বাংলাদেশ এখন একটি মডেল

শাহমিকা আগুন
Published : 21 Dec 2016, 10:22 AM
Updated : 21 Dec 2016, 10:22 AM

আয়শা ঘর-পালানো মেয়ে। ঘর-পালানো বললে ভুল হবে, দেশ-পালানো মেয়ে। সে জানে দেশে ফিরলে মৃত্যু তার অবধারিত। তালেবান বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য সে। সময়মতো দেশ ছেড়ে পালাতে না পারলে তার মাথার খুলিও উড়িয়ে দেওয়া হত, যেমনটি চেষ্টা করা হয়েছিল মালালার ক্ষেত্রে। মালালা পাকিস্তানি; আয়শাও তাই। সে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নারীশিক্ষা নিয়ে কাজ করেছে। মালালার বাবা তাকে প্রাণপণে আগলে রেখেছিলেন। আর আয়শার ওপর মৃত্যু-পরোয়ানা জারি করেছে তার বাবা নিজেই। এ আবার কেমন বাবা! নিজের সন্তানকে হত্যা করতে চায়!

আয়শার বাবা একজন তালেবান যোদ্ধা। তার চেয়েও ভয়ানক একটি পরিচয় রয়েছে লোকটির। সে একজন পাকসেনা যাকে ১৯৭১ সালে অন্য অনেক সেনার সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ শহীদের হত্যার সঙ্গে– দুই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনার অত্যাচারিত শরীর, কান্না, রক্ত, আর্তনাদ, চিৎকার ও হাহাকারের গা-শিরশিরে অভিজ্ঞতার সঙ্গে আয়শার বাবাও জড়িত। সে সময় পাকসেনাদের যারাই বাংলাদেশে ছিল, কেউ ওই হত্যা-ধ্বংস-অত্যাচারের জন্য দায়ী না হয়ে যায় না।

আয়শার বাবা কখনও এ নিয়ে আয়শাকে কিছু বলেনি। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে তার বাবার আচরণের কাহিনিগুলো শুনে যে কেউ বলে দিতে পারবে এই পাকসেনাটি বাংলাদেশ কী কৃতকর্ম সাধন করেছিল। আয়শার সামনে প্রতিদিন বেত্রাঘাত করা হত তার মাকে। তার ওপর পশুর মতো নানা অত্যাচার করার পর বিভিন্ন বিকৃত কায়দায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য করা হত তাকে। আয়শাকেও ছোটবেলাতেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছিল তার বাবার হাতে। অথচ অর্থকষ্ট ছিল না তাদের। তার বাবার পোস্টিং ছিল দেশের বাইরে। তাদের জীবন হতে পারত অনেক সুন্দর– অনেক আনন্দের।

তা হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়। পাকিস্তানি জেনারেলরা সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল কীভাবে বাঙালি জাতিকে ধংস করতে হবে তার জন্য, কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী পরিণাম নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবেনি তারা। এই হত্যা, ধ্বংস– এই উন্মাদনা– তাদের নিজের দেশ, সমাজ, পরিবারের ওপর কীভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরে যাবে তা ভাবেনি তারা। তাই তো বাঙালির রক্ত দেখে হো হো করে যারা হাসত তারা হত্যা করেছে অনেক অনেক পাকিস্তানিকেও। যাদের কেউ কেউ এখন নিজের হাতে নিজ সন্তানের রক্ত ঝরাবার প্রতীক্ষায়!

