মার্কিন রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা এবং ট্রাম্পের বিজয়

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 7 Dec 2016, 05:09 AM
Updated : 7 Dec 2016, 05:09 AM

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে প্রায় সব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার লাগাতার বিরোধী প্রচারণা এবং সব জনমত জরিপ ভুল প্রমাণিত করে ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জর্জ ওয়াশিংটন থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে যত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ট্রাম্প শুধু যে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি তা-ই নয়, তাঁদের সমন্বিত সম্পদের চেয়ে একা তাঁর সম্পদের পরিমাণও বেশি।

বয়স এবং সম্পদের দিক থেকেই যে ট্রাম্প নজিরবিহীন তা-ই নয়, এর চেয়েও বেশি যে কারণে তিনি মার্কিন ইতিহাসে নজিরবিহীন হয়ে রইবেন তা হল এবারই প্রথম একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ছোট-বড় শহরে ক্রমাগত ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। পাশাপাশি, বিক্ষোভকারীরা স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন ইলেকটোরাল কলেজের অধিবেশনে ট্রাম্পকে নির্বাচিত না করার জন্য, যাতে ইতোমধ্যে ৪৩ লাখের অধিক মানুষ স্বাক্ষর করেছে।

চলতি মাসের ১৯ তারিখে ইলেকটোরাল কলেজের যে অধিবেশন হবে, সেখানে ৫৩৮ জন ইলেকটর আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইলেকটররা যে দলের ব্যানারে নির্বাচিত হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে কোনো কোনো ইলেকটরের ভিন্ন দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার নজির থাকলেও সেটি কখনও মূল নির্বাচনকে প্রভাবিত করেনি। তত্ত্বগতভাবে ইলেকটররা যে কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে বা নির্বাচিত করতে পারে। এখন বিক্ষোভকারীরা ইলেকটরদের এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ট্রাম্পকে নির্বাচিত না করর আহবান জানাচ্ছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ট্রাম্প তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনে হিলারি ট্রাম্পের চেয়ে ২০ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন, যা কিনা শতকরা হিসাবে ট্রাম্পের চেয়ে ১.৫ শতাংশ বেশি। অবশ্য ট্রাম্পের অনুসারীদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের শুরু থেকেই ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে, যার কারণে হিলারি বেশি ভোট পেয়েছেন বলে তারা মনে করছে।

ভোট বেশি পেয়েও 'ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেম'-এর কারণে নির্বাচনে হারলেন হিলারি। ভোট কম পেয়েও ট্রাম্প যেখানে পেয়েছেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট, হিলারি বেশি ভোট পেয়েও পেয়েছেন ২৩২ ভোট। বাকি প্রার্থীদের কেউ কোনো ইলেকটোরাল ভোট পাননি; এমনকি লিবারেটেরিয়ান দলের গ্যারি জনসন ৪১ লাখের কাছাকাছি ভোট পেয়েও (যা প্রদত্ত ভোটের ৩.৩ শতাংশ) কোনো ইলেকটোরাল ভোট পাননি। বিক্ষোভকারীরা এ যুক্তিতে এখন হিলারিকে নির্বাচিত করার আহবান জানাচ্ছে যেহেতু অধিকাংশ জনগণ তাঁকে ভোট দিয়েছে।

ডেমোক্রেটিক পার্টির এবং অন্যান্য উদারনৈতিক (লিবারেল) ধারার বিক্ষোভকারী এবং বুদ্ধিজীবীরা এখন অনেক রাজ্যে ভোটে অনিয়ম হয়েছে অভিযোগ করে ভোট পুনঃগণনার দাবি তুলছেন। এদের কেউ কেউ যেসব রাজ্যে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট গণনা হয়েছে, সেসব রাজ্যে হ্যাকিংয়ের অভিযোগ এনে কোনোভাবে রাশিয়াকে এর সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল 'বাম-ঘেঁষা' উদারনৈতিক ধারার (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পড়ুন প্রগতিশীল ধারা) রাজনৈতিক দল, গ্রিন পার্টির আবেদনের প্রেক্ষিতে, যে দলটির প্রার্থী জিল স্টেইন নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন, উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে ভোটের পুনঃগণনা করা হবে। এর পাশাপাশি মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়ার ভোটও পুনঃগণনার দাবি উঠেছে।

