ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল

Published : 24 Dec 2011, 05:52 AM
Updated : 24 Dec 2011, 05:52 AM

ঘোড়ার যুগ বহু আগেই অবসিত, ঘোড়াকে সরিয়ে এসে গেছে যন্ত্রে টানা গাড়ি। তার গতি অতীতের ঘোড়াদের লজ্জিত করতো। কিন্তু আমাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, এখন গাড়িতে চড়েও আমাদের হেঁটেই যেতে হয়। আমরা ঘন্টা ঘন্টা গাড়ির ভিতর বসে থাকি, সিগনাল বাতি একবার লাল হলে সবুজ হতে ভুলে যায়, প্রসন্ন প্রভাতের এ্যাপয়েন্টমেন্ট কাঠফাঁটা দুপুরে গিয়েও ধরা যায় না, হতাশার বিকেল নেমে আসে। কিছুদূর গিয়ে আমাদের পুর্নবার রওয়ানা হতে হয়। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা এখন এতটাই নাজুক, যানজট এত বেশী যে, কোথায় যেতে কত সময় লাগবে তা কেউ জানেনা, শহরের ভিতর কোন ট্রাভেল প্লান করা কঠিন, দু'দিকের যাত্রাতেই অতিরিক্ত সময় ধরে নিতে হয়, এই অতিরিক্ত সময় মূলযাত্রার দ্বিগুণ, কখনোবা তিনগুণ। প্রায়শঃই দেখি আমার ছাত্ররা ক্লাসে, এমনকি পরীক্ষাহলে দেরি করে প্রবেশ করে। জিজ্ঞেস করলে তাদের মুখস্ত উত্তর ঐ একটিই – যানজট। আর তাদের অবিশ্বাসইবা করি কীভাবে? একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলি।

এবার ডিসেম্বরের ১৪-১৬ এই তিন দিন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদযাপনে আলো ও শব্দের (Light & Sound) প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল কর্তৃপক্ষ। ১৫ তারিখে স্ত্রীকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে পৌনে ছয়টায় গাড়িতে বের হই, উদ্দেশ্য সন্ধ্যে সাতটার আতশবাজী দেখা। পথে নেমেই দাঁড়িয়ে পড়তে হল, কেননা গোটা বেগম রোকেয়া সরণি উৎসবমুখী মানুষ, তাদের বহনকারী নানা রকমের যানবাহনে ঠাঁসা – কী নেই তাতে; রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কার এমনকি ঠেলাগাড়িও রয়েছে, আর স্রোতের মত হাঁটছে মানুষ। যন্ত্র ও চাকার চেয়ে তাদেরকেই দ্রুতগতির মনে হল, এবং অবস্থাদৃষ্টে তাই ছিল ঘটনা। গাড়ির দল থেমে আছে বা পা পা করে এগুচ্ছে। মনে হল পৃথিবীর সব যান পথে আটকে গেছে, একটু পাশ ফেরারও অবকাশ নেই। বিজয় সরণির দু'পাশের দু'টি ট্রাফিক সিগনালে পাক্কা এক ঘন্টা সময় কাটল। ফার্মগেটে কুড়ি মিনিট, সোনারগাঁ, বাংলা মোটর, রূপসী বাংলা, শাহবাগ প্রতিটি মোড়েই দম বন্ধ হবার মত আঁটকে রইলাম, যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে নয়টা কুড়ি। আতশবাজী হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, শব্দের প্রতিধ্বনিও পৌঁছে গেছে নৈঃশব্দে।