দেশে, দেশের বাইরে যেখানেই গেছে নিজেদের হিংস্রতার প্রমাণ দিয়ে এসেছে এই পাকিস্তানি বাহিনীর একাংশ। বাংলাদেশে এত নারীধর্ষণের পর দেশে ফিরে গিয়ে তারা থেমে থাকেনি। ধর্ষণ করেছে স্বজাতির, প্রতিবেশির, এমনকি নিজেদের পরিবারের নারীদেরও। যোগ দিয়েছে বিভিন্ন বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে– তালেবানদের সঙ্গে।

বাংলাদেশের বীরাঙ্গনা মায়েদের সঙ্গে কথা বলার পর, অত্যাচারের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানার পর আমি ছিলাম কিছু পাকিস্তানি সৈনিকের সন্ধানে যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ছিল। কিন্তু বিলেতে বসে কোথায় পাব তাদের! ঘটনাচক্রে পরিচয় হল আয়শার সঙ্গে। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম পাকসেনাদের জীবনযাপন আর বিনোদনের নানান রসদপাতি সম্পর্কে। আর জানতে পারলাম সেই ভয়াবহ তথ্য! বাংলাদেশ যুদ্ধশেষে প্রত্যাবর্তিত সৈন্যদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধে তো তারা হেরে গিয়েছিল। তাহলে পদোন্নতি, বিদেশযাত্রা কীসের জন্য?

মিরপুরের বধ্যভূমি কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ের লালদীঘি বাঙালির লাশে ভরপুর করে দেওয়ার জন্য! নাকি লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে দিনের পর দিন চুলের সঙ্গে বেঁধে সিলিংএ ঝুলিয়ে তাদের যৌনদ্বার ক্ষত-বিক্ষত করার জন্য, কিংবা গর্ভবতী নারীর পেট ফেড়ে তাকে নরক-যন্ত্রণা দেওয়ার জন্যে! বীরাঙ্গনা রাজুবালার সামনে তার দুধের শিশুকে কুয়ায় ছুঁড়ে ফেলে হত্যা করা হয়। আরেক সন্তানকে গাছের সঙ্গে আছড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করে রাজুবালাকে ধর্ষণ করা হয়। এইসব নৃশংস খুনি, ধবংস্মাত্নক ঘটনার রচনাকারীদের তবে পুরস্কার মিলেছিল!

অর্থ, সম্পদ, প্রভাব, প্রতিপত্তি, পদোন্নতি নিয়ে সেই সৈনিকরা আকারে-প্রকারে বিরাট থেকে বিরাটতর হতে হতে এমনসব পিশাচে পরিণত হয়েছে যাদের কাছ থেকে তাদের নিজের কন্যাদেরও রেহাই মিলেনি। আয়শার কাছ থেকে তার বাবার পদোন্নতির কথা শোনার পর খুব অসহায় বোধ করছিলাম। আমার শুধুই মনে পড়ছিল বীরাঙ্গনা মমতাজ, আমেনা, মালেকা, হাজেরা, রমা চৌধুরীদের কথা।

আয়শার বাবার মতো সৈনিকরা যখন বাথটাবে কুসুম কুসুম গরম পানিতে শুয়ে স্পার মোহনীয় সুগন্ধে নিজের তেলচর্বিময় কুতকুতে শরীরে আরও আয়েশ দেওয়ায় ব্যস্ত ছিল, তখন এই সেনাদের দ্বারা ভয়াবহ গণধর্ষণের শিকার আমাদের বীরাঙ্গনা মা মমতাজ বেগম জঠরে অত্যাচারিত, গলিত সন্তানের মৃত্যুর ভার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে তিনি মারা যান। সারাজীবনে তাঁকে ত্রিশটির বেশি অপারেশন করাতে হয়েছে। অত্যাচারের বীভৎসতায় তাঁর পায়ুপথ ও যোনিপথ এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, আজীবন এই মা কখনও স্বাভাবিকভাবে মলত্যাগ করতে পারেননি। ২০১৪ সালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম যখন তখন তিনি খুবই অসুস্থ। তাঁর প্রদাহভরা রক্তাক্ত কোলন দেখে থরথর কাঁপছিলাম। এ ছিল আমার কিছু মুহূর্ত তাঁর সঙ্গে থাকার প্রতিক্রিয়া। এই বীরাঙ্গনা মা দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর এই রক্তাক্ত কোলন, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মলদ্বার আর মানুষের ঘৃণা, অপবাদ, অবহেলা নিয়ে– বিচার ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির আশা নিয়ে বেঁচেছিলেন।