শুধু তাই নয়, মূলধারার প্রায় সব মিডিয়াই উদারনৈতিক ধারার বিভিন্ন বক্তব্য সামনে এনে নির্বাচনকে একটি বিতর্কিত রূপ দিতে চাইছে, যেটিও কিনা মার্কিন ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ব্যাপার।

নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পর একটি বিষয় পরিস্কার যে, মার্কিন এশটাবলিশমেন্ট এবং ডান-উদারনৈতিক নির্বিশেষে প্রায় সব ধরনের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারছে না। দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল ধারার একজন প্রার্থীর নির্বাচনে বিজয়ে বাম-উদারনৈতিক ধারার মধ্যে অস্বস্তি হওয়া স্বভাবিক, কিন্তু মার্কিন এশটাবলিশমেন্ট এবং মিডিয়াসহ ডান ধারার মধ্যে এ অস্বস্তির কারণ কী? রক্ষণশীল ধারার এ উথানে যেখানে তাদের উৎফুল্ল হওয়ার কথা সেখানে তাদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তিভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে। তারা মনে করছে, ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসৃত মার্কসবাদীদের ভাষায় 'সাম্রাজ্যবাদি নীতি' থেকে সরে আসতে চাইছেন, যার ফলে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।

ডান ধারার এ অস্বস্তির সঙ্গে উদারনৈতিক ধারা হিসেবে যারা নিজেদের পরিচয় দেয় তাদের মধ্যেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলে দেশের আর্থ-সামাজিক ভবিষ্যৎ কী হবে– এ প্রশ্নে উদ্বেগ বিরাজ করছে। তারা আমেরিকায় বসবাসরত সব ধরনের সংখ্যালঘুদের (জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মীয়, নারী, এবং যৌন-আচরণগত) ভবিষৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ফলে এ দুই ধারাই ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়কে শুধু বিতর্কিত নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে চলে আসা ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আধুনিক গণতন্ত্রের পাইনিওয়ার মনে করা হলেও এখানকার প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হন না। পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা আমেরিকার আদিবাসীদের ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে পরাজিত করে স্থাপিত "Settler Colony"-কে রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হল আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৭৬ সালে তৎকালীন ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিজেদের ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বিছিন্ন করে স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীতদাস ব্যবসানির্ভর যে পুঁজিবাদের সূচনা, সে সময়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ক্রীতদাস ব্যাবসায়ীদের অধিকার মাথায় রেখে তৎকালীন আমেরিকার "Founding Fathers" যে সংবিধান প্রণয়ন করেন, সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতিটি ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে পরোক্ষ ভোটে নির্ধারণের ব্যবস্থা রাখা হয়। সংবিধানে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বলা হলেও তা ছিল মূলত শ্বেতাঙ্গ ও সম্পদশালী শ্রেণির। ফলে মার্কিন সংবিধানে ভোটাধিকার শুধুমাত্র সম্পদশালী শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছিল; শ্বেতাঙ্গ নারী, কৃষ্ণাঙ্গ এবং আদিবাসীদের (Native American) কোনো ভোটধিকার এ সংবিধানে ছিল না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের অধিকার পেতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

মার্কিন জনগোষ্ঠী তখন আজকের মতো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল না। জনসংখ্যা মূলত পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ, তাদের সঙ্গে আনা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস এবং আদিবাসী– এ তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা অধিবাসীরা আদিবাসীদের উপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন-নিপীড়ন চালায় তাতে তাদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এর ফলে আজকে তারা সার্বিক জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ।

