নৃবিজ্ঞানী প্রফেসর শামসুল আরেফিন স্মরণে

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 29 Dec 2016, 07:10 AM
Updated : 29 Dec 2016, 07:10 AM

একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, স্বনামধন্য নৃবিজ্ঞানী, গুণী গবেষক এবং একজন চমৎকার মানুষ প্রফেসর হেলাল উদ্দিন খান শামসুল আরেফিন গত ২৪ ডিসেম্বর এ পৃথিবীর ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন এবং ২০১৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

কিন্তু বয়সের সীমারেখার নিয়মনীতির হিসাব-নিকাশে তিনি অবসর গ্রহণ করলেও কাজে, গবেষণায়, লেখালেখি এবং নতুন নতুন চিন্তাভাবনায় সত্যিকার অর্থে তাঁর কোনো অবসর ছিল না। তিনি ছিলেন সর্বদা কর্মব্যস্ত, নতুন নতুন চিন্তায় মগ্ন একজন আপাদমস্তক গবেষক এবং সৃজনশীল মানুষ।

একজন গবেষক হিসেবে, একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে, একজন রাজনীতি-সচেতন অধিকারকর্মী হিসেবে, একজন শিক্ষক হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে প্রফেসর আরেফিনকে নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে খণ্ড খণ্ড বই লেখা সম্ভব। কিন্তু এখানে আমি প্রফেসর আরেফিনের অপ্রত্যাশিত তিরোধানের স্মরণে তাঁর জীবনের কয়েকটি দিক অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরে পাঠকের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানীর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নিচ্ছি।

পরিচয়পর্ব ও আলোকিত পরিবার

প্রফেসর আরেফিন ১৯৪৮ সালে চাঁদপুরের কচুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে তিনি কানাডার মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে দ্বিতীয় মাস্টার্স করেন। তারপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর থেকেই দেশে ফিরে তিনি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন। নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসেবেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

প্রফেসর আরেফিন একজন মানুষ হিসেবে যে পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠেছেন, সে পারিবারিক আবহের যে 'আলোকায়িত পরিবেশ' (এনলাইটেন্ড এটমোসফেয়ার) তা নিয়েও লেখা যায় কয়েক দিস্তা কাগজ। কেননা, বাংলাদেশের আরেক সুপরিচিত এবং স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রফেসর আরেফিনের বড় ভাই। এক সময়কার বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এবং পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মহিউদ্দিন খান আলমগীর প্রফেসর আরেফিনের আরেক বড় ভাই। বাংলাদেশের আরেক স্বনামধন্য গবেষক এবং ঐতিহাসিক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন প্রফেসর আরেফিনের বড় ভাই জনাব মেজবাহ উদ্দিন খানের ছেলে।

জনাব মেজবাহ উদ্দিন খান চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসন থেকে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ প্রফেসর আরেফিনের পরিবারেরই সদস্য। প্রফেসর আরেফিনের এক বড় বোন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ন সচিব পদে অবসর গ্রহণ করেন। এ রকম অসংখ্য 'এনলাইটেন্ড' মানুষের যে পরিবার সে পরিবারেই প্রফেসর আরেফিনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। ফলে প্রফেসর আরেফিনের কাজে, চিন্তা, গবেষণা এবং লেখালেখিতে তার ছাপ স্পষ্ট ছিল।

বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞানের বিকাশ ও বিস্তার

প্রফেসর আরেফিন ছিলেন একজন সত্যিকার নৃবিজ্ঞানী। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক নৃবিজ্ঞান চর্চার সময় খুব বেশি দিনের নয়। আশির দশকের শেষের দিকে প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে নব্বই দশকের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয়। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নৃবিজ্ঞান চর্চা এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশে প্রফেসর আরেফিনের রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা এবং অসামান্য অবদান।

পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রফেসর আরেফিনের সক্রিয় ভূমিকা অব্যাহত থাকে। কখনও পরীক্ষা কমিটির বিশেষজ্ঞ হিসেবে, কখনও বিভিন্ন পরীক্ষার বহিঃপরীক্ষক হিসেবে, কখনও শিক্ষক নিয়োগ কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে আবার কখনও বা সিলেবাস প্রণয়ন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে প্রফেসর আরেফিনের সক্রিয় ভূমিকা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশে অসামান্য অবদান রাখে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং এর বিস্তারে প্রফেসর আরেফিন একইভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

এ ছাড়া শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজে নৃবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রফেসর আরেফিনের ছিল নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও নৃবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা, এবং কারিকুলাম তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এমনকি অবসর গ্রহণ করার পরও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে নিয়মিতভাবে নৃবিজ্ঞান পড়াতেন একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। এভাবেই বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের প্রথম জেনারেশনের একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায়, সক্রিয়তায় আমৃত্যু অসামান্য অবদান রাখেন।