যুদ্ধ ও নারী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পরিচিত হয়েছি বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির যুদ্ধাহত নারী ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে। একটি কেয়ার হোমে পরিচয় হয়েছিল এক ইহুদি নারীর সঙ্গে। তাঁর নাম সিলভিয়া। বয়স প্রায় একশর কাছাকাছি। তাঁর গল্প শুনেছিলাম। তিনি পোল্যান্ডয়ে নাজি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। অন্ধকার ঘরে বন্দি করা রাখা হয়েছিল তাঁকে। পালা করে সৈনিকরা আসত– অত্যাচার করে চলে যেত। সন-তারিখ তাঁর মনে নেই– মনে নেই কত দিন নিপীড়নের শিকার হযেছেন তিনি।

সিলভিয়া জানিয়েছিলেন, ছাড়া পাবার পর পোল্যান্ডবাসী তাদের মতো নিপীড়িত নারীদের গ্রহণ তো করেইনি বরং দেশদ্রোহী উপাধি দেওয়া হয়েছিল তাদের। কেননা তাঁরা শত্রুদের মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত হয়েছেন! সিলভিয়া অনেক কষ্টে পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান পরে। আর কখনও ফিরেননি নিজের দেশে।

তাঁর ওপর অত্যাচারের সঙ্গে মিলে যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বাঙালি নারীনির্যাতনের চিত্র। এত বছর পরও সেই বীভৎস স্মৃতির দাপটে ঘুমাতে পারতেন না সিলভিয়া। তাদের একজনের সামনে অত্যাচার করা হত অন্যজনকে। বেশিরভাগ নারীকেই বন্ধ্যা করে দেওয়া হয়েছিল। সিল্ভিয়া তাই কখনও মা হতে পারেননি। সারাজীবনে আর কখনও স্বপ্ন দেখতে পারেননি একটি সংসারের। পরিবারহারা দেশছাড়া এই মানুষটি আজীবন নিঃসঙ্গই রয়ে গেলেন।

সিলভিয়াদের মতো নারীদের ওপর নিপীড়ন চালানো সৈনিকরা নিশ্চয়ই দেশে-বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছে দাপটের সঙ্গে। ভাবা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলিশ ইহুদি নারীদেরকে ধর্ষণ করার জন্য একটি আইন পাশ করা হয়? আর সে আইনে নারীদেরকে নারী না বলে অবজেক্ট বা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে ভোগ করার জন্য সৈনিকদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

যুদ্ধের সময় নারীদের অপহরণ করে আনা হত। তারপর বাধ্য করা হত সেনাদের সঙ্গে সহবাসে রাজি হতে। যারা রাজি হত না তাদের পাঠানো হত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে আবার তাদের ওপর চালানো হত নানা ধরনের অত্যাচার। খাবার এবং পানি দেওয়া বন্ধ থাকত প্রায়ই। কেউ কেউ এভাবেই মারা যেত। অনেকে অত্যাবার সহ্য না করতে পেরে ফিরে আসতেন। যারা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতেন, তাদের প্রত্যেককে একেক রাতে বিশ জন সৈনিকের মনোরঞ্জন করতে হত। সপ্তাহের ছুটির প্রাক্কালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াত পঞ্চাশ থেকে আশি জনে! এমন ভয়াবহ অত্যাচারের ফলে অনেক নারী এভাবেই মারা যেতেন। যারা যৌনরোগে আক্রান্ত হতেন তাদেরকে মেরে ফেলা হত।