উৎসবের দিনে এমনটা হওয়া অবশ্য বিচিত্র নয়, কেননা প্রচুর মানুষ বিশেষ দিনে রাস্তায় নেমে আসেন; অন্তরালবাসিনীরাও, যারা কেবল হেঁসেলে হাঁড়ি ঠেলেন, তারাও নেমে আসেন পথে, দেখা যায় দুধের শিশুদের, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার। সেই অর্থে আধঘন্টার পথ আড়াই ঘন্টায় পাড়ি দেবার একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যখ্যা দাঁড় করানো যায়, কিন্তু আড়াই না হোক স্বাভাবিক দিনেও ঐ একই পথ দেড়ঘন্টার কম সময়ে পাড়ি দেয়া যায় না। এমনিতেই ঢাকা হচ্ছে এক কোটি কুড়িলক্ষ মানুষের আবাসস্থল, তার উপর প্রতিদিন পঁচিশ লক্ষ লোক এ শহরে প্রবেশ করে আবার ফিরেও যায়। এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া! পৃথিবীর সবচেয়ে ঘসবসতিপূর্ণ দেশের রাজধানী হিসেবে সে সঙ্গতি বজায় রেখেছে, হয়ত বেশী মাত্রাতেই, কেননা গ্রামীণ বাংলাদেশে তবু কিছু পরিসর আছে, সেখানে এখনো বুকভরে শ্বাস নেয়া যায়, ঢাকায় সে পরিসর নেই। এখানে হাঁটতে গেলে অন্য মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়, কাঁধ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকে অপরাপর মানুষ; নিভৃতি, নির্জনতা শব্দগুলো অভিধানে মুখ লুকিয়েছে। এমনিতেই যানজটের কারণে ঢাকা প্রায় অচল, উৎসবের দিনে তা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সকল গ্রাহক যদি একদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে তাদের আমানত ফেরৎ চায়, তাহলে যেমন ঐদিনই ব্যাঙ্কটি ধসে পড়বে, ঢাকাও উৎসবের দিনে এমনি ধসে পড়ে। রাষ্ট্র যেভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়, ঢাকাও তেমনি ব্যর্থ হতে বসেছে।

ঘন্টা ঘন্টা যানজটে আটকা থেকে যে পরিমান জ্বালানী তেল পুড়ে যায়, মানুষের যে পরিমান শ্রমঘন্টা বিনষ্ট হয় তার আর্থিক ক্ষতির হিসাব আমরা মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রে দেখি, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন হিসাব তুলে ধরেন, তাদের কোনটিই কয়েক হাজার কোটি টাকার নিচে নয়। এ টাকা দিয়ে তৈরি করা যায় বহুদিন ধরে শোনা পাতাল রেল, উড়াল সেতু, মনোরেল, টানেল ইত্যাদি যা কিছু আমরা বানাতে চাই তার সব। আমরা কেবল বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শুনি, একদিন অভিমান করে পরি উড়ে চলে যায়, পড়ে থাকে শুধু কল্পনা। কেননা ঢাকার এই সমস্যা তো আজকের নয়, তা একদিনেও সৃষ্টি হয়নি। তাহলে আমাদের নগরবিদরা, ব্যাষ্টিক অর্থনীতির পরিকল্পনাকারীরা কী করলেন? অপর্যাপ্ত ও সরু রাস্তাঘাট (আবার সে রাস্তাতেই ভ্রাম্যমান দোকাটপাট, বাজার, গাড়ি পার্কিং, নির্মাণ সামগ্রী স্তূপীকৃত করে রাখা হচ্ছে) ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহন, ট্রাফিক আইন অমান্য করে চলার প্রবণতা, ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি – সব মিলিয়ে একটি ভয়াবহ অবস্থা যা আমাদের বহুদিন ধরেই ভোগাচ্ছে। অর্থনীতির বিকাশ ও ব্যাঙ্কগুলো থেকে সহজশর্তে কনজিউমার লোন প্রাপ্তির ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৪ সালে বিআরটিএতে সাড়ে একুশ হাজার যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছিল; ২০১০-এ তা পৌঁছায় প্রায় ছিয়াত্তর হাজারে। এখন পর্যন্ত মোট নিবন্ধিত যানবাহনের মোটসংখ্যা ছয়লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার; এর বাইরে রয়েছে প্রচুর নিবন্ধনহীন গাড়ি। ঢাকায় চলাচলের রাস্তা রয়েছে মাত্র ২২৩০ কিলোমিটার, যা রাজধানীর মোট আয়তনের মাত্র ৮ ভাগ: অথচ সুষ্ঠু ট্রাফিক চলাচলের জন্য প্রয়োজন ২৫% রাস্তা। আশ্চর্য ব্যপার হল, শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগ মানুষ চলাচলের জন্য কোন যানবাহন ব্যবহার করেন না, দারিদ্রের জন্যই তারা তা পারেন না, কিন্তু তাদের হাঁটার জন্য ফুটপাত রয়েছে মাত্র ২২০ কিলোমিটার। তাহলে দেখা যাচ্ছে শতকরা পঁয়ত্রিশ ভাগ মানুষ বহনকারী যানবাহনের ভীড়েই ঢাকার পথঘাটে উপচে পড়ছে; মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন হলে অবস্থা আরো নাজুক হবে। এই পঁয়ত্রিশ শতাংশের আবার ৬৫% চলাচল করে গণপরিবহনে অর্থাৎ বাসে।