একজন প্রকৃত নৃবিজ্ঞানী

নৃবিজ্ঞানী হিসেবে প্রফেসর আরেফিনকে বিচার করতে হলে এত ক্ষুদ্র পরিসরে অসম্ভব। সত্যিকার অর্থে এটা উনার প্রতি অবিচারও বটে। আমি এখানে নৃবিজ্ঞানী হিসেবে প্রফেসর আরেফিনের কেবলই পরিচয়-পর্ব সারতে চাই। অন্যান্য অসংখ্য কাজের বাইরে প্রফেসরে আরেফিনের চারটি গবেষণা বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের জগতে মাইলফলকের কাজ করেছে। এ চারটি গবেষণা/কাজ হচ্ছে:

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের উপর করা তাঁর এথনোগ্রাফি Changing Agrarian Structure in Bangladesh, Shimulia: A study of Peri-urban Village (১৯৮৬);

যৌনকর্মীদের নিয়ে তাঁর কাজ 'বাংলাদেশের পতিতা নারী';

বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ 'বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান' এবং

বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের 'বর্ণপ্রথা' নিয়ে কানাডার মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স থিসিস The Hindu Caste Model and the Muslim Systems of Stratification in Rural Bangladesh (১৯৭৭)।

'শিমুলিয়া' বাংলায় অনূদিত হওয়ার পর বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান চর্চায় এটি একটি 'অবশ্যপাঠ্য'-তে পরিণত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের কৃষি কাঠামোর পরিবর্তন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বিশেষ করে পরিবার, বিয়েব্যবস্থা, জ্ঞাতি সম্পর্ক, খানা (হাউজহোল্ড), বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রফেসর আরেফিনের 'শিমুলিয়া' একটি পাইয়োনিয়ারিং গবেষণা হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে পরিবর্তনশীল গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো উপলব্ধির জন্য প্রফেসর আরেফিনের এটি একটি বহুল উদ্ধৃত এথনোগ্রাফি হিসেবে নৃবিজ্ঞানের পঠনপাঠনের সীমানায় এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিস্তৃত পরিসরে সর্বজনগ্রাহ্য।

আশির দশকে যখন 'পতিতা' ধারণাটিই সমাজে অত্যন্ত সেনসিটিভ এবং সামাজিক কলঙ্ক (সোস্যাল স্টিগমা) নিয়ে উচ্চারিত হত, তখন প্রফেসর আরেফিন 'বাংলাদেশের পতিতা নারী' নিয়ে গবেষণা করে এ ক্ষেত্রে গবেষণার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন যে, সমাজে কেউ 'পতিতা' হয়ে জন্ম নেয় না, সমাজই একজন নারীকে 'পতিতা' করে তোলে, সমাজের বিদ্যমান অসম ব্যবস্থা একজন নারীকে 'পতিতা' বানিয়ে দেয়।

তাই শব্দ হিসেবে 'পতিতা' (যার অর্থ হচ্ছে কারো পতন হওয়া) যেমন আপত্তিজনক তেমনি 'পতিতা' নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও অন্যায্য। আশির দশকে বাংলাদেশের মতো একটা বিশেষ ধরনের সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজে 'পতিতা' নারী নিয়ে গবেষণা করা এবং তাদের সামাজিক মূল্যায়নের জন্য কাজ করা নিঃসন্দেহে ভিন্ন মর্যাদার দাবি রাখে।

এ ছাড়া 'বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান' শিরোনামে প্রফেসর আরেফিন সম্পাদিত গ্রন্থে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, নারীর অবস্থান এবং পরিবেশ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীরা কীভাবে কাজ করতে পারেন এবং এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক এবং পদ্ধতিগত সমস্যা ও সম্ভাবনা ক্রিটিক্যালি আলোচনা করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সত্যিকার অর্থে এ গ্রন্থ বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ নৃবিজ্ঞান চর্চার পথকে আরও বেগবান করেছে এবং নৃবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক এবং পদ্ধতিগত বিকাশে নতুনভাবে প্রণোদনা দিয়েছে। এভাবেই প্রফেসর আরফিন তার কাজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান চর্চা এবং প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখেন।