পোলিশ ইহুদি নারীদের ওপর নিপীড়ন চালানোর লাইসেন্স দেওয়া এই কালো আইনগুলো গোপনীয়তার নামে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে পোলিশ ভাষাতেই বেশি লেখালেখি হয়েছে। ইংরেজিতে সেসব ডকুমেন্টের তেমন অনুবাদ হয়নি। আমার এক সহকর্মী ডকুমেন্টারি ছবি বানাতেন। তাঁর সহায়তায় আমি কিছু পড়তে পেরেছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনী এবং লাল বাহিনীর হাতে প্রায় দুই মিলিয়ন নারী গণধর্ষণের শিকার হন। তাদের বয়স আট থেকে আশি বছর। বাঙালি বীরাঙ্গনা নারীদের যেমন বেশেরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার গ্রহণ করেনি, ইহুদি নারীদেরও গ্রহণ করেনি তাদের পরিবার বা দেশবাসী। বেশিরভাগ নারীরই অবশ্য পরিবার ছিল না। হত্যা করা হয়েছিল পরিবারের অন্যদের।

যুদ্ধে সৈনিকরা কতটা বিকৃত হতে পারে তার আরেকটি উদাহরণ জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান চীনের নানজিংয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। জাপানি সৈন্যরা আশি হাজারের বেশি নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করেছিল। গণধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাননি তিন বছরের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে নব্বই বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত।

জাপানিরা পৃথিবীর অন্যতম সভ্য ভদ্র জাতি হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের ধর্ষণ-প্রক্রিয়া দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। বেশিরভাগ নারীর যৌনাঙ্গ তারা তলোয়ার, বাঁশের কঞ্চি কিংবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করত। সাত বছরের মেয়েশিশুকে হাত-পা বেঁধে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে প্রায় একশর বেশি সৈনিক যতদিন পর্যন্ত না শিশুটির মৃত্যু হয়। নারীর স্তন কেটে বা পেট কেটে সন্তান বের করে এক সৈনিক আরেক সৈনিকের দিকে ছুঁড়ে দিত। এভাবে ছুঁড়ে দেওয়া শিশুটের মৃত্যু অব্দি এটা চলত।

জাপানি এক সৈনিকের সাক্ষাৎকার দেখেছি। সে বলছিল, "চাইনিজ নারীদেরকে আমরা আসলে শূকর ভাবতাম। কখনও কখনও ভাবতাম আস্তাকুঁড়ের নর্দমা।"

জাপানি সৈন্যরা এমনকি হাসপাতালে হামলা চালিয়ে ডাক্তার এবং নার্সদেরও ধর্ষণ করেছে। পরে জাপান সরকার চীনের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হয়।

আফ্রিকার দেশগুলো যেমন রুয়ান্ডা, সুদান, কঙ্গোর মতো দেশগুলোতে জাতিগত দাঙ্গা বা গৃহযুদ্ধে ধর্ষণ করা হয়েছে নারীদের। তাদের ধর্ষণ-প্রক্রিয়া আরও ভয়াবহ। একই নারীকে প্রতিপক্ষরা বিভিন্নভাবে ধর্ষণ করেছে, বিক্রি করেছে– পরিবারের বাবা-ছেলে-মামা-চাচা সবই মিলে এক নারীকে গণধর্ষণ করেছে।

আমরা এখন পাশের দেশে দেখতে পারি রোহিঙ্গা নারীদের ওপর কী অকথ্য অত্যাচার চালানো হচ্ছে। কী শোচনীয় অবস্থায় জীবন যাপন করছেন আইসিস বাহিনীর হাতে বন্দি নারী ও শিশুরা। বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে যখন খুব সোচ্চার ছিলাম তেমন একটি সময়ে একটি ইমেইল পেলাম। লেখা ছিল, "তেতাল্লিশ বছর আগের ঘটনা নিয়ে লাফালাফি না করে ক্ষমতা থাকলে সিরিয়া আর ইরাকের নারীদের ধর্ষণ বন্ধ করে দেখান।"

থমকে গিয়েছিলাম। কিছু কী করতে পারব? না তো। আইএস সৈনিকরাও ধর্ষণের সময় এই নারী ও শিশুদেরকে কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করে থাকে। হয়তো শূকর বা বিধর্মী বা আরও নিচ কোনো প্রাণির সঙ্গে। এত ঘৃণা কোথা থেকে আসে, সেটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে ধর্ষণ আসলে কী। সেক্সচুয়াল ভায়োলেন্সকে যুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। দেশের এবং বিশ্বের প্রচলিত আইন তখন ভেঙ্গে ফেলা হয়। আইএস যেমন অমুসলিম নারীদের ধর্ষণ জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছে। হাজরার কথা আমরা জানি। যে কিনা দীর্ঘ দুই বছর পর আইএসএর হাত থেকে পালাতে পেরেছিল। দু বছরে তাকে বাইশ বার বিক্রি করা হয়েছিল। এমনকি একবার এক প্যাকেট সিগারেটের বিনিময়েও তাকে বিক্রি করা হয়।

সেখানে কুমারীদের মূল্য বেশি। তাই ধর্ষণের পর পুনরায় বিক্রি করার আগে তাদের যৌনাঙ্গ সেলাই করে দেওয়া হত। হাজার হাজার নারী এই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরা আর কজনের কথা জানি? যুদ্ধে আইনের প্রয়োগ ভেঙে পড়ে। এখন আইন প্রয়োজন এই আইন না ভাঙার জন্যে। এগিয়ে আসা উচিত পৃথিবীর সব মানবিক প্র্তিষ্ঠানগুলোর।

হাজরার মতো নারীদের জন্য কিছু করতে পারিনি। তবে বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ের জন্যে যে আন্দোলন আমরা চালিয়েছিলাম তা সফল হয়েছে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর হাজার হাজার বাংলাদেশির সমর্থন। দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর পর আমাদের বীরাঙ্গনারা পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় ভাতা। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। পৃথিবীতে আর কোনো দেশের যুদ্ধাহত নারীরা এই সম্মান ও স্বীকৃতি পাননি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন একটি মডেল।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশে যুদ্ধাহত নারীদের বীর উপাধি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বাংলা ভাষায় বীরাঙ্গনা শব্দটি নিয়ে নানান সমালোচনা থাকলেও এ কথা মানতে হবে যে, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যুদ্ধাহত ধর্ষিতা নারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা দিয়ে এই নারীদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হল, ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বসনিয়া ও রুয়ান্ডার নারীদের ওপর অকথ্য নিপীড়ন চালানোর পর বিশ্ব প্রথম সমন্বিতভাবে এই নারীদের জন্য কিছু করার কথা বিবেচনায় আনে। অথচ বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকেই নারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। দুঃখজনক হল, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সকল উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে যে, দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর পরও যুদ্ধাহত নারীদের জন্য কিছু করা যায় যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের যুদ্ধাহত নারীদের আশার আলো দেখিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীর আরও অনেক দেশের যুদ্ধাহত নারীরা স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক অনুদান পাবেন। এখনও দাবি করি বাংলাদেশের কাছে পাকসেনাদের ক্ষমা চাইতে হবে। বিশ্বাস করি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এখন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এগুনোর সময়। সেই সঙ্গে আশা করি, সংগ্রহ করা হবে আমাদের বীর নারীদের জীবনসংগ্রামের তথ্য এবং গড়া হবে একটি আর্কাইভ। যেখানে লেখা হবে বাংলায় এবং ইংরেজিতে। বাংলাদেশের বীর নারীদের কথা ছড়িয়ে দেওয়া হবে দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের কাছেও।

নারী সংগঠনগুলো বীর নারীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ২০১৭ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করার বিষয়ে ভাববেন এই অনুরোধ রাখছি। সেই সঙ্গে যুদ্ধে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে আবেদন জানাবেন।

জয় হোক মানবতার।