নগর প্রশাসনের নির্বাচন নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে কি?

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 25 Dec 2016, 06:11 AM
Updated : 25 Dec 2016, 06:11 AM

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দারুণ উৎকণ্ঠার মাঝে দেশবাসী ও অতিশয় উদ্বিগ্নবোধ করেছে, গণমাধ্যম ছিল রীতিমতো সোচ্চার। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নির্বাচন নতুন গতি সঞ্চার করতে পারবে। আবার অনেকে মনে করছেন, এসব হচ্ছে আড়ম্বর, লঘুক্রিয়া– রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার আস্ফালন মাত্র। এই নির্বাচন নগরবাসীর জীবনের কোনো পরিবর্তন দূরে থাক, সাধারণ প্রত্যাশা পূরণেও সমর্থ হবে না।

মেয়র ও কাউন্সিলর-প্রার্থীরা খাওয়া-দাওয়া হারাম করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছেন এবং সর্বত্র প্রতিশ্রুতির বন্যা বর্ষণ করেছেন অনবরত। কোনো কোনো প্রার্থী আশ্বাস দিয়েছেন, নির্বাচিত হলে আধুনিক নগরী গড়ে তুলবেন, সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসন কাবুলিওয়ালার ভুমিকায় অবর্তীর্ণ হবে না। হোল্ডিং ট্যাক্স স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে এসে নাগরিক সকল সুবিধা-সম্বলিত আকর্ষণীয় মহানগরী উপহার দিবেন। আবার কোনো কোনো প্রার্থী বলেছেন, গৃহীত সকল কর্মকাণ্ডের সফল বাস্তবায়ন এবার হবে, যদি নির্বাচিত হওয়া যায়।

ভোটারদের কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন অবিরাম পানি সরবরাহ, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং গ্যাসপ্রাপ্তির সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে তা নিয়ে। প্রার্থীদের উত্তর ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি উত্থাপন করা হবে। নগরবাসীর অনেক চাহিদা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াও পয়োনিষ্কাষন, পার্ক নির্মাণ, রাস্তার পর্যাপ্ত আলো, ভেজাল খাদ্য নিবারণ, ময়লা আবর্জনার সৃষ্ট পরিসেবাসহ হাজার প্রকার সুবিধার দাবি নগরবাসীর। আবার সঙ্গে আছে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ ও যাতায়াতের সুবিধাসহ নিরাপদ নগরী সৃষ্টির দাবি।

প্রার্থীরা ভুলেও বলেননি যে, নগরবাসীরও কিছু দায়িত্ব আছে যা তাদের পালন করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা সুরক্ষাসহ গৃহনির্মাণ থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে নগরবাসীকে নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে হবে। নির্বাচিত হলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ সকল কাজ তিনি করবেন। নাগরিকদের প্রত্যাশা বৃদ্ধি ছাড়া, তাদের অন্য কোনো কথা প্রার্থী বলতে এখন নারাজ। নির্বাচনের পর এখন কি কেউ বলবেন যে, এ সকল কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের, নগরপিতা কী করবেন?

সিটি কর্পোরেশন হচ্ছে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত স্বশাসিত সংস্থা। এই স্থানীয় সরকার কর আদায় করবে, নাগরিক সুবিধা দিবে এবং সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, তবেই তো এ হচ্ছে সরকার। তাই নগরবাসীর তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দাবি করাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেইসব দাবি পূরণের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কি সিটি কর্পোরেশনের আছে?

হোল্ডিং ট্যাক্স স্বাভাবিক করা হবে, আধুনিক মহানগরী গড়ে তোলা হবে, এসব কথা বলে নগরের প্রতি মানুষের বসবাসের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই গ্রাম থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এসে শহরের বস্তিতে বসবাস করতে শুরু করেছে, নগরের দারিদ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় তাই দেখা যাচ্ছে। অপরিকল্পিত বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করতে না পেরে অবশেষে দেখা যায়, রাতের অন্ধকারে শহরের বস্তিতে আগুন লাগছে। কী এক নগর প্রশাসন, এই জন্যেই কি নির্বাচন!

