রোকেয়া পাঠ: আমাদের ‘রোকেয়া’ ও রোকেয়ার ‘আমরা’

জাহান-ই-গুলশান
Published : 9 Dec 2016, 09:02 AM
Updated : 9 Dec 2016, 09:02 AM

বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়েছেন এমন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শহুরে আটপৌরে জীবন-কাটানো নারী-পুরুষের অনেকেই জানেন রোকেয়ার নাম। শাসকের ইতিহাস যখন কেবল রাজ-রাজড়াদের, শাসকের পরিবারের বা বিত্তবান অভিজাতের উত্তরাধিকারীকে স্থান দেয়– ক্ষমতাই যখন কাউকে জনমানসে পরিচিতির প্রধান উপায়– তখন রোকেয়া ব্যতিক্রম বটে।

পৈতৃক বা স্বামীর কাজ বা সম্পদের উত্তরাধিকার তিনি নন; ছিলেন না কখনও। বরং আজ রোকেয়ার কর্মই তাঁর জীবনসঙ্গী সাখাওয়াতকে তুলে ধরেছে সকলের সামনে। এমনকি তাঁর জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্দ বা একাধিক বিয়ে করা পিতার নামটিও আমরা জেনেছি রোকেয়ার কল্যাণেই। যদিও রোকেয়া তাঁর নিজের বা তাঁর জীবনসঙ্গী সাখাওয়াতের নামের কাঙ্গাল ছিলেন না কখনও। এমনকি–

"গভর্নমেন্ট স্কুলের নতুন নামকরণ government H.E School for Muslim Girls অর্থাৎ মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় করতে চেয়েছেন, তাতে আমি সেই মুহূর্তেই রাজি হয়েছি।"

[পত্র: ১৮; তারিখ:২৫-৪-৩২]

তবে প্রশ্ন জাগে রোকেয়া কেন করলেন স্কুল, লিখলেন প্রবন্ধ, উপন্যাস বা গড়ে তুললেন নারী সংগঠন, আনজুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম?

এর উত্তরো রোকয়া সেই একই চিঠিতেই দিয়েছেন:

"চিরকাল আমি স্ত্রীস্বাধীনতার জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি।"

এমন কঠোর ব্রতেই রোকেয়ার জীবন কেন্দ্রীভূত। তিনি আজ সমাজে যতটুকু পরিচিত, সম্মানিত, সবই তাঁর অর্জন। বাংলাদেশের মতো সমাজেও আজ একজন নারী, তা-ও আবার ক্ষমতাধর কারও কন্যা, জায়া, জননী না হয়েও মৃত্যুর ৮৪ বছর পরও আলোচিত হন, বইয়ের পাতায় স্থান পান, সম্মানিত হন। কিন্তু এই যে ৯ ডিসেম্বরও রোকয়া স্মরণে দিবস যেটি নানাভাবে উদযাপিত হয়, সেখানে রোকেয়া কতখানি থাকেন? স্মরণের, উদযাপনের উদ্দেশ্য যদি হয় কোনো ব্যক্তির চেতনা, আদর্শ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া– তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তা কতখানি হচ্ছে রোকেয়াকে ঘিরে? আজ আমরা রোকেয়ার নামটুকু জেনেছি বটে; কিন্তু কতখানি ধারণ করছি তার আদর্শ? তাঁর চেতনা? তাঁর কাছে কী হবে আমাদের শিক্ষা?

এসব প্রশ্নের যথার্থ জবাব আমরা খুঁজি না। আজ তাই আমাদের আত্মজিঞ্জাসা: আমরা কি তবে রোকেয়া পাঠ যর্থাথভাবে, পূর্ণাঙ্গভাবে করছি?

এদিকে রোকেয়ার পরিচয়টাও ঘটছে নির্দিষ্ট একটি ছকে। রোকয়ার যে ফটোগ্রাফটা আমরা দেখি আর যে জীবনী পড়ি, যেসব লেখা আমাদের পাঠ্যে থাকে, সেসব থেকে তাঁর সম্ভ্রান্ত মুসলিম 'হেডমিস্ট্রেস-হেডমিস্ট্রেস' ইমেজে ধরা পড়ে; যিনি মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। রোকেয়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন, মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য জীবনব্যাপী কাজও করেছেন। কিন্তু এটুকুই কি রোকেয়া?

