নিহত পাবে না নিহত থাকার অধিকার?

সুমন রহমান
Published : 25 Dec 2011, 02:26 PM
Updated : 25 Dec 2011, 02:26 PM

ক্রসফায়ার তবু তো একটা স্বীকৃতি দিত, রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে নিহত হবার স্বীকৃতি! আমরা যারা রাষ্ট্রকে প্রায় ধর্ম আকারে মানি, আমাদের চিন্তার মধ্যে একটা পরিস্থিতি তৈরি হত এর ফলে: যুগপৎ ভীতির ও নীতির। একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে খুন করা যাবে কি যাবে না — এ নিয়ে আমরা তর্ক করেছি প্রতিবাদ করেছি — আর অন্যদিকে ক্রসফায়ার তার আপন গতিতে চলেছে। এভাবে চলতে চলতে এই প্রযুক্তি নিজেই এখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেছে, নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।

আমিনবাজারে ছয় ছাত্র পিটিয়ে মারার ঘটনাকে একটি লেখায় আমি "সামাজিক ক্রসফায়ার" হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলাম। এটা ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের ক্রসফায়ার: পুলিশি প্রযত্নে "জনতা" কর্তৃক হত্যা। এই "জনতা" কিন্তু আমজনতা নয়, আমজনতার ভিড়ে ব্যক্তিবিশেষ বা একটি গোষ্ঠী, সংঘবদ্ধতাকে যারা বর্ম হিসাবে ব্যবহার করে। আমিনবাজারের পর নোয়াখালিতে এক কিশোরকে পুলিশের ভ্যান থেকে উন্মত্ত "জনতা"র মধ্যে নামিয়ে দিয়ে মেরে ফেলতে বলা হয়েছিল। জনতা যতই 'উন্মত্ত' থাক, পুলিশের নির্দেশ বাস্তবায়নে বিন্দুমাত্র কসুর করে নাই!

ক্রসফায়ারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষত র‌্যাবের ভূমিকা দেশে ও বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট মহলে এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। তবে, "সামাজিক ক্রসফায়ার" সেই ভাবনার ফসল কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এটা মাঠপর্যায়ে পুলিশের লোকায়ত উদ্ভাবনাও হতে পারে। কিন্তু এই উদ্ভাবনা সংক্রামক। আমিনবাজার আর নোয়াখালির ঘটনার সাথে যোগ করুন প্রায়-প্রতিদিনকার "গণপিটুনিতে মৃত্যু" বিষয়ক খবরগুলো। প্রতিটি গণপিটুনি-মরণকে এখন "সামাজিক ক্রসফায়ার" হিসেবে সন্দেহ করার সঙ্গত কারণ আছে।

তবে, অপরাধী নিধনের প্রযুক্তি হিসাবে "সামাজিক ক্রসফায়ার" রাষ্ট্রের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়, যেহেতু এখানে রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে "জনতা"র কর্মাধীন হিসাবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে কেবল খুনের জন্যই খুন করছে তা তো না, বরং খুনের মাধ্যমে নাগরিককে রাষ্ট্রের অপরিমেয় ক্ষমতা সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। এটাই রাষ্ট্রের অন্তিম উদ্দেশ্য। "সামাজিক ক্রসফায়ারে" যেহেতু ক্রুদ্ধ জনতাকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়, ফলে নাগরিকের একাংশ হিসাবে সেও অপরিসীম সার্বভৌমত্ব উপভোগ করে, এবং এতে টোটালিটারিয়ান বা সর্ববাদী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কিছু হলেও খর্ব হয়। অন্যদিকে, হত্যার নির্বাহী ক্ষমতা পেয়ে যাওয়ার কারণে জনতারও ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকছে।

