বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার গুণগত মানের সন্ধান

গৌতম রায়
Published : 12 Dec 2016, 07:20 AM
Updated : 12 Dec 2016, 07:20 AM

দেশের শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে কোনো আমলে সবাই সন্তুষ্ট হয়েছে বলে শুনিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই আমলে শিক্ষা নিয়ে যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন, সেখানে তিনি তাঁর সময়ের শিক্ষার মান নিয়ে বিস্তর খেদ প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার পর নানা সময়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন রচনায় শিক্ষার গুণগত মানের প্রশ্নে অসন্তুষ্টির সুর পাওয়া গেছে। সন্তুষ্টি যে দেখা যায়নি, তা নয়; তবে তুলনামূলকভাবে কম।

আমার মতে, একধরনের অসন্তুষ্টি থাকা ভালো। অসন্তুষ্টি থাকলে এগিয়ে যাওয়ার তাড়না থাকে। কোনো কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হওয়া মানে সে কাজের আপাত-সমাপ্তি ঘটা কিংবা একটি নির্দিষ্ট মানে পৌঁছার পর মান আর বাড়ানোর তাগিদটা না থাকা। সেদিক থেকে বর্তমানে যারা শিক্ষার মান নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, তাদের কাজটা ঠিক বলেই মনে করি। তবে অনেকে আছেন যারা কেবল সরকার বা ব্যক্তিবিশেষের বিরোধিতা করার জন্য অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, সেগুলো ধর্তব্যে না আনাই ভালো। সরকারের সিদ্ধান্তপ্রণেতারাও নিশ্চয়ই বোঝেন কোনটি বিরোধিতার জন্য সমালোচনা আর কোনটি উন্নয়নের তাগিদে সমালোচনা!

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশের গোছানো ও আনুষ্ঠানিক কাজটি করে থাকেন মূলত সচেতন ব্যক্তিবর্গ– যাদের আমরা প্রথাগত অর্থে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে থাকি। এসব বিষয়ে জনমানুষেরও বক্তব্য থাকে, কিন্তু সেগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রকাশ্য হয় কিংবা মূদ্রণ ও অন্যান্য মাধ্যমে কম গুরুত্ব পায়। কারণ বড় কিছু না ঘটলে জনমানুষ রুটিন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না। অপরদিকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম এমন বিষয়েও চিন্তুকরা তাদের প্রজ্ঞাসুলভ মত প্রকাশ করেন। কিন্তু দিন পাল্টেছে।

আগে মতপ্রকাশের সীমিত ব্যবস্থা ছিল; কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে স্যোশাল মিডিয়ার কারণে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারছে। সেগুলোর গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং প্রভাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূলধারার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে আজকাল আমরা জনমানুষের এমন অনেক মত শুনতে পাই যেগুলো একসময় কেবল বিদ্ব্যৎজনের কাছ থেকেই শোনা যেত।

এর কারণ হচ্ছে, জনগণ একদিকে যেমন স্বাধীন মতপ্রকাশের উন্মুক্ত ব্যবস্থাটি লুফে নিয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষা নিয়ে তাদের উদ্বেগও বাড়ছে। জনগণের একটা বড় অংশ, যাদের আমরা অভিভাবক বলি, তারা শিক্ষার যে কোনো পরিবর্তনের সরাসরি ও প্রথম ফলভোগী। তাদের প্রতিক্রিয়াও তাই হয় দ্রুত। শিক্ষার গুণগত মান কিংবা লেখাপড়ার বর্তমান অবস্থা নিয়ে তাদের মত তাই আমলে নিতে হয় সবার আগে।

এ অবস্থা যে শুধু আমাদের দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। যেসব উন্নত দেশের উদাহরণ আমরা উঠতে-বসতে দিই, সেখানেও শিক্ষার সংকট আছে। সেখানেও বুদ্ধিজীবী বা শিক্ষাবিদরা প্রতিনিয়তই সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিসহকারে তাদের বক্তব্য প্রচার করেন। সেখানেও অভিভাবকরা তাদের সন্তানের সুস্থ শিক্ষার জন্য সোচ্চার থাকেন। সুতরাং খুঁজলে পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে সবাই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে দিনযাপন করছে।

