আমাদের টেলিভিশন এবং এফটিপিওর পাঁচ দফা

খ ম হারূন
Published : 30 Nov 2016, 04:04 AM
Updated : 30 Nov 2016, 04:04 AM

আসুন আমরা সবাই মিলে গত ৫২ বছর ধরে বিকশিত হওয়া আমাদের সবার ভালোবাসায় ধন্য এ দেশের টেলিভিশন শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলি। সম্প্রতি এই শিল্প দারুণ হুমকির সম্মুখীন। আমরা নিজেরাই এ জন্য দায়ী। ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (এফটিপিও) তাই পাঁচ দফা দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এগিয়ে এসেছে টিভি চ্যানেল মালিক থেকে শুরু করে এই শিল্পে কর্মরত সবাই। সবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

কী আছে পাঁচ দফায়?

১. দেশের বেসরকারি চ্যানেলে বাংলায় ডাবকৃত বিদেশি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে।

এই দাবিটি সর্বাগ্রে এসেছে। একসময় আমরা বিটিভিতে অনেক নামকরা সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান দেখেছি। মনে করতে পারি 'ডালাস', 'রুটস', 'পেপারচেজ', 'মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ', 'ওসিন'-এর মতো অসাধারণ সব সিরিয়াল। কিন্তু সেগুলো 'ডাব' করা ছিল না, ইংরেজি ভাষাতেই দেখানো হত। অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের সেসব অনুষ্ঠান দেখতে উৎসাহিত করতেন।

সেই সময় ভারতে টিভি তথা সম্প্রচারমাধ্যম ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এখন প্রেক্ষাপটের বদল হয়েছে। ভারতে হাজার খানেক চ্যানেল এখন বাজার ধরতে ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রথম সারির বাংলা ও হিন্দি চ্যানেল আমাদের দেশে 'পে-চ্যানেল' হিসেবে সম্প্রচারিত হচ্ছে আর বছরে হাজার কোটি টাকা এ দেশের দর্শকদের খাজনা হিসেবে বিদেশে পাঠাতে হচ্ছে এ দেশেরই দুয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে একটি নতুন চ্যানেল একটি বিদেশি সিরিয়াল বাংলায় 'ডাব' করে আমাদের দেখাতে থাকে এবং সেটি যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ওই চ্যানেলে বাংলাদেশের কোনো প্রথম সারির নাট্যকার বা পরিচালকের কোনো ধারাবাহিক নেই। ভারতের তৃতীয় সারির নির্মাতাদের কিছু অনুষ্ঠান আছে; সেগুলো অবশ্য জনপ্রিয়তা পায়নি।

জনপ্রিয় বিদেশি ডাবকৃত অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা দেখে এখন অনেক চ্যানেলই একই পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে আমাদের দেশের টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত লক্ষাধিক কর্মী। প্রায় ৭০ শতাংশ প্রডাকসন হাউজ এখন বন্ধের পথে।

২. টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ, ক্রয় ও প্রচারের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট ও এজেন্সির হস্তক্ষেপ ব্যাতিত চ্যানেলের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

টিভি বা সম্প্রচারমাধ্যমে কাজ করছি তিন যুগের বেশি সময় ধরে। আর এক যুগের কাছাকাছি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে। এই মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য হল নানা ক্ষেত্রে পারদর্শী ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞ এক ছাতার তলে কাজ করে থাকেন। কেউ কারো কাজে অহেতুক হস্তক্ষেপ করেন না। অনুষ্ঠান বিভাগ নতুন নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে, নির্মাণ করে আর বিপণন বিভাগ সেসব অনুষ্ঠান থেকে অর্থ উপার্জন করে। বিজ্ঞাপনদাতা বা এজেন্সিগুলো ওই সব অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে নিজের পণ্যের প্রসার ঘটায়।

এখন আমরা দেখি এজেন্সিগুলোর নগ্ন হস্তক্ষেপ। তারা নিজেরাই এখন অনুষ্ঠান তৈরি করে থাকে বা বিদেশ থেকে তা এনে থাকে। এরপর সেগুলো টিভি চ্যানেলে কর্মরত বিপনন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা চ্যানেলে বিক্রি করে থাকে। বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ চ্যানেলের পাওনা টাকার প্রায় অর্ধেক বা তারও বেশি তাদের সরবরাহকৃত অনুষ্ঠানের মূল্যবাবদ সমন্বয় করে থাকে। এ ধরনের ব্যবসার ফলে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো আজ ধ্বংসের কাছাকাছি।

৩. টেলিভিশন শিল্পের সর্বক্ষেত্রে এআইটির ন্যূনতম ও যৌক্তিক হার পুনঃনির্ধারণ করতে হবে।

খুবই যৌক্তিক দাবি; মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

৪. দেশের টেলিভিশন শিল্পে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবৈধভাবে কাজ করা বন্ধ করতে হবে।

দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে বিদেশি শিল্পী বা কলাকুশলীদের কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন এখনও আছে। কিন্তু ওই সব নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে অবৈধ পন্থায় যখন বিদেশিরা এখানে কাজ করে তখন তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে বইকি।

৫. ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে।

এই বিষয়টি অতিব গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য মন্ত্রনালয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। এখন দেখার অপেক্ষায়।

আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এখনও ১০০টি চ্যানেল চলতে পারে, কিন্তু তার জন্য থাকতে হবে সুষ্ঠ পরিকল্পনা। আমরা যেমন দুর্বল পরিকল্পনার কারণে দর্শক হারাচ্ছি, অন্যদিকে ভারতীয় চ্যানেলগুলো তাদের কূট-পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের দর্শকদের আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশ শুধু দর্শকই হারাচ্ছে না, হারাচ্ছে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা। এই টাকা অনেকটা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার নামে, পে-চ্যানেলের ফি বাবদ।

আমরা টাকা দিয়ে ভারতীয় চ্যানেল দেখছি, অথচ বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল যখন ভারতে দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন বলা হয় ভারতীয় ক্যাবেল অপারেটরদের মোটা অংকের টাকা দিতে হবে। যে টাকা দেওয়ার সাধ্য আমাদের চ্যানেল মালিকদের নেই বললেই চলে।

একদিকে ভারতীয় চ্যানেল দেখার জন্য আমরা টাকা দিচ্ছি আমাদের ক্যাবেল অপারেটরদের মাধ্যমে ভারতীয় চ্যানেল মালিকদের, অন্যদিকে আমরা ভারতে আমাদের দর্শক সৃষ্টি করতে পারছি না সেখানকার ক্যাবেল অপারেটরদের আমরা টাকা দিতে পারছি না বলে। একেই কি বলে 'মিডিয়া বিজনেস'?

ভারতে বাংলা ভাষাভাষী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশ টেলিভিশনের দর্শক কিন্তু একসময় অনেক ছিল। টেরিস্টিরিয়াল টিভি হওয়া সত্ত্বেও ওই সব অঞ্চলে ১৯৭২ হতে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত 'দূরদর্শন'-এর চেয়ে 'বিটিভি'র জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি। আমাদের নাটক ও অনুষ্ঠান দেখার জন্য ভারতের বাঙালি দর্শকরা অপেক্ষা করে থাকত।

আমি মনে করি, বাংলাদেশে এখনও অনেক ভালো ভালো নাট্যকার, নির্মাতা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন। আমাদের চ্যানেলগুলো যদি ভারতে দেখানো হয় তবে পশ্চিমবাংলার বাংলা চ্যানেলগুলো দারুণভাবে দর্শক হারাবে। জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে যাবে আমাদের চ্যানেলগুলো।

ব্যবসায়ী পরিকল্পনায় ভারতীয়রা এগিয়ে আছে, কিন্তু টেলিভিশন ও নাট্যমাধ্যমে, সৃজনশীলতায় অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ।