। শেয়ারবাজারে সব হারিয়ে আত্মহত্যা করে তরুণটি। টেলিভিশনের পর্দা থেকে ইন্ডিয়ান ছবির নায়িকারা উঠে আসে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে। বড় দুঃসময়!

তবুও বিশ্বাস, ভোর হবেই। তরুণেরা যখন কোনও পরিবর্তনের জন্য এক হয়, সেই লক্ষ্য যদি সৎ এবং সঠিক হয়, সাফল্য অনিবার্য। ইতিহাস এবং বাস্তবতা তাই বলে। মধ্যপ্রাচ্যের উদাহরণ দেবো না। এই বাংলাদেশেই, বুয়েটে গত কয়েকদিনে দেখেছি তারুণ্যের উদ্দামতা, অসাধারণ সাহস দেখেছি, দেখেছি একতা, ন্যায়ের পক্ষে, সুবিচারের লক্ষ্যে, আবার আশাবাদী হয়ে উঠি আমি- এই নষ্ট, বিষণ্ণ সমাজে। তরুণেরাই ভাঙে, আবার গড়েও। তাই পুরো পৃথিবীর সামনে ভারতীয় ড্যামকে "না" বলে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই তরুণ মুখগুলো আমাকে আলোড়িত করে। বোধহয় "শেষ" এখনও হয় নি।

শেষ করছি প্রিয় হেলাল হাফিজের একটি কবিতা দিয়ে-

"মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই"।

শামারুহ মির্জা:শিক্ষক ও গবেষক।