না, তিনি তা নন। তিনি একাধারে লেখক, সংগঠক, প্রগতিবাদী এবং বিপ্লবীও। তিনি তাঁর সময়ে নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামিকে নারীর প্রতি বৈষম্যের বড় কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। রোকেয়ার মতো আর কোনো নারী এত দুঃসাহস নিয়ে বলতে পারেন কি:

"ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।"

তাঁর বক্তব্যের পক্ষে যুক্তিও দেন:

"যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমণী শাসনের জন্য প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না।"

দৃঢ়কণ্ঠে রোকেয়া ঘোষণা করেন:

"আমরা আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের প্রভুত্ব সহিব না।"

এমন সব প্রথাবিরোধী, বিপ্লবী অবস্থান নেওয়ার পরও রোকেয়া কেন কেবলই 'নারীশিক্ষার অগ্রদূত' বা 'মুসলিম নারীজাগরণের পথিকৃত' হিসেবে ফ্রেমবন্দি হলেন? আবার রোকেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠার ইমেজ এমনভাবে রূপায়িত করা হয় যেন তিনিই প্রথম মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন।

বাস্তবে রোকেয়ার জন্মেরও সাত বছর আগে, ১৯৭৩ সালে কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা সেখানে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ১৯১১ সালে ভাগলপুর থেকে বিতাড়িত হয়ে রোকেয়া যখন দ্বিতীয়বারের মতো কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তখন মুসলমান মেয়েদের জন্য সেখানে আরও দুটি স্কুল ছিল। এর একটি করেছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব ফেরদৌস মহল। অপরটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মা, খুজিন্তা আখতার।

রোকেয়ার কালের অন্যতম প্রধান সমস্যা মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের অধিকার। রোকেয়া লিখেছেন, বলেছেন, এমনকি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি 'পাশ করা বিদ্যা' অথবা 'কোনো সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের অন্ধ অণুকরণ'কে শিক্ষা বলতে নারাজ। এমনকি তিনি জানতেন, যে শিক্ষা মেয়েদের 'মুর্ত্তিমতী কবিতা' হিসেবে নিজেকে তৈরি করে থাকে সে শিক্ষা নিয়ে নারীরা 'ষোলআনা স্বত্ব' ভোগের উপযুক্ত হয় না।

এ কারণে, তাঁর মতে, খ্রিস্টিয় সমাজে মেয়েরা শিক্ষার সুবিধা পেলেও তাদের মন দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় না। তাই তিনি তারিনী ভবনের স্কুলে–

"ছাত্রীদের দুই পাতা পড়িতে শিখাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাঁচে ঢালিয়া বিলাসিতার পুত্তলিকা গঠিত করা হয় না।… মিথ্যা ইতিহাস কণ্ঠস্থ করাইয়া তাহাদিগের নিজের দেশ এবং দেশবাসীকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা দেওয়া হয় না।"

অর্থাৎ রোকেয়া দাসত্বমুক্তির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাকে দেখেছেন। এ দাসত্ব গৃহ-দাসত্ব, ঔপনিবেশিকতার দাসত্ব, ধর্মের দাসত্ব, পুরুষের দাসত্ব। এসব দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে নারীর 'মানুষ' হয়ে ওঠার প্রচেষ্টার কথাই বার বার বলেছেন। পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হয়ে সমাজে ভুমিকা রাখার মধ্যেই নারীজীবনের স্বার্থকতা বলে মনে করেছেন তিনি।

গৃহ-দাসত্বমুক্ত পদ্মরাগের সকিনার জোর গলায় শোনা যায়:

"আমিও দেখাইতে চাই যে দেখ, তোমাদের 'ঘর করা' ছাড়া আমাদের আরও পথ আছে। স্বামীর ঘর করাই নারীজীবনের সার নহে। মানবজীবন খোদাতালার অপূর্ব দান– তাহা শুধু রাঁধা, উনুনে ফুঁপ পাড়া আর কাঁদার জন্য অপব্যয় করিবার জিনিস নহে।"

ঘর না করতে চাওয়াটাও যে নারীর অধিকার সে কথা কি আজকের দিনের সমাজ সহজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়? অথবা আমরা মেয়েরা যারা বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ নিচ্ছি নিজেদের কি পূর্ণাঙ্গ মানুষ ভাবতে পারছি? অণুকরণপ্রিয়তা, পণ্যপূজা বা মানসিক দাসত্ব– কোনটা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারছি? উঁচু বেতনের, উঁচু ক্ষমতার চাকুরীও করছি, কিন্তু দাসত্বমুক্তি মিলছে কি?