তবে আমাদের দেশে শিক্ষার মান নিয়ে জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা প্রকাশের মাত্রা সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বেড়েছে, সেটি উদ্বেগজনক। আশঙ্কার সূত্রপাতের অন্যতম কেন্দ্র বহুল পরিমাণে জিপিএ-৫ পাওয়া। কয়েক বছর ধরে এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রচুর শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে। ফলের এ উল্লম্ফনে অনেকে বিস্ময় ও সংশয় প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে অনেকের বিশেষত সরকারি মহলের মতে, এটি আমাদের শিক্ষার মান এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রমাণ। কে সঠিক আর কে বেঠিক– সেটিই এখন বড় প্রশ্ন!

এসএসসি ও এইচএসসিতে যারা ভালো ফল করছে, তাদের একটি বড় অংশ এসে আটকে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। অক্টোবর ও নভেম্বরে ঢাকা, জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার যে ফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা যায়। এ রকম যে এবারই ঘটল, তা কিন্তু নয়; গত কয়েক বছরের চিত্রই এ রকম। ইউনিট-ভেদে পাঁচ থেকে শুরু করে ১১ বা ১৫, ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করছে। পাস করার মানে চান্স পাওয়া নয়, পরীক্ষায় ন্যূনতম নম্বর তোলা। অন্তত জিপিএ-৪ বা তার চেয়ে বেশি গ্রেড পেয়ে আসছে এসএসসি ও এইচএসসিতে, তাদের তো এ রকম ফল হওয়ার কথা নয়!

এ ধরনের ফল দেখে কিছুদিন আগে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করেছেন। স্বাভাবিক। তিনি দেশের শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেখানে ফল এ রকম দেখা গেলে খারাপ লাগারই কথা। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তিনি যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন সেটি পাস-ফেলের সঙ্গে যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু আসনসংখ্যার তুলনায় ভর্তিচ্ছুকের পরিমাণ অনেক বেশি, তাই বাছাইয়ের একটা কর্মযজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়কে করতেই হয়। সেখানে ৮০ পেয়েও কেউ বাদ পড়তেই পারে, যদি এর বেশি আরও অনেক শিক্ষার্থী নম্বর পেয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বললেন:

"বাছাই করতে গেলে আমি ৯৯ পেয়েছি– এই খবর যদি পাই আমি শিওর হয়ে যাব যে আমি পাস করেছি, কিন্তু নেবে একজন। দেখা গেল আরেকজন একশ পেয়ে গেছে। তাহলে আমি কী ফেল? আমি ফেল না। প্রতিযোগিতায় আমি একজনের থেকে এক নম্বর কম পেয়েছি বলে ৯৯ পেয়েও আমি টিকতে পারিনি, এটা ফেল না।" (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

ভর্তি পরীক্ষায় ফেলের হারের বাখ্যার সঙ্গে এই ব্যাখ্যাটি কীভাবে যায় বুঝতে অপারগ হলাম।

তবে মাত্র এক ঘণ্টার পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীকে যাচাই করার যে প্রশ্নটি তিনি তুলে ধরেছেন, সেটি যুক্তিযুক্ত। এসএসসি বা এইচএসসিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষা নিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে যেভাবে বড় পরিসরে যাচাই করা হচ্ছে, সেটি বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঘণ্টায় পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে কি সত্যিই যাচাই করা সম্ভব? এবং এ রকম যাচাই কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

অবশ্য এটাও বলা যায়– পৃথিবীতে অনেক পরীক্ষা আছে যেখানে স্বল্পসময়ে পরীক্ষা নিয়ে কিছু দক্ষতা যাচাই করা হয়। দুই-তিন ঘণ্টার আইইএলটিএস, স্যাট, টোয়েফল, জিআরই ইত্যাদি পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। এগুলো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বলছি না যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহ ওই মানের, কিন্তু স্বল্পসময়ে যে যাচাই করা যায় না, সেটি একবাক্যে খারিজ করে দিতে নারাজ।