আমি প্রথম কলকাতা যাই ১৯৮১ সালে, তখন সেখানে পাতালরেল নির্মিত হচ্ছিল, এমনিতেই যানজটে হাঁসফাঁস নগরী, তার উপরে পাতাল রেলের খোঁড়াখুঁড়ি। নাগরিকদের জীবনে তখন প্রাত্যহিক দুর্ভোগ। কিন্তু ১৯৮৪ সালে যখন পাতালরেলের প্রথম রুটটি চালু হল, কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে নেমে এল। জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ শহর হিসেবে কলকাতায়, এই ঢাকার মতই জনসংখ্যা বাড়ছিল, ফলে তারা দ্রুতই নির্মাণ করে ফেলে অনেকগুলো উড়ালসেতু, গঙ্গার উপরে নির্মাণ করে দ্বিতীয় হাওড়া সেতু। যখন আমরা সবেধন নীলমনি দু'টি উড়াল সেতু (এ দুটি আবার দুই শাসনামলের প্রতিনিধিত্ব করে) বানিয়ে দিগ্বিজয়ের আনন্দে নাচছি, সেটাকেই উন্নয়নের প্রতীক বলে বিজয়ধ্বজ্বা উড়াচ্ছি, তখন কলকাতায় অনেকগুলো উড়ালসেতু অনেকটা নীরবেই তৈরি হয়ে সহজ করে এনেছে কলকাতার অসহনীয় যানজট। ব্যাঙ্কককে একসময় সারা পৃথিবীর মানুষ জানত 'যানজটের নগরী' হিসেবে। ১৯৯২ সালে আমি যেবার প্রথম ব্যাঙ্কক যাই তখনই দেখেছি অনেকগুলো উড়াল সেতু নির্মাণাধীন। উড়ালসেতু, মনোরেল কেবল ব্যাঙ্ককের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় নি, দুষ্টক্ষতের মত চেপে বসা যানজটকে করেছে সহনীয়। ব্যাঙ্ককে আরেকটি চমৎকার সংযোজন হল বিভিন্ন ওয়াটার চ্যানেলে চলাচলকারী যন্ত্রচালিত জলযান, যেগুলো নাগরিকদের স্বল্পমূল্যে এবং জ্যামবিহীন পথে দ্রুতগতিতে নিয়ে যায়। গোটা দুনিয়া যখন বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত এবং জানা সমাধানগুলো ব্যবহার করে তাদের নাগরিকদের যাতায়াতকে সহজ ও দ্রুতগতির করে আনছে, আমরা তখনো আঁক কষছি, রূপারকাঁঠি-সোনারকাঁঠির গল্প শোনাচ্ছি। অবশ্য এ মূহুর্তে ঢাকায় তিনটি উড়ালসেতু নির্মাণাধীন, কাজও বেশ দ্রতগতিতে এগুচ্ছে, এগুতেই হবে, কেননা এগুলো হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার প্রতীক। বহুপ্রতিক্ষীত ও বহুপ্রতিশ্রুত পদ্মাসেতু নির্মাণে ব্যর্থ হবার ফলে এখন মুখরক্ষার জন্যই তাদেরকে এ তিনটি উড়ালসেতু দ্রুত বানিয়ে জনগণকে দেখাতে হবে, 'আমরাও পারি'।