আজকাল যাকে বলা হচ্ছে 'গুপ্তহত্যা', তাকে তৃতীয় প্রজন্মের ক্রসফায়ার হিসাবে সন্দেহ করার যৌক্তিক কারণ আছে। এই প্রযুক্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর হয় লাশ পড়ে থাকে পোড়োভিটা বা জংলায়, নয়তো সিমেন্টের বস্তাসহ ভেসে ওঠে নদীর নিচ থেকে। কোনো কোনো লাশ আর কখনোই পাওয়া যায় না। ফলে লাশ পায় না নিহত হবার স্বীকৃতি, আবার 'হত্যাকারী'ও সোপর্দ হয় না আইনের হাতে। এমনি এক আবহমান অস্বীকৃতির ভেতর গুপ্তহত্যার একেকটা এপিসোড মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে।
গুপ্তহত্যা বা গুমখুনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য থাকলেও "ফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স" বা কাউকে অদৃশ্য করে দেয়ার কৌশলটি লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে গত শতকের সত্তর দশকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, "ফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স" বা কাউকে অদৃশ্য করে দেয়ার ঘটনাটি তখনই ঘটে, যখন:
রাষ্ট্র বা কোন রাজনৈতিক সংগঠন অথবা তাদের কোন একজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদপুষ্ট কোনো তৃতীয় পক্ষ যখনই কাউকে বলপূর্বক গোপনে ধরে নিয়ে যায় এবং আটকে রাখে, এবং সে বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রদান করে না, যাতে করে আটকে থাকা ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিতে পারে। [উইকিপিডিয়া, ফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স]

উইকিপিডিয়া আরো লিখেছে, কাউকে অদৃশ্য করে দেয়ার অব্যবহিত পরের ঘটনাটিই হল তাকে খুন করা। এক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিকে প্রথমে নির্যাতন করা হয়, তারপর খুন করে লাশ গায়েব করে দেয়া হয়। এই হত্যার দায়দায়িত্ব কেউ স্বীকার করে না, ফলে চিরকালের জন্য "অদৃশ্য" থেকে যায়।

গুপ্তহত্যার এহেন ঐতিহাসিক দশার সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গুমখুনের সাযুজ্য ভাববার মত। তবু মৌলিক একটা ফারাক আছে: বাংলাদেশে এটি ঘটছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, লাতিনীয় একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থায় নয়। ফলে এই গুমখুন বরং আরো ভয়াবহ, যদি রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে থাকে তার পেছনে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন তিনি "পত্রিকা পড়ে" গুপ্তহত্যার খবর জানতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এটা বিরোধী দলের কারসাজি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, "গুপ্তহত্যা" শব্দটির ব্যবহারই নাকি দুরভিসন্ধিমূলক! অবশ্য তিনি বিকল্প কোনো নাম প্রস্তাব করেছেন বলে জানা যায় নি এখন পর্যন্ত। উপরন্তু, গুপ্তহত্যা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনির ঢিলেঢালা হাবভাবে মনেই হয় না এটা কোনো গুরুতর সমস্যা। বরং তাদেরকে লাশ 'উদ্ধার'এর জন্য বাহবা দিতে চাইছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই গুপ্তহত্যার সাথে সরকার জড়িত নয়, তাহলে কী দাঁড়ায়? তাহলে যা দাঁড়ায় তা হল, দেশে সরকারের সমান্তরাল ক্ষমতার অধিকারী গোষ্ঠী নির্বিচারে নাগরিক হত্যার মত নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে একের পর এক। সরকার সেটা অনুমান আকারে জানাতে পারছে, এখন পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারে নি, কেবল একটা তদন্তের আশ্বাস ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া। এটা কি সরকারের জন্য বরং বেশি বিব্রতকর নয়? যতদিন না গুমখুন রহস্যের কিনারা হবে, ততদিন পর্যন্ত এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে ছাড়া জনগণ আর কাকে দায়ী করবে?

ইত্যবসরে, কিছু কিছু বিষয় নিশ্চয়ই লক্ষ্য করার আছে। গুপ্তহত্যার যারা ভিক্টিম, তাদের অতীত-অপরাধের বিশদ বিবরণ এখন আর গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে না। এটি প্রথম প্রজন্মের ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে প্রায় অবধারিত ছিল। ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তির অপরাধের তালিকা প্রচারের মাধ্যমে গণমাধ্যমে ক্রসফায়ার-হেজিমনি তৈরির একটা প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের ছিল। ক্রসফায়ার নিয়ে শিক্ষিত নাগরিকের দ্বিধাদীর্ণ অবস্থান ইতোমধ্যেই এই হেজিমনিকে শক্ত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখন ক্রসফায়ার-হতের অপরাধের তালিকা ক্ষীণতর হয়ে আসলেও সমস্যা নেই। ফরিদপুরের গুম হয়ে যাওয়া পাঁচজন কোনো ভয়ানক অপরাধী কিনা এ বিষয়ে স্থানীয় থানায় কোনো তথ্য নেই। তারা "জ্বিনের ব্যবসা"র মাধ্যমে মানুষকে প্রতারণা করত, এমনটাই জানা গেছে। প্রতারণার শাস্তিও তবে মৃত্যুদণ্ড?