বাস্তবতা হচ্ছে, এ সকল স্থানীয় সরকারের আর্থিক ক্ষমতা খুবই সীমিত। আয়ের উৎস নিতান্তই মাত্র ২১/২২টি, কিন্তু ব্যয় বা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র হচ্ছে ১২৫টি। যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা অনেকেই জানেন না যে, তাদের দায়িত্বের পরিধি কী। আবার অনেকে জানেন, কিন্তু ভোটের আশায় শুধু অর্নগল বলে গেছেন যে, সকল দায়িত্ব তারা পালন করবেন।

অনেকে জানেন, সামান্য কারণেও স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব রাজস্ব আয় দিয়ে ৬০ শতাংশ ব্যয় নির্বাহ ও সম্ভব নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মাত্র ৫৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পারে নিজস্ব রাজস্ব আয়ের উৎস থেকে। অবশিষ্ট ব্যয় নির্ভর করে সরকারের থোক বরাদ্দ থেকে। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, গ্যাসের চাহিদার পূরণের জন্য নয়, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পয়োনিষ্কাষন থেকে শুরু করে শৌচাগার নির্মাণের ব্যয় প্রায় সবই কেন্দ্রীয় সরকারকে বহন করতে হয়।

এমন একটি সমস্যা সামনে রেখে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এতসব প্রতিশ্রুতির প্লাবন সৃষ্টির অর্থ কী? অনেকে মনে করেন, সবই হচ্ছে দলীয় রাজনীতির প্রভাব-বলয় সৃষ্টির প্রয়াস মাত্র। তাই দেখা যায়, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মিটিং-মিছিল করছেন, দলীয় প্রতীক ও ভাবমূর্তি বিকাশের লক্ষ্যে প্রচুর ব্যয় করছেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে নগরমুখী জনস্রোত বৃদ্ধি পাচ্ছে তার হিসাব হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে নগর ও পল্লী অঞ্চলের জনসংখ্যা হবে ৫০:৫০ এবং ঢাকা শহর হবে বিশ্বের চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। বর্তমানে ১১টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩২৬টি পৌরসভা আছে, অচিরেই ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর সিটি কর্পোরেশন হবে এবং পৌরসভার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। অপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক প্রয়োজনে গ্রাম হয়ে যাচ্ছে শহর। দেশবাসীও হচ্ছে নগরমুখী; কারণ প্রধানত পুশ ও পুল ফ্যাক্টর, প্রাকৃতিক বিপর্যয় শহরে আসতে বাধ্য করছে এবং নানাবিধ সুযোগ ও সুবিধা জনগণকে শহরে আসতে আকর্ষণ করছে।

শহরমুখী হবে জনগণ, তাকে ঠেকানো যাবে না। তাই শহর বাসযোগ্য করতে হবে। নগরপিতাদের অর্থহীন ফাঁকাবুলি আর রাজনীতিবিদদের ভোটাভুটির খেলা এ সমস্যার সুরাহা করতে পারবে না। এই জন্যে চাই অর্থবহ পরিকল্পনা। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯এর মধ্যে কিছু দিকনির্দেশনা আছে যা প্রতিপালনের কোনো উদ্যোগ নেই। স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়ন করা অথবা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কোনো প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

এক সময় কথা উঠেছিল যে, সিটি গর্ভমেন্ট করতে হবে। প্রধান কারণ ছিল যে, বিদ্যুৎ দিবে বিদ্যুৎ সংস্থা, পানি দিবে ওয়াসা, গ্যাস দিবে তিতাস, স্বাস্থ্যসেবা দিবে সরকার, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও কাটাকাটি করবে সড়ক পরিবহন বিভাগ, ভ্যাট আদায় করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধ করবে আরেক কর্তৃপক্ষ– তাহলে নগরপিতাদের কাজ কী? জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করা আর হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো? এজন্যে কি কোটি কোটি টাকা খরচ করে, দলাদলির ব্যাপক আয়োজন করে অনেক বড় বড় নির্বাচনের প্রয়োজন আছে?

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমুহের মধ্যে ১১ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ ও পরিকল্পিত নগরী, পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থাসহ সমৃদ্ধ ও টেকসই নগরী প্রতিষ্ঠার দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই লক্ষ্যে ৭টি টার্গেট ধরা হয়েছে যার মধ্যে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে নিরাপদ চলাচল, দূষণমুক্ত পরিবেশ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরজীবনের স্বাছন্দ্যের অনেক অর্থবহ পদক্ষেপের বার্তা। সংক্ষেপে বলা হয়েছে–

Make cities and human settlements inclusive, safe, resilient and sustainable.

এখন সময় এসেছে শহরকে বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার শুভদিন। বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে ও অনেক দিকদর্শন আছে, কিছু বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেই। জনগণের কাছে সেই সব প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, যা প্রতিপালনের সক্ষমতা আছে। ফাঁকা বুলি ছড়ালে একসময় জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না, গণতন্ত্র সুরক্ষার কথা বলে নির্বাচনের মহড়া অর্থহীন হবে। নির্বাচনে বিজয় লাভ বড় কথা নয়, আদর্শ শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনের পথে পদক্ষেপ নিতে হবে। নগরবাসীদেরকে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্যে অনুপ্রাণিত করতে হবে, তবেই নির্বাচন হবে অর্থবহ।