কানাডার মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা তাঁর মাস্টার্স থিসিস এখনও মুসলিম বর্ণব্যবস্থা অধ্যয়নে মৌলিক সূত্র (বেসিক রেফারেন্স) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কেননা, "মুসলিম সমাজে কোন বর্ণ প্রথা/ব্যবস্থা নেই"– এ রকম একটি বদ্ধমূল ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করে তাঁর গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি হিন্দু বর্ণপ্রথার মতো, ঠিক একই রকম ও ধরনের না হলেও, মুসলিম সমাজের যে বর্ণপ্রথা রয়েছে তার সবিস্তার ব্যাখ্যা করেন তাঁর থিসিসে। সারা পৃথিবীতে এ-সংক্রান্ত একাডেমিক লেখালেখির মৌলিক সূত্র হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।

প্রফেসর আরেফিনের এ রকম অসংখ্য লেখা নৃবিজ্ঞানের বিকাশ এবং বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং সে কারণেই প্রফেসর আরেফিন বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের জগতে একজন অন্যতম নৃবিজ্ঞানী।

অ্যাক্টিভিজম এবং আদিবাসীবান্ধব নৃবিজ্ঞানী

প্রফেসর আরেফিন শুধু একজন অ্যাকাডেমিক নৃবিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি সমাজের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে নানা অ্যাক্টিভিজমে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। রাস্তায় এসে মানুষের কাতারে হাজির হয়েছেন বৃহত্তর মানবতার ডাকে। নারীর অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকার, নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার, প্রান্তিক মানুষের অধিকার এবং আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আদিবাসী অধিকার ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। প্রতি বছর ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস'-এর অনুষ্ঠানে তিনি সবসময় উপস্থিত থাকতেন এবং আদিবাসীদের 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতির দাবির প্রতি সবসময় সহমত এবং সংহতি প্রকাশ করতেন।

তিনি বেদে সম্প্রদায়ের অধিকারের জন্য কাজ করেছেন। নারী অধিকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে তিনি সারা জীবন সোচ্চার ছিলেন। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার আন্দোলনের তিনি ছিলেন সবসময়ের প্রেরণা। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সর্বদা সংবেদনশীল। এভাবেই প্রফেসর আরেফিন নানা ধরনের সামাজিক অ্যাক্টিভিজমে যেমন যুক্ত ছিলেন, তেমনি তিনি ছিলেন আদিবাসীবান্ধব নৃবিজ্ঞানী।

মানুষ হিসেবে প্রফেসর আরেফিন

মানুষ হিসেবে প্রফেসর আরেফিনের বিচার করা আমার সাধ্যের বাইরে। কেননা, আমার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল প্রফেসর আরেফিনের অপার স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার। ফলে আমার পক্ষে আবেগ-নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য আমি আবেগ-নিরপেক্ষ হতেও চাই না। কেননা, স্যারের অসংখ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানুষ আরেফিনকে আমি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কাছ থেকে দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাকাডেমিক আলোচনা করেছি। নৃবিজ্ঞানের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন বিস্তর আলোচনা হয়েছে স্যারের সঙ্গে, আলোচনা হয়েছে দৈশ্বিক ও বৈশ্বিক নৃবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা, পঠন-পাঠন এবং লেখালেখি নিয়ে। সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতি কোন কিছুই বাদ যায়নি আমাদের আলোচনায়। তিনি চমৎকার এবং অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়গুলো উপলব্ধির চেষ্টা করতেন। আমার সঙ্গে বিতর্ক করতেন।

তিনি সবসময় বলতেন, "একজন ভালো নৃবিজ্ঞানী হওয়ার প্রাথমিক গুণ হচ্ছে একজন ভালো মানুষ হওয়া।"

আমি বলতাম, "ভালো মানুষ হতে হবে কেন? ভালো মানুষ হলেই ভালো নৃবিজ্ঞানী এমন তো কথা নেই।"

স্যার উত্তর দিতেন, "ভালো মানুষই ভালো নৃবিজ্ঞানী হবেন এমন কথা নেই হয়তো সত্য, কিন্তু একজন ভালো নৃবিজ্ঞানী হওয়ার জন্য একজন ভালো মানুষ হতে হবে। কারণ, নৃবিজ্ঞানীর কাজ মানুষ নিয়ে গবেষণা করা। যে মানুষ নিয়ে গবেষণা করবেন, সে যদি নিজে সৎ-ভালো মানুষ না হন, তাহলে সে অন্যকে বুঝবে কীভাবে?"

এরপর আমার আর কোনো প্রশ্ন থাকে না। মানুষ হিসেবে প্রফেসর আরেফিন কেমন ছিলেন, এ কথোপকথনই তার স্বাক্ষ্য বহন করে। আর তিনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন? সে প্রশ্নের উত্তর আরও একটা প্রশ্নের উত্তর দেয় যে, "তিনি কোন মাপের নৃবিজ্ঞানী ছিলেন?"