ক্রসফায়ার বাংলাদেশে প্রযুক্ত হয় কথিত সর্বহারা চরমপন্থীদের বিরূদ্ধে। সেটা সহজ ছিল, কারণ সর্বহারা একটি ইতিহাস-মীমাংসিত গোষ্ঠী, একটি বিগত বাস্তবতার নাম। তাদের কাছে বৃহত্তর সমাজ বা রাজনীতি কোনোরকম বিপ্লবী সম্ভাবনার প্রত্যাশা করে, এমন আর মনে হয় না। উপরন্তু, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে জনসমাজে ও গণমাধ্যমে তাদের নেতিবাচক ভাবমূর্তিই বর্তমান। এমন একটি গোষ্ঠীকে ক্রসফায়ারের পয়লা চাঁদমারি করায় কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রতিবাদের গলা তখনি উঁচু হতে শুরু করেছে, যখন ক্রসফায়ার সর্বহারা চরমপন্থীদের মত মিমাংসিত অতীত ছেড়ে অমিমাংসিত বর্তমানের বলয়ে ঢুকতে শুরু করেছে।

গুপ্তহত্যা যদি সত্যিসত্যিই তৃতীয় প্রজন্মের ক্রসফায়ার হয়, তবে তার বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ধেয়ে আসছে সে নগর মধ্যবিত্তের বিপজ্জনক নৈকট্যে। এখন তার শিকার সর্বহারার মত কোনো বিশেষায়িত গোষ্ঠী শুধু নয়, বরং মূলধারার রাজনৈতিক দলের কর্তাপদে থাকা ব্যক্তিও। আবার সেই ব্যক্তির আমলনামা গণমাধ্যমে প্রকাশিত না থাকায় আশঙ্কা থেকেই যায় যে, এই খুন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলাফল কিনা। আমলনামা প্রকাশিত থাকলেই খুন জায়েজ হয় না, কিন্তু সেভাবে জায়েজ করার একটা রাষ্ট্রীয় চল ছিল। এখন সেটাও দেখা যাচ্ছে না।

যাদের লাশ ধলেশ্বরীতে মিলল, তাদের অপহরণের পর জনৈক টুণ্ডা রহিম র‌্যাবের সোর্স পরিচয় দিয়ে এদের প্রত্যেকের পরিবারের কাছে ফোন করে টাকা চেয়েছে বলে সংবাদ এসেছে (প্রথম আলো, ১৩ ডিসেম্বর)। র‌্যাব এর সাথে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে, এবং জানিয়েছে টুণ্ডা রহিম নামে তাদের কোনো সোর্স নেই। কিন্তু টুণ্ডা রহিমকে তার কৃতকর্মের জন্য আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে এমন জানা যায়নি। ঘটনাটি ছোট্ট, কিন্তু এর মধ্যেই পরবর্তী প্রজন্মের ক্রসফায়ার কেমন আকৃতি নেবে তার ইংগিত আছে।

সব মিলিয়ে চিত্রটা যেমন আতঙ্কের, তেমনি হতাশারও। ক্রসফায়ারের সত্য যুগে আশা ছিল, এই হত্যাযজ্ঞের বিরূদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিবেককে জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে। ত্রেতা গেল দ্বাপর গেল, দরজায় কড়া নাড়ছে ক্রসফায়ারের কলিযুগ, এখন তো ক্রসফায়ারকে আর ক্রসফায়ার হিসেবেই চেনা যাচ্ছে না! নিহত হারিয়েছে নিহত থাকার অধিকার, আর লাশবঞ্চিত পরিবার বোনাস হিসাবে পাচ্ছে হৃদয়ছেঁড়া চিরকালীন সংশয়: মরেছে কি মরে নাই, বুঝিব কেমনে?

সুমন রহমান: কবি ও প্রাবন্ধিক।