মিলছে না। মিলবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত মিলবে না যতক্ষণ না আমরা 'মৃত্যুর মতো নিস্ক্রিয় ক্লীব শান্তি' প্রত্যাখ্যান করতে পারি।

রোকেয়ো সব রকম উৎপাদন-বিমুখতার বিরোধিতা করেছেন। তিনি উৎপাদক কৃষকদের উন্নয়ন প্রত্যাশা করেছেন। তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, কেবল কলিকাতাটুকু গোটা ভারতবর্ষ নয়, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি সমস্ত ভারতের অধিবাসী নয়। বরং এখানের পাছায় ত্যানা জোটাতে না পারা চরম দরিদ্র কৃষকও আছেন। তাই তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন রংপুরের এন্ড্রি শিল্প বিকাশের। দেশি ও নারীবান্ধব এ শিল্প পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করার সময় সমাজের একটি শ্রেণি-বিশ্লেষণও করেন। রোকেয়া যে কতখানি বাস্তবমুখী ছিলেন তা তাঁর এ বিভাজনে আবারও সুস্পষ্ট হয়।

রোকেয়াকে অনেকে 'নারীবাদী' বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু তিনি পশ্চিমা নারীবাদের পথে হাঁটেননি। বরং উপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রামে নারীর শক্তিকে সমাবেশিত করার আহবান রেখেছেন। তিনি নারীর অধস্তনতাকে প্রথাগত চিরন্তন অধস্তন অবস্থা বলে স্বীকার করেননি। উল্টো এ সম্পর্কিত তাঁর ব্যাখ্যায় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কিছু প্রকাশ দেখা যায়।

"আদিমকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমরা এ রূপ দাসী ছিলাম না।"

রোকেয়া সুস্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন যে, সমাজের বিধি-ব্যবস্থা নারী-পুরুষের স্বার্থকে বিপরীতমুখী করে রাখে। তাই এ সমাজের নারীমুক্তির প্রশ্নকেও স্বদেশের উপযোগী করেই আলোচনা করেছেন। সমাধান খুঁজেছেন নিজ মাটিতে।

রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫টি। মাত্র ২৪ বছর বযসে (১৯০৪) তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'মতিচুর' প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় সর্বশেষ গ্রন্থ 'অবরোধবাসিনী' । সরল বোধগম্য অসাধারণ স্যাটায়ারও লিখেছেন তিনি। রোকেয়ার বক্তব্যে ধারালো এবং লক্ষ্যমুখী। তাঁর সব লেখা যেন পরস্পরের সঙ্গে গাঁথা। এক অভিন্ন চিন্তার প্রকাশ। রোকেয়ার 'সুলতানার স্বপ্ন' এর নারীস্থানের খানিক বাস্তবায়ন যেন 'পদ্মরাগ' এর তারিণী ভবনে দেখা যায়।

রোকেয়ার পুরো জীবনই এক অভিন্নতার সমষ্টি। সেই যে পায়রাবন্দেও বাড়িতে ভাইয়ের কাছে প্রথম পড়তে শেখা থেকে শুরু, এরপর বিয়ে, বিয়ের পর আরও সুস্পষ্ট করে চিন্তা করা এবং এক সময় কর্তব্য ঠিক করা। একান্তু ব্যক্তিগত জীবন রোকেয়া খুব একটা কাটাননি। যখন গৃহী ছিলেন তখন নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। পড়েছেন, লিখেছেন। কাজ করে গেছেন। রোকেয়ার একনিষ্ঠতা, দুর্দমনীয় সাহস, অধ্যবসায় তাঁকে মানুষ হিসেবে বিকশিত করেছে। 'পদ্মরাগ' এর সিদ্দিকার মতো নিজেকে সমাজের জন্য আদর্শ করে রাখতে চেষ্টা করেছেন যেন।

আজও সমাজে নারীর দাসত্ব ঘুচে যায়নি। দূর হয়নি মানসিক শৃঙ্খল। তাই রোকেয়ার পরিপূর্ণ চর্চা সমাজের জন্য বড় প্রয়োজন। মুসলিম নারীজাগরণের বা নারীশিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে রোকেয়ার যে খণ্ডিত, খর্বিত ইমেজ তা ভেঙ্গে বিপ্লবী রোকেয়ার প্রতিষ্ঠাই হবে সেই সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার।