‘নাবালক’ পুরুষের বিয়ের বয়স

সীনা আক্তার
Published : 23 Dec 2016, 03:48 AM
Updated : 23 Dec 2016, 03:48 AM

সংসদে উত্থাপিত 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন- ২০১৬' নামের আইনে পুরুষের বিয়ের নূন্যতম বয়স ২১ বছর এবং মেয়েদের ১৮ বছর। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে। যে কোনো আইন বা নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে অভীষ্ট জনগোষ্ঠী এবং সমাজের কল্যাণ এবং উন্নয়ন। দুর্ভাগ্যবশত প্রস্তাবিত আইনটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই বৈষম্যমূলক এবং সমাজের জন্য পশ্চাৎপদমুখী। মেয়েদের বিয়ের বয়সের কারণে ইতোমধ্যে আইনটি ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত, তবে সে আলোচনায় পুরুষের বয়সের বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত।

জাতিসংঘ সনদ এবং আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়সে একজন ব্যক্তি পূর্ণবয়স্ক বলে বিবেচিত হয়। একজন স্বাভাবিক মানুষের বয়স, শারীরিক এবং মানসিক পরিপক্কতা এবং চাহিদা বিবেচনায় ১৮ বছরকে প্রাপ্তবয়স্ক হবার একক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বয়সে একজন ব্যক্তি আইনত ভোট প্রদানে এবং চাকুরী-ব্যবসায় কর্মজীবনে যোগদানে যোগ্যতাসম্পন্ন।

অথচ, প্রস্তাবিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটিতে ২১ বছরের কমবয়সী পুরুষকে বলা হচ্ছে 'অপরিণতবয়স্ক' (Minor) বা নাবালক! অর্থাৎ, আইন করে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে 'অপরিণতবয়স্ক' ট্যাগ দিয়ে তাদের যৌনঅধিকার হরণ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে যা মানবাধিকার পরিপন্থী।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কখন বিয়ে করবে তা একান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সমাজের সুস্থ বিকাশে প্রাপ্তবয়ষ্ক, সক্ষম ব্যক্তির বিয়ের স্বাধীনতা উপভোগের অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া বিয়ের বয়স ১৮ হলেই যে সব পুরুষ এ বয়সে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবেস তা ভাবার কারণ নেই। তবে এ বয়সে যে সকল পুরুষ নিজেদের বিয়ের যোগ্য মনে করবেন তাদের সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অন্যায্য। অধিকন্তু, পুরুষের বিয়ের বয়স ২১ করার সঙ্গে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের যৌক্তিকতা নেই বরং হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কা বেশি।

একজন ১৮ বছর বয়সী পুরুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ এবং ভালোবাসাময় সম্পর্কে জড়ানো স্বাভাবিক ঘটনা। সঙ্গত কারণে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি প্রাপ্তবয়ষ্ক নারী-পুরুষকে বিবাহ-বহির্ভূত একত্র বসবাস বা সহবাস করার অনুমোদন দেয় না। সে ক্ষেত্রে আইন করে বিয়ের অধিকার খর্বের ব্যবস্থা করা অমানবিক।

এটা ঠিক যে, বিয়ে এবং সংসারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে পুরুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন আশা করা হয়। কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষি-কলকারখানায় কর্মরত অনেক পুরুষ আঠারতে প্রতিষ্ঠিত। সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, পোষাক শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স বিশের মধ্যে। অনেক পরিবার বিশেষ কারণে আঠারর বেশি বয়সী ছেলের বিয়ে যথাকর্তব্য মনে করেন কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতায় তা সম্ভব হয় না। এছাড়া, ১৮-১৯ বছর বয়সী অনেক পুরুষই সমবয়সী নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ হন। এমন যুগল বিয়ে করতে চাইলে, উভয় পরিবারের সন্মতি থাকলেও এই আইন সেই শুভকাজ বাধাগ্রস্ত করে।

দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ-নারীর বিয়ে প্রতিহত করা মানে তাদের যৌন-অবদমনে বাধ্য করা অথবা বিয়ে-বহির্ভূত বিশেষ সম্পর্ক প্ররোচিত করা। অন্যদিকে, এ ধরনের সম্পর্কে কোনো এক পক্ষের পরিবারের আপত্তি থাকলে আইনত ছেলের বয়সের দোহাই দিয়ে অনেক অভিভাবক সে বিয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে প্রেমিক পুরুষটির বয়স ২১ বছর না হওয়া পর্যন্ত সেই যুগলকে অপেক্ষা করতে হয়। এই ফাঁকে মেয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে এই ছুতায় মেয়ের মা-বাবা নানা কূটকৌশল ও ইমোশোনাল ব্লেকমেইল করে তাদের পছন্দের কোনো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। পরিণতিতে দুটো জীবনের সর্বনাশ ঘটে।

ব্যর্থ প্রেম-সম্পর্কের প্রভাব একেক জনের জীবনে একেক রকম। মর্মপীড়ায় অনেক পুরুষ কর্মে আগ্রহ হারান, অনেকে মাদকে আসক্ত হন– কেউ কেউ বিপদজনক মতাদর্শে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। আর মেয়েটির মানসিক দুর্দশা সহজেই অনুমেয়। এমন অনেক ঘটনা আমাদের আশেপাশেই বিদ্যমান।

অন্যদৃষ্টিতে, প্রস্তাবিত আইনের অপব্যবহারে নারীর প্রতি প্রতারণা এবং নিপীড়ন-বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন, ১৮ বছরের একজন পুরুষ এবং একই বয়সের একজন নারীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কে মেয়েটি যদি গর্ভবতী হন তখন প্রেমিক পুরুষটি খুব সহজেই আইনের দোহাই দিয়ে বিয়ের দায়িত্ব এড়াতে পারেন। তখন সেই মেয়ের কী হবে? মেয়েটি গর্ভপাত করাতে পারেন অথবা মা হবার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কিন্তু এর যে কোনোটি মেয়েটির ভবিষ্যত দুর্বিসহ করার জন্য যথেষ্ট।

আবার প্রেমিক মেয়েটিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে গর্ভপাতে চাপ দিতে পারেন। গর্ভপাতের পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে অথবা প্রেমিকটি এই সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারেন। অথচ আইনে ১৮ বছর বয়সী পুরুষের বিয়ের অনুমোদন থাকলে এমন অবস্থায় বিয়ের মাধ্যমে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।

বলাবাহুল্য, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণে আমাদের দেশের অনেক পুরুষ যৌন-বঞ্চনার শিকার। এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজে দৃশ্যমান। পুরুষের যৌন-অবদমনের সঙ্গে শিশুনিপীড়ন, ধর্ষণ, রাস্তাঘাটে নারীনিপীড়নের সংযোগ আছে বলেই মনে করি। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে সাধারণত ১৮-২০ বছর বয়সী পুরুষের সংশ্লিষ্টতা লক্ষণীয়।

প্রসঙ্গক্রমে, দেশে বাল্যবিবাহের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে কন্যাশিশুর নিরাপত্তার অভাব। ধর্ষণ, নিপীড়ন এড়াতে অনেক মা-বাবা তাদের কন্যাশিশুর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। সেজন্য, নারীনিপীড়ন প্রতিরোধে পুরুষের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১৮ বছর করা জরুরি।

স্পষ্টতই, প্রস্তাবিত আইনটি অসঙ্গতিতে পূর্ণ। কারণ বাস্তবতা উপেক্ষা করে এ আইনে পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে 'নাবালক' বিবেচনা করে তার বিয়ের বয়স ২১ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং 'বিশেষ প্রেক্ষাপট'এর অজুহাতে কন্যাশিশুর বিয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিণতিতে পুরুষ-নারী উভয়েরই কল্যাণ, সুখ ও সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে; বাড়বে সামাজি অনাচার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আইনটি বাল্যবিবাহ রোধে সহায়ক হবার কারণ নেই।

প্রকৃতপক্ষে, পুরুষ-নারী উভয়ের জন্য বৈষম্যহীন এবং সমাজবান্ধব একটি আইন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আশা করি সরকার প্রস্তাবিত আইনটি পুনর্বিবেচনা করে শর্তহীনভাবে পুরুষ-নারীর বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর করার পদক্ষেপ নেবেন।