তবে অবশ্যই এ প্রশ্নটি উত্থাপন করতে হবে যে, কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসএসসি ও এইচএসসির মতো বিস্তৃত পরীক্ষার ফলাফল ভর্তি পরীক্ষার জন্য গ্রহণীয় বলে মনে করছে না? এ দুটো পরীক্ষার ফলাফলের ওপর কি বিশ্ববিদ্যালয় আস্থা নেই? নাকি সমপর্যায়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের তুলনা করতে পারছে না আমাদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলেই বিষয় বা অনুষদ অনুসারে ছেঁকে ছেঁকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেখে শিক্ষার্থী বাছাই করে ভর্তি করছে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন কীভাবে হয়, তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। সেগুলো পাশে সরিয়েও যদি বলি, ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন হয় এইচএসসি বা তার নিচের স্তরের পর্যায় থেকে যেগুলো শিক্ষার্থীদের জানার কথা, তারা সেগুলো কেন পারছে না?বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাক বা না পাক, অন্তত পাস নম্বর তো তাদের তুলতে পারার কথা! তার মানে কি এই যে শিক্ষার মানের এই গলদটা ভর্তি পরীক্ষায় নয়, আগে থেকেই রয়ে গেছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কেবল তারই প্রকাশ দেখা গেছে? না হলে এসএসসি ও এইচএসসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল– দুটো কেন দুই মেরুতে থাকবে?

শিক্ষামন্ত্রী ও সরকারের তরফ থেকে নানা সময়ে দাবি করা হচ্ছে, শিক্ষার মান বাড়ছে। অপরদিকে শিক্ষাকর্মী, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও জনমানুষের উল্টো উদ্বেগও লক্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাশের অতি নিম্নহার তো এ ব্যাপারে সরাসরি প্রমাণ হাজির করে। তাহলে কোনটি ঠিক? এসএসসি বা এইচএসসিতে যথাযথভাবে যাচাই করা হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় অতি কঠোর হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রতি? এ প্রশ্নগুলো সামনে রেখে উচিত হবে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে গবেষণা করা। গবেষণার মাধ্যমেই বেরিয়ে আসুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার অধিক কঠোরতার ও নানাবিধ শর্তের কারণে পাস করার হার কম, নাকি আসলেই শিক্ষার মান কমেছে।

সুখের বিষয় এই যে, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন, আলোচনা করেন। বিশেষত শিক্ষকদের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ রয়েছে। তিনি উপস্থিত ছিলেন– এমন কয়েকটি সভায় দেখেছি, মঞ্চের নিচে নেমে এসে তিনি অনেকের সঙ্গে শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর এ কাজটি খুবই ইতিবাচক, যা অনেকের মধ্যে দেখা যায় না। ধারণা করি, এ ধরনের আলোচনা ও গবেষণার অর্থায়নে তিনি নেতৃত্ব দেবেন। বাংলাদেশে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, সবাই পরস্পরের সঙ্গী ও পরিপূরক। সেখানে দাবি যদি একাধিক হয়, তাহলে তা তথ্য-উপাত্ত-গবেষণার ভিত্তিতেই যথাযথ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রয়োজন।

শিক্ষার মান কমছে কিংবা খুব কম শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় পাস করছে– এ ধরনের বক্তব্য, তথ্য বা দাবি একদিকে যেমন সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য এবং বিশেষত গোটা বাংলাদেশের জন্যই ভালো কিছু বয়ে আনে না; তেমনি তা শিক্ষার্থীদেরও আত্মবিশ্বাসের স্তর নামিয়ে দেয়।

একজন শিক্ষার্থী, যে কিনা এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে, সে যখন পাস করতে পারছে না বা কোথাও ভর্তি হতে পারছে না, তখন কি সে একটি বড়সড় ধাক্কা খায় না নিজের দক্ষতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে? অতিমূল্যায়ন কিংবা অবমূল্যায়ন করে আমরা কি তার ক্ষতি করছি না? তার তো কোনো দোষ নেই। শিক্ষাব্যবস্থা তাকে যেভাবে পরিচালিত করছে, সে সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। মুখস্থের জোয়ারের সময় মুখস্থ করছে, নোট/গাইড বইয়ের জোয়ারের সময় সেগুলোর ওপর নির্ভর করছে। আমি তাদের দোষ দেখি না; নানা সময়ে বরং অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করি।

অপরদিকে শিক্ষকরাও কি শিক্ষার্থীদের এ অবস্থা দেখে ব্যথিত হন না? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই লোক প্রশাসনের শিক্ষক মো. মাহবুব আলম প্রদীপ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মানের ওপর একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন:

হায়রে সৃজনশীলতা!