নির্মাণাধীন উড়াল সেতু নিয়ে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। কেবল নির্মাণ প্রকৌশলের জটিলতা নয়, একটি জনবহুল ব্যস্ত শহরের নিত্যদিনের ট্রাফিককে চালু রেখে একটি উড়ালসেতু বা পাতালরেল নির্মাণ কারিগরী ও ব্যাবস্থাপনার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বনানী রেলক্রসিং এবং কুড়িল বিশ্বরোডে যে দুটি উড়ালসেতু নির্মিত হচ্ছে তাদের এই ব্যবস্থাপনা প্রশংসনীয়। কিন্তু গোল বাঁধায় জিয়া কলোনী সংলগ্ন গেটের মিলিটারী পুলিশ। সেখানে প্রবেশরত গাড়িগুলোকে অহেতুক প্রশ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখে, ফলে গাড়ির একটি সারি মূল সড়কের একটি অংশ দখল করে রেখে রাস্তাটিকে আরো সঙ্কীর্ণ করে ফেলে। সেদিন একটি নয়, তিনটি লাইন তৈরি হওয়ায় পুরো রাস্তাটিই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এয়ারপোর্ট বা টঙ্গীগামী সকল যানবাহন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে গাড়ির সারি যে রেললাইন ছাড়িয়ে চলে গেছে বহু দূর, সেনানিবাসের 'নিরাপত্তা' নিয়ে উদ্বিগ্ন মিলিটারী পুলিশের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনি সময়ে বেজে উঠল ট্রেন আসার সংকেত। তখনো লাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে একগাদা যানবাহন, মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। দুর্ঘটনাও ঘটতে পারত মারাত্মক। কিছু মানুষের, যার মধ্যে ট্রাফিক পুলিশও ছিল, তৎরতায় সে যাত্রা মারাত্মক কিছু ঘটেনি। মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা শহরের বিরাট অংশ জুড়ে অত্যন্ত আয়েশে ছড়িয়ে থাকা সেনানিবাসটি হয়ে উঠেছে যানজট সমাধানের একটি বড় প্রতিবন্ধক। যখন ঢাকার সীমানা ছিল পুরোনো বিমানবন্দর পর্যন্ত, তখন সেনানিবাসটি কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু এখন এটি শহরের প্রায় প্রাণকেন্দ্রে চলে এসেছে, আর যেহেতু সংরক্ষিত এলাকা, সেনানিবাসের আশে-পাশের নাগরিক এলাকাগুলোতে যাতায়াত বেশ অসুবিধাজনক। জিয়া কলোনী গেট থেকে মানিকদি পর্যন্ত উড়ালসেতুটি নির্মিত হলে মিলিটারী পুলিশের নিত্যদিনের জেরা থেকে মানিকদি, ইব্রাহীমপুর, কাফরুল ও মিরপুরের বেসাবমরিক জনগণ স্থায়ী রেহাই পাবেন।
ঐ যে বলেছিলাম প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ লক্ষ মানুষ কর্মোপলক্ষে ঢাকায় আসে এবং ফিরে যায়, সবাই কিন্তু যায়না। কিছু মানুষ আসেই থেকে যেতে, শহরের আত্মীয়বাড়িতে অনাদর, অবহেলা পাওয়া সত্ত্বেও থেকে যাওয়া গ্রাম্য অতিথির মত। এই সংখ্যাটি কত, কেউ তা জানেনা। সেদিন একজন নগরবিশেষজ্ঞ বল্লেন, এটি একটি ম্যাজিক সংখ্যা- ৩৩৩৩। দিন বা মাসভেদে এর কম-বেশী হতে পারে, তবে গড় হলো ঐ সংখ্যাটি। তাহলে প্রতিবছর ঢাকায় যোগ হচ্ছে বারো লক্ষ মানুষ। যদি দশ লক্ষও ধরি তবে দশ বছরে আরো এক কোটি মানুষ যুক্ত হতে যাচ্ছে ঢাকার জনসংখ্যায়। কেবল পথের যানজট নয়, এই বিপুল জনসংখ্যার ভার নিতে অক্ষম রাজধানী শহরটি। এর বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস পয়োঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম, ভেঙে পড়ছেও। পঁচিশ লক্ষ ভাসমান মানুষ প্রতিদিন কী বিপুল পরিমান বর্জ্য ফেলে যায় রাজধানীতে তা শিউড়ে উঠার মত পরিসংখ্যান! আশ্চর্য নয় যে দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা শহরগুলোর ভিতর ঢাকা দ্বিতীয়। এখানে কোন গণশৌচাগার নেই; নেই পর্যাপ্ত পার্ক বা খোলা জায়গা, যেখানে ভাসমান মানুষ বিশ্রাম নিতে পারে। সরকারগুলো ঢাকার উপর চাপ কমানোর কোন কার্যকরী উদ্যোগ নিচ্ছে না। এরশাদকে যতই স্বৈরাচারী বলে গাল দেয়া হোক না কেন, এরশাদই প্রথম ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণ করতে উদযোগী হয়েছিলেন। উপজেলা পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন প্রশাসন, আদালত, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মফস্বলে, গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ুক। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ঢাকা শহরের উপর জনসংখ্যার চাঁপ কমবে না, আর জনসংখ্যার চাঁপ না কমলে যানজটের কোন সুরাহা হবে না। আমরা যা কিছুই বানাবো, সবই ভাসিয়ে নেবে অতিরিক্ত জনতার সুনামী; যেভাবে মুদ্রাস্ফীতি প্রতিবছর আমাদের বাৎসরিক বেতনবৃদ্ধি খেয়ে ফেলে। দুর্ভাগ্য হল, এরশাদের পরে আর কোন সরকারই বিকেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটলেন না, যদিও তারা এ নিয়ে সেমিনারে, রাজনীতির ময়দানে প্রচুর কথা বললেন। ঢাকা শহরে পথঘাটের দর্শনীয় উন্নয়ন ঘটে এরশাদের শাসনামলে; বেগম রোকেয়া সরণী, বিজয় সরণী, নর্থ-সাউথ রোড, কুড়িল বিশ্বরোড তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যত সমালোচনাই থাকুক, সে আমলে নির্মিত হয়েছে পুরোনো এয়ারপোর্ট ঘিরে একটি চমৎকার সংযোগ-সড়ক, গর্বোদ্ধত র‌্যাংসভবন ভেঙ্গে তেজগাঁ সংযোগ-সড়ক এবং বনানী-গুলশান সংযোগ-সেতু। এগুলো নির্মিত না হলে যানজটের অবস্থা হত আরো করুণ, আরো ভয়াবহ।

ঢাকা শহরে রিকশা আছে চার লক্ষ। এই চার লক্ষ রিকশাচালকের প্রতিজনের পরিবারে যদি গড়পড়তা পাঁচজন সদস্য থাকে তবে বিশ লক্ষ মানুষ এই প্রাচীন বাহনটি ঘিরে ঢাকায় জীবনধারণ করে। গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা জনস্রোতের একটি মূল লক্ষ ঢাকায় এসে রিকশা চালানো, কেননা গ্রামে প্রাণধারণের মত কোন কাজ নেই। এছাড়া রয়েছে কয়েকশত গার্মেন্টস যেখানে কাজ করে কয়েক লক্ষ শ্রমিক। সুতরাং কেবল রিকশা আর গার্মেন্টস শিল্প ঢাকা থেকে সরিয়ে নিলে ঢাকার জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে। এমনিতেই আধুনিক সভ্যতার কোথাও রিকশা নেই, গতিশীল যানের সাথে এই শ্লথগতির, মানুষের কায়িকশ্রমে চালানো যানটি বেমানান। অনেকেই বলবেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের যাতায়াতের জন্য কম ভাড়ার রিকশার বিকল্প নেই, তবু বলব পর্যাপ্ত বাস সার্ভিস থাকলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর মানুষকে হাঁটার অভ্যাস রপ্ত করাতে হবে, দু'কদম যাবার জন্য সে যেন রিকশায় চড়ে না বসে। গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলো ঢাকার বাইরে নিয়ে গেলে যানজট অনেকটাই কমে আসবে, অনেকটা ঈদ-পরবর্তী ফাঁকা ঢাকার কাছাকাছি অবস্থা সৃষ্টি হবে।

রাজধানীর চারপাশের জেলা ও অঞ্চলসমূহের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ও সুলভ করা গেলে অনেক মানুষই নিজ নিজ বাড়ি থেকে সকালে ঢাকায় এসে অফিস করে বিকেলে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে সময়মত পৌঁছানো। আমি ভারতের যেস্থানে প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়ন করেছি, সেই খড়গপুর কলকাতা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত, ইলেকট্রিক ট্রেনে যেতে সময় লাগে দু'ঘন্টা কুড়ি মিনিট। ঐ দু'ঘন্টা কুড়ি মিনিটই, এর চেয়ে কম বা বেশী নয়। যখনই ভোরের ট্রেনে কলকাতা গিয়েছি তখনই দেখেছি অসংখ্য মানুষ, স্রোতের মত, ট্রেনে চড়ে কলকাতা যাচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা এরাই বিপরীতস্রোতে ফিরে আসতো খড়গপুরে। কলকাতায় বাড়িভাড়ার উচ্চমূল্য এসব স্বল্পউপার্জনের মানুষ বহন করতে পারেনা। তাদের জন্য চমৎকার বিকল্প ঐ নিজগৃহে বা মফস্বলে থেকে রাজধানীতে কাজ করা। কেবল খড়গপুর নয়, কলকাতার চর্তুপাশ ঘিরে থাকা অঞ্চলসমূহ – বনগাঁ, ডায়মণ্ড হারবার, দমদম, বাকুরা, আসানসোল প্রভৃতি এলাকা থেকে মানুষের স্রোত শিয়ালদহ এবং হাওড়া স্টেশনে এসে প্রভাতে নামছে আর সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছে। আশ্চর্য নয় যে শিয়ালদহ পৃথিবীর রেলস্টেশনগুলোর মাঝে ব্যস্ততম, হাওড়ার অবস্থান এর এক ধাপ নিচেই। ঢাকার চারপাশে এমনি দ্রুতগতির রেল চালু করা গেলে অসংখ্য কর্মজীবি মানুষ নারায়নগঞ্জ, ধামরাই, গাজীপুর, সাভার, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, প্রভৃতি এলাকা থেকে প্রতিদিন ঢাকায় এসে কাজ করতে পারত। কেবল এসব এলাকাই নয়, আরো দূরাঞ্চল – ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর থেকেও প্রতিদিন ঢাকায় এসে কাজ করা সম্ভব হত।

একে যানজট, তার উপরে গণপরিবহণের অপ্রতুলতা নগরবাসীকে ফেলেছে প্রতিদিনের অসহনীয় দুর্ভোগে। এর সুযোগ নিচ্ছে সিএনজি আর ট্যাক্সিক্যাবঅলারা। তারা দ্বিগুন, তিনগুণ ভাড়া তুলে নিচ্ছে অসহায় যাত্রীদের কাছে। মাঝে সিএনজিতে মিটার চালু করে সরকার একটি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে দু'বার প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার নিজেই নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠায় ইন্ধন জুগিয়েছে। এখন কোন সিএনজি চালকই বর্ধিত গ্যাসের দামের অজুহাতে মিটারে যায় না। মিটার চালু থাকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে দেখাবার জন্য, যাত্রীতে গুণতে হয় চালকের হাঁকানো নির্ধারিত ভাড়া। মহাখালীতে অবস্থিত আমার কর্মস্থল বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে মিরপুরে আমার বাসায় যেতে মিটারে পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা ওঠে, কোনদিন একশত কুড়ি টাকার নিচে যেতে পারিনি, আর রাশ আওয়ারেতো কথাই নেই, দাম উঠে যায় দু'শত টাকা পর্যন্ত। সম্প্রতি সরকার বিআরটিসির অনেকগুলো বাস ঢাকার রাস্তায় নামিয়েছে, যা একটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা বলে লালরঙের এ ঝকঝকে বাসগুলো বিকল হতে খুব বেশীদিন লাগবেনা; তারা যথারীতি অদৃশ্য হয়ে যাবে, পথে টিকে থাকবে ত্রিশ বছরের পুরোনো মুড়িরটিন বাসগুলো। (পাঠক স্মরণ করুন, অতিকায় হস্তী বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিঁকিয়া রহিয়াছে) এখন যেমন রাস্তায় সুপরিসর হলুদ ট্যাক্সীগুলো আর দেখা যায়না, কিন্তু নীল রঙের ছোট লক্কর-ঝক্কর মার্কা ট্যাক্সিগুলো ঠিকই দেখা যায়।

শহরের অভ্যন্তরে যানজট কমাতে হলে আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস টার্মিনালগুলো রাজধানীর প্রান্তে নিয়ে যেতে হবে, একইভাবে কমলাপুর রেলস্টেশনকে টঙ্গীতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। খোদ ঢাকার ভিতরে রেলক্রসিং আছে ৩০টি, যা দিয়ে প্রতিদিন ৮৪ বার ট্রেন যাতায়াত করে আর এসব ক্রসিংয়ে যানবাহন দাঁড়িয়ে দৈনিক অপচয় হয় আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময়। যদি কমলাপুরে রেলস্টেশন রাখতেই হয়, তবে প্রধান রেলক্রসিংগুলোতে উড়ালসেতু নির্মাণ প্রয়োজন। আন্তঃজেলা বাস বা ট্রেন শহরের বাইরে এসে থামবে, সেখান থেকে কমিউটার সার্ভিসের মাধ্যমে আগত লোকদের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছেন রাস্তার একটি অংশ এসব দ্রুতগতির কমিউটারের (Bus Rapid Transit) জন্য নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এতে একটি নয়, দুটি লম্বা বগী সংযোজিত থাকে, যাতে প্রতি ট্রিপে দ্বিগুণ মানুষ চলাচল করতে পারে। ঢাকার চারপাশে যে জলপথ আছে (মোট ১৭,৪০০ কিলোমিটার) তাকে ঐ ব্যাঙ্ককের মতই, ব্যবহার করে স্বল্পখরচে প্রচুর মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যায়। শুরু করেছে, তবে তা অচল হয়ে পরেছে। আর গড়ে তুলতে হবে রাজধানীকে ঘিরে চক্রাকার রেলপথ। প্রয়োজন বাণিজ্যিকএলাকা ও শপিংমলগুলোতে বহুতল বিশিষ্ট গাড়িপার্কিং জোন গড়ে তোলা। এসকল প্রকল্পই সরকার প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের (PPP)-র মাধ্যমে বা Build-Operate-Transfer (BOT)-র মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে নির্মাণ করতে পারে। এক্ষেত্রে মূলধন কোন সমস্যা নয়, সমস্যা হল সদিচ্ছা এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব।

অচল ঢাকাকে সচল রাখতে হলে, জাতীয় জীবন থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শ্রমঘন্টা হারিয়ে যেতে না চাইলে, জ্বালানী সংকটের দিনে মূল্যবান জ্বালানী সাশ্রয় করতে যানজট নিরসনের কোন বিকল্প নেই। মাত্রাতিরিক্ত যানজটের ফলে মানুষের যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, ক্রোধ সঞ্চারিত হয়, তার মানসিক মূল্যও কম নয়। এর প্রভাব গিয়ে পরে মানুষের আচরণে, তারা সামান্যতেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঢাকার বাতাস, বিশেষ করে পথঘাটের বাতাস বিষাক্ত, অথচ সেই বাতাসেই যানজটের কারণে নাগরিকদের শ্বাসগ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে দ্বিগুণ, তিনগুণ বেশী সময় ধরে। এতে বাড়ছে নাগরিকদের স্বাস্থ্যহানি এবং চিকিৎসা ব্যয়। ট্রাফিক জ্যাম আমাদের জীবনে এমনই স্থায়ী হয়ে আছে যে এ নিয়ে অনেক মজার ও করুণ গল্প তৈরি হয়েছে। এমনই একটি গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। বিয়েবাড়িতে দাওয়াত খেতে রওয়ানা হয়েছেন এক দম্পতি। পথে তারাও যথারীতি যানজটে আটকা পড়ে আছেন। হঠাৎ স্ত্রীর খেয়াল গেল স্বামীপ্রবরের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িভর্তি মুখের দিকে। 'একি তুমি শেভ করনি?' ভদ্রলোক আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, 'হ্যাঁ, করেছিলাম, ঐ যে বাসা থেকে বের হবার আগে।"

কামরুল হাসান:কবি, প্রাবন্ধিক ও বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।