শুধু রাজনীতি বা প্রশাসনে নয়, বিচার ব্যবস্থায়ও স্বাধীনতাবিরোধীরা কাম্য নয়

তুরিন আফরোজ
Published : 23 Nov 2016, 05:07 AM
Updated : 23 Nov 2016, 05:07 AM

বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের বুকে প্রথম রাষ্ট্র যেটি সার্থকভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Right of Self-determination) প্রতিষ্ঠা করে একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের পূর্বে মাত্র দুবার বিশ্বের ইতিহাসে এই ঘটনা ঘটে, তবে তা সার্থকতা লাভ করতে পারেনি।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে আফ্রিকার কঙ্গোতে। ১৯৬০ সালের ১০ জুলাই কঙ্গোর অভ্যন্তরীন কাতাঙ্গা, কঙ্গো থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। কিন্তু মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে কাতাঙ্গা তার স্বাধীনতা বর্জন করে কঙ্গোর সঙ্গে একত্রীভূত হয়।

ঠিক একইভাবে ১৯৬৭ সালের ৩০ মে নাইজেরিয়ার অধীনস্ত বায়াফ্রা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। বিশ্বের ৫টি রাষ্ট্র, গ্যাবন, হাইতি, আইভরি কোস্ট, তাঞ্জানিয়া ও জাম্বিয়া বায়াফ্রাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়। কিন্তু কাতাঙ্গার মতোই প্রায় পৌনে তিন বছরের দিকে বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার সঙ্গে একত্রীভূত হয়ে নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের অন্তভুক্ত পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই স্বাধীনতার জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ৩০ লক্ষ শহীদকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ৫ লক্ষ মা-বোন হয়েছেন ধর্ষিতা। লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক কোটির বেশি মানুষ বাধ্য হয়েছেন উদ্বাস্তু হিসেবে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে। তাদের একমাত্র চাওয়া ছিল স্বাধীনতা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। সুতরাং আমাদের স্বাধীনতা অনেক দাম দিয়ে কেনা। আমাদের সংবিধান শহীদের রক্তস্নাত– বীরাঙ্গনা মায়ের গুমরে-ওঠা কান্না আর নির্যাতনের ফলশ্রুতি।

পঁয়তাল্লিশ বছর পর সময় এসেছে প্রশ্ন তুলবার, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনীতি বা প্রশাসনে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না। উত্তর নিঃসন্দেহে, 'না'। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ক্ষতিকর প্রজন্ম তৈরি করবে, জাতির ভিতরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। আর প্রশাসনে যদি স্বাধীনতাবিরোধীরা বসে থাকে তবে রাষ্ট্রের উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

এই অমোঘ সত্য যদি আমরা সকলে মেনে নিই এবং দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করি তবে আমার প্রশ্ন হল, আমাদের রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় কি স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিবর্গ বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন? আর যদি কখনও করে থাকেন তবে তার দায়ভার কে নেবে? অথবা কখনও কি কেউ নিয়েছেন?

আসুন ইতিহাস ঘুরে আসি।

১.

সময়টা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, সন্ধ্যা ৬টা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের সহযোগী হয়ে জাতির পিতার রক্তের উপর দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর এবং নির্লজ্জভাবে মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান পদদলিত করে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী অবৈধ, বেআইনি এবং অসাংবিধানিকভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ কি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর এহেন অবৈধ, বেআইনি এবং অসংবিধানিক কর্মকাণ্ডের দায়ভার সেই সময় গ্রহণ করেছিলেন?

২.

১৯৭৫ সালেরই ১৬ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর। ১৫ আগস্টে জাতির পিতা এবং ৩ নভেম্বরে কারাগারে আটক চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর দেশ যখন সাংবিধানিক সংকটে নিপতিত হলে আমাদের তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট এবং এর বিচারকবর্গ সংবিধান রক্ষা এবং এর নিরাপত্তা বিধান করতে ব্যর্থ হন। সে সময় সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ক্ষমতা দখলদারের বিরূদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ কি সেই সময় এই ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন?

৩.

আবার ১৯৭৫ সাল। ৮ নভেম্বর। তৎকালীন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। যেখানে বিচারপতিগণ সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন বলে শপথ গ্রহণ করেন, সেখানে আমরা দেখলাম তৎকালীন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সংবিধান ও আইনের চরম লঙ্ঘন করে অসবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ সেদিন কীভাবে এই অবৈধ পদ দখলের বিষয়টির মূল্যায়ন করেছিলেন?

৪.

সময় ১৯৭৮ সাল। হালিমা খাতুন বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি ফজলে মুনিম সংবিধানকে সামরিক ফরমানের নিচে স্থান দেন। তিনি বলেন:

"No constitutional Provision can claim to be sacrosanct and immutable, the present Constitutional provision may, however, claim superiority to any law other than a regulation or orders made under the proclamation."

অর্থাৎ তাঁর মতে–

"বাংলাদেশের সংবিধানের কোনো অংশই অলঙ্ঘনীয় বা অপরিবর্তনীয় নয়; সংবিধান যে কোনো আইনের উর্ধ্বে হলেও, সামরিক ফরমানের উর্ধ্বে নয়।"

এই যে সাংবিধানিক প্রাধান্য হেয় করে অসংবিধানিক সামরিক ফরমানকে সকল আইনের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হল, সে ব্যপারে আমাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ সেদিন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল কি? সঠিক প্রতিক্রিয়া পেতে আমাদের সপ্তম সংশোধনী বাতিল মামলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, অর্থাৎ ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় প্রতীক্ষা করতে হয়েছে।

৫.

১৯৮০ সাল। রাষ্ট্র বনাম হাজী জয়নাল আবেদীন মামলায় আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি রুহুল ইসলামও সংবিধানকে সামরিক ফরমানের নিচে স্থান দেন। তিনি বলেন:

"I find it difficult to accept …. that the Constitution as such still in force as the supreme law of the country, untrammeled by the Proclamation and Martial Law Regulation."

অর্থাৎ তাঁর মতে–

"সামরিক ফরমান ও সামরিক আইনের বিধি-বিধান সাপেক্ষে আমাদের সংবিধান কখনও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বলে গণ্য হতে পারে না।"

আমাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা কেন সেদিন সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষায় সরব হল না? আবারও ত্রিশ বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল আমাদের সপ্তম সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ের জন্য।

৬.

আবার ১৯৮০ সাল। নাসিরুদ্দিন বনাম বাংলাদেশ মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন এই মর্মে সিদ্ধান্ত দেন যে, সামরিক আদালতের সিদ্ধান্ত সংবিধানের আইনের উর্ধ্বে।

সেদিনও সাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। আর সত্য কথাটি উচ্চারিত হতে আবারও জাতিকে তিন দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ের জন্য।

৭.

এবার ১৯৮৯ সাল। আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলায় তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন যে, ১৯৭৫ পরবর্তী সকল অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ড মূলত আমাদের সাংবিধানিক ইতিহাসেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থাৎ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সংবিধান লঙ্ঘন তেমন কোনো বিষয় নয়। কী অদ্ভূত অবস্থান! এখানেও সেদিন নিশ্চুপ আমাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ। প্রায় বিশ বছর পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সপ্তম সংশোধনী বাতিল মামলায় বলেন:

"The constitution is the supreme law and it's any violation is void and illegal and remains so for all time to come."

অর্থাৎ,

"সংবিধানই হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন এবং এর লঙ্ঘন যে কোনো সময় বাতিল এবং অবৈধ বলে গণ্য হবে।"

আমাদের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের সংবিধানের আধার। পরাধীনতার বেড়াজাল ছিঁড়ে স্বাধীনতা অর্জন করে এই সংবিধান আমরা নিজেরাই নিজেদের উপহার দিয়েছি। সুতরাং আমাদের মাঝে যে বা যারা সংবিধান লঙ্ঘন করবে, তাকে বা তাদেরকে আমরা নিঃসন্দেহে স্বাধীনতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করতে পারি।

কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘনের ব্যাপারটি যখন বিচার ব্যবস্থা করে থাকে, তখন আমাদের প্রতিকার কী হবে? আমরা কি বিশ কী ত্রিশ বছর অপেক্ষা করব কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য যখন কোনো এক পরবর্তী মামলায় অতীতের বিচার ব্যবস্থার সাংবিধানিক লঙ্ঘনের বিষয়ে ধিক্কার জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালত প্রদত্ত কোনো রায়ে তা উল্লিখিত হবে? নাকি আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার সাংবিধানিক লঙ্ঘনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিকার খুঁজে পাব?

সবচাইতে বড় কথা, আমাদের বিচারিক ব্যবস্থায় যদি স্বাধীনতাবিরোধী নিউক্লিয়াস দানা বেঁধে উঠতে থাকে, তবে তার নির্মূলের দায়িত্ব কে পালন করবেন? অসাংবিধানিক উপায়ে গঠনকৃত কোনো সংগঠন বা সংস্থা? নাকি সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেন্টের অধিকারী কোনো ফোরাম?