Rajsahee Univercity is vary beautiful!!!! (GPA-5)

…ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় স্বাভাবিকভাবেই ১০১ নং প্রশ্নে বলা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি বাক্য লেখার জন্য।…নং হলে ১০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। ওএমআর-এ স্বাক্ষর করার সময় কিছু শিক্ষার্থীর লেখা কয়েকটি বাক্য চোখে পড়ল।

মিরপুরের একটি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত এক শিক্ষার্থী লিখেছে–
"Rajsahee Univercity is vary beautiful"

ঢাকার আরেকটি কলেজ থেকে জিপিএ-৪.৮ প্রাপ্ত এক শিক্ষার্থী লিখেছে–
"Raishah university is beateful buidling."

রাজশাহীর একটি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত এক শিক্ষার্থী লিখেছে–

"Rajshahi Univarsity is very beautifull."

এ রকম আরও কিছু উদাহরণ তিনি দিয়েছেন। এরপর তিনি লিখেছেন–

পরীক্ষা হলে ১০২ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। যাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন শুদ্ধ করে বাক্য লিখতে পেরেছে। তবে জটিল বাক্য লিখতে গিয়ে তারা ভুল করেছে। এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। মানসিক চাপে সেটা করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে এই? তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম জিজ্ঞেস করায় তারা বলতে চায়নি। ওই কলেজের শিক্ষার্থীকে সঠিক বাক্য লিখতে বললে সে বারবার কেটে bettefal কেটে beg লিখেছে। তারপর beg কেটে bag লিখেছে। অবশেষে bag থেকে bagg লিখেছে।

আর এক শিক্ষার্থী লিখেছে, "I am student of."

আমি তাকে বললাম, "এরপরে কিছু একটা লেখা দরকার কি না?"

সে বলল, "কী লিখব?"

আমি বললাম, "তুমি লিখ, I am a student of something."

আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম সে যেন কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম লেখে।

সে লিখে আমাকে ডেকে বলল, "হয়েছে কি না?"

সে লিখেছে, "I am student of something."

আর কিছু বলার ইচ্ছা হল না। এবার আগ বাড়িয়ে সবাইকে বললাম, "তোমাদের সন্তানদের কি এই পড়াবা? একটু ভালো করে পড়। অন্তত নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিকপথ দেখাতে পারবে।"

প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই বেহাল দশার দায় কে নেবে? জিপিএ বাড়ানোর এক উন্মত্ত চিন্তাই কি এদের এমন পরিস্থিতে ঠেলে দিচ্ছে না? উত্তর জানা নেই। কী দরকার ছিল এমন সৃজনশীলতার? যে সৃজনশীলতা মৌলিক বিষয়গুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে?

এ রকম অভিজ্ঞতা আরও অনেক শিক্ষকের হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শক হিসেবে কাজের সুবাদে এ ধরনের উদাহরণ আমাকেও দেখতে হয়েছে। আমরা কি তাতে ব্যথিত হইনি? কচি মুখগুলো দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে ছুটে বেরিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে কষ্ট করে, তার ওপর অকৃতকার্য হলে এ যেন নিজেকেই অপরাধী করে তোলে!

গুণগত মানের প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী ও অন্যদের বক্তব্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফারাক এত হচ্ছে কেন? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। হয় মানের প্রশ্নে আমরা বেশি দাবি করছি, অথবা মাত্রাতিরিক্ত কঠিন হচ্ছি ভর্তি পরীক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার গুণগত মানের প্রশ্নে আমাদের দ্বান্দ্বিক অবস্থানে ফেলেছে। এ অবস্থার নিরসন হওয়ার প্রয়োজন। শিক্ষার গুণগত মানের প্রশ্নে সবাই এক সুরে যেতে না পারলেও অন্তত কাছাকাছি অবস্থানে যেন যেতে পারি, সেজন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উদ্যোগটি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের তরফ থেকে যৌথভাবে নেওয়া হোক।