প্রখ্যাত মার্কিন ঐতিহাসিক Howard Zinn তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'A People's History of the United States, 1492-Present'-এ আমেরিকার ইতিহাসকে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর অবস্থান থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি পশ্চিম ইউরোপের থেকে আগত অধিবাসী কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসীদের উপর যে ব্যাপক নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল তার বিবরণ দিয়েছেন। অবশ্য মূলধারার ঐতিহাসিকরা ব্যাপকহারে আদিবাসী হত্যার কথা স্বীকার করলেও 'গণহত্যা' শব্দটি ব্যবহার করতে চান না।

এই এক শতাংশ নেটিভ আমেরিকান আদিবাসীদের অনেকেই এখনও মনে করে, তাদের দেশ পশ্চিম ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের 'কলোনি' হয়ে রয়েছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৪৯২ সালে, যখন তাদের ভাষায় ইউরোপীয় আক্রমণকারী কলম্বাসের নেতৃত্বে ইউরোপিয়ানরা তাঁদের ভূখণ্ড দখল করতে শুরু করে। আদিবাসীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, যাদের বেশিরভাগই এখনও শহর থেকে অনেক দূরে বিভিন্ন রিজারভেশনে আলাদাভাবে বাস করে, তারা আমার কাছে এ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। অনেক নেটিভ আমেরিকান বুদ্ধিজীবী, তাদের বিভিন্ন সারির নেতৃত্বসহ ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠীও নিজেদের বর্তমান অবস্থাকে 'ঔপনিবেশিক অধীনতা' হিসেবেই দেখেন। তবে সবচেয়ে চমকে ওঠার মতো বক্তব্যটি শুনেছিলাম আদিবাসী নেত্রী Winona LaDuke এর মুখে, যিনি ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্রিন পার্টির প্রার্থী Ralph Nader এর রানিং-মেট ছিলেন, অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর বাবা আদিবাসী হলেও মা ইউরোপীয় ইহুদি।

LaDuke নির্বাচনের কিছুদিন পরে আমি অ্যারিজোনার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিলাম সেখানে এসেছিলেন। মিলনায়তনে সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রীর সামনে তিনি অকপটে শুধু আদিবাসীরা কী দৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখে শুধু যে তা নিয়েই বললেন তা-ই নয়, আমেরিকার Founding Fathers আদিবাসী সভ্যতা নির্মূলে ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করে তাঁদের নামে কোনো কিছুর নামকরণ করা উচিৎ নয় বলে জোর গলায় বললেন। কলম্বাসকে তিনি একজন 'ঠাণ্ডা মাথার খুনী' হিসেবে দেখেন, আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে নয়।

আমেরিকাতে কলম্বাস আসার বহু আগে থেকেই উন্নত সভ্যতার জনগোষ্ঠী বাস করে আসছে, যে সভ্যতা কলম্বাসের নেতৃত্বে ইউরোপীয়রা ধ্বংস করেছে বলে LaDuke মনে করেন। বক্তব্য শেষে তাঁর সঙ্গে অল্প সময় আমার আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল, তখন আমার পরিচয় পেয়ে বললেন, "যে ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আপনারা গিয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে আমরা এখনও যাচ্ছি।"

তত্ত্বগতভাবে উদারনৈতিক হওয়ার ফলে এবং পরবর্তীতে উদারনৈতিকতার চর্চার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি যে কোনো বিষয় নিয়ে এমনকি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি, Founding Fathers, আদালতের রায় বা ধর্ম নিয়ে বক্তব্য দিতে বা সমালোচনা করতে পারে এবং এতে রাষ্ট্র কোনো বাধা প্রদান করে না। রাষ্ট্র এখানে ব্যক্তির কথাকে নয়, কোনো কারণে যদি ব্যক্তিকে বিপজ্জনক মনে করে তখন সে ব্যক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে।

উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, Howard Zinn এর ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের 'সিভিল রাইটস' আন্দোলনে অংশগ্রহণের ফলে এফবিআইকে প্রয়োজন হলে Zinn কে গ্রেফতারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তেমনি 'শীতল যুদ্ধের' সময় 'ম্যাকার্থি আইন' করে বাম চিন্তাধারার অনেক শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং হাজার হাজার মার্কিন নাগরিককে কমিউনিস্ট সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ব্যাপকসংখ্যক পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসী, যাদের একটা বড় অংশ ছিল প্রান্তীয় জনগোষ্ঠী, অভিবাসী হয়ে আমেরিকাতে চলে আসে। তখনকার বর্ণবাদী অভিবাসী নীতিতে শুধুমাত্র ইউরোপ থেকে অভিবাসী হয়ে আসা উৎসাহিত করা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের ব্যাপক বিকাশের ফলে বিপুল সংখ্যায় শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হয়। এর পাশাপাশি তৈরি হয় বিশাল সার্ভিস সেক্টর। ফলে কল-কারখানা এবং সার্ভিস সেক্টরের চাহিদা মেটানোর জন্য সর্বজনীন অভিবাসী নীতিমালা গ্রহণ করা হয়; এতে করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিপুল জনগোষ্ঠী অভিবাসী হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসে।

এ ব্যাপক অভিবাসন সাদা-কালোয় বিভক্ত মার্কিন জনসমাজে শুধু যে 'ডেমোগ্রাফিক' পরিবর্তন এনেছে তা-ই নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যনির্ভর সংস্কৃতির সঙ্গে ইউরোপীয় সেকুলারিজমের মিশ্রণে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির চলে আসছিল তাতে ব্যাপক ধাক্কা দিয়েছে, যা কিনা প্রতিষ্ঠাকালীন সংবিধান প্রণেতাদের ধারণার বাইরে ছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন পুঁজিবাদ উদ্ভবের জেরে মাথা তোলা সম্পদশালী শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীনির্ভর ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থা আজকের বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীনির্ভর বিকশিত পুঁজিবাদী যুগে কতটা গণতান্ত্রিক বা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রতিফলিত করে– এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ এ নিয়ে পাঁচবার যিনি নির্বাচনে বেশি ভোট পেয়েছেন তিনি ইলেকটোরাল ভোট কম পাওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।

যে পুঁজিবাদ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়গান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় গেয়ে এসেছে সেই মুক্তবাজার অর্থনীতিই আজ দেশটির 'গলার ফাস' হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশটির জাতীয় ঋণ শিগগিরই ২১ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁতে যাচ্ছে, যা কিনা দেশটির সমগ্র জিডিপির চেয়ে অনেক বেশি। দেশটির বিপুলসংখ্যক 'ম্যানুফ্যাকচারিং জব' চলে গেছে গণচীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। মার্কসবাদী এবং নির্ভরশীল তাত্ত্বিকদের (Dependency Theorists) তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত করে বিকশিত পুঁজিবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব না হয়ে বরং পুঁজিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের অনান্য প্রান্তে, যা কিনা সেসব দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে।

অপরদিকে সেই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই 'ক্লাসিক্যাল' পুঁজিবাদী দেশগুলোর উন্নয়নের গতি শুধু শ্লথই করছে না, বরং শীর্ষস্থানীয় দেশের কাতার থেকে তাদের নিচে নামিয়ে আনার পরিবেশ তৈরি করে চলেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় পুঁজিবাদের সূচনা এবং গণচীনের পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথে অভিযাত্রা পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এ ধারণা দিয়েছিল যে, রাশিয়া ও চীনে পাশ্চাত্যের অধঃস্তন পুঁজিবাদ থাকবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে লাভবান করবে। এর ফলে এ দেশ দুটির পক্ষে কখনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবে না।

ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন জনসমাজে বিশেষত শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পুঁজিবাদ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি সম্পর্কে একটি ইতবাচক ধারণা রয়েছে। কারণ এর ফলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রাধান্যই বজায় থাকবে এমনটা মনে করা হচ্ছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের ফলে অনান্য রাষ্ট্রও যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রাধান্যশালী হয়ে উঠতে পারে– এটি ছিল সাধারণের ধারণার বাইরে।

মূলধারার মার্কিন সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য হল পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতার অদ্ভুত সমন্বয়, যেটিকে অপরিবর্তনীয় এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে আপামর জনমানসের প্রোথিত। এ রক্ষণশীলতার ফলেই মার্কিন প্রেসিডন্ট বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেন; ডলারে লেখা হয়েছে "আমরা গডে বিশ্বাস করি" এবং একমাত্র খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ছাড়া অন্য ধর্মালম্বী, এমনকি ইহুদি ধর্মালম্বীদের উৎসবেও কোনো সরকারি ছুটি থাকে না।

পুঁজিবাদের ক্রম বিকাশের ফলে পুঁজিবাদের কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে যেতে থাকার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী শ্রেণি যারা 'Blue- collar white working class' নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশ থেকে ভিন্ন ধর্মের অভিবাসীদের ক্রমাগত আগমন শুধুমাত্র খ্রিস্টীয় ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত এ শ্রমজীবি শ্রেণিকে করে তুলছে আতঙ্কিত। হিলারির পরাজয় দেখে যারা বিস্মিত হয়েছে, তারা হয়তো মিডিয়ার ক্রমাগত ট্রাম্পবিরোধী প্রচারণায় প্রভাবিত হয়েছিল, যার ফলে 'Blue-collar white working class', যারা আমেরিকার সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী, তাদের মনোভাব হয় বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি।

আমেরিকার আজকের দক্ষিণপন্থার উথানে মূল ভূমিকা এই শ্রমিক শ্রেণি পালন করেছে, যাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্কের বিষয়টি 'এক্সপ্লয়েট' করেই আজ ট্রাম্পের এ উত্থান।

আধুনিক পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতি বুঝতে অক্ষম এ শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী শ্রেণি মনে করছে, মার্কিন পুঁজিপতিরা দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থে নিজ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে বিনিয়োগ করছেন। ট্রাম্প নিজেই এ পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করলেও এবং বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করলেও নির্বাচনে তিনি তাঁর নিজের শ্রেণির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং সব ধরনের মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিয়ে সংরক্ষণমূলক অর্থনৈতিক নীতি নেওয়ার কথা বলেছেন, যা তাঁকে শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিয়েছে। পাশাপাশি ট্রাম্প চাইছেন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনতে। কারণ তিনি মনে করেন, এ সামরিক উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনীতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং রাজনৈতিকভাবেও দেশের জন্য তা কোনো সুফল বয়ে আনছে না।

শ্রমজীবী গোষ্ঠীর একটি বড় অংশও একইভাবে ভাবছে। যে বিষয়টি মার্কিন জনগোষ্ঠীকে অবাক করেছে তাহল 'নিওকন নীতি'র বিরোধিতা করে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষিণপন্থীদের এ নীতিই অনুসরণ করেছেন। তিনি এবং তাঁর প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে মদদ দিয়েছেন বলেও এ জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এর ফলে নির্বাচনে প্রচারণার সময় ট্রাম্প সরাসরি ওবামা এবং হিলারির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। পাশাপাশি খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলতাকে ধরে রাখার জন্য তিনি যেমন অভিবাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তেমনি অবস্থান নিয়েছেন গর্ভপাত, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং সমকামিতার বিরুদ্ধে।

বস্তুত, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ১৯২০ সালের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র যে 'বিচ্ছিনতাবাদী' নীতি অনুসরণ করত সেই নীতি গ্রহণ করতে চাইছেন ট্রাম্প। অর্থাৎ বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন গতিপ্রকৃতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখবার নীতি; আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুক্তবাজারের বিপরীতে সংরক্ষণবাদিতা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছেন খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলতার উপর। অপরদিকে তাঁর নিজ দলসহ যারা ট্রাম্পের নীতির বিরোধিতা করছে তারা মনে করছে এসব নীতির ফলে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব হারাবে এবং এতে চীন-রাশিয়াকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারে।

তবে আগামীদিনগুলোতে মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কী হবে– সেটি বোঝার জন্য আমাদের অন্তত ২০ জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; ওইদিন ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন।