মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়ন: প্রশ্নটি ধর্মের নয়, মানবতার

Published : 22 Nov 2016, 04:29 AM
Updated : 22 Nov 2016, 04:29 AM

মিয়ানমার সীমান্তের তিনটি চেকপোস্টে গত ৯ অক্টোবর অস্ত্রধারীদের হামলায় সে দেশের নয়জন পুলিশ নিহত হয়। ওই ঘটনার পর থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক দমন-পীড়নের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। বিশ্ব মিডিয়া রাখাইন রাজ্যে প্রবেশ করতে না পারায় সেখানে ঠিক কী হচ্ছে তা বলা মুশকিল। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাত অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনী 'শুদ্ধি অভিযান' চালাচ্ছে। সেনাবাহিনীর দাবি, উগ্রপন্থী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রবাসী ইসলামপন্থীদেরও যোগসাজশ রয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির রিপোর্ট অনুযায়ী চেকপোস্টে অস্ত্রধারীদের হামলায় ঘটনার পর থেকে কথিত হামলাকারীদের খুঁজে বের করার অভিযানে অন্তত ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, চলমান সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। অর্থাৎ রোহিঙ্গা নিপীড়ন করতে গিয়ে মানবতাবিরোধী যত প্রকার অপরাধ এর সবটাই করছে বলে অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

জঙ্গি বা সন্ত্রাসী দমনের নামে একজন সাধারণ মানুষও যদি নিহত হয় সেটাও ঘোর অন্যায় এবং মানবাধিকারের ঘোর লঙ্ঘন। এমনকি কোনো দেশে অবস্থান নেওয়া কোনো অবৈধ ব্যক্তিকেও হত্যা করা যায় না। মিয়ানমার স্বীকার করুক বা না-ই করুক রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবে সে দেশের অধিবাসী। অধিবাসী না হলেও হত্যা কিংবা নির্যাতন করা যাবে না।

রোহিঙ্গারা আদতে কোন দেশের এই সমস্যার সুরাহা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; যদিও সময় কম গড়ায়নি। তবে এই সমস্যার সুরাহা করতে হবে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশকে যৌথ উদ্যোগে। কারণ মিয়ানমার বলছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে। তাই বাংলাদেশ একেবারে চুপ থাকতে পারে না। কূটনৈতিক শিষ্টাচার এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা উচিত। প্রয়োজনে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধান চাইলে বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমার যে কোনো এক পক্ষকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দুই পক্ষ একযোগে কাজ করলে বিষয়টি আরও সহজ হবে বইকি। তবে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে বলে রোহিঙ্গা সমস্যা বিনা উদ্যোগে অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে– এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের দেশে যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতি হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠদের কথা মাথায় রেখে রাজনীতি করতে হয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অধিকারের ক্ষেত্রেও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির দিকে তাকিয়ে কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না; এমনকি তাঁর নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নিলেও না।

রোহিঙ্গরা কোন দেশের সেটা স্থির করতে পারলে চিহ্নিত রাষ্ট্র তাদের দায়দায়িত্ব নেবে। কিন্তু যতদিন না এই সমস্যার সঠিক সমাধান হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হতে হবে। এ পর্যন্ত যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তারা সবাই নিশ্চয়ই জঙ্গি নয়। সব রোহিঙ্গা তো জঙ্গি হতে পারে না। দমন-পীড়নের পর থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। মিয়ানমার এ বিষয়টাও অস্বীকার করছে। মিয়ানমার এখনও বলছে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করা হচ্ছে না। তাহলে তারা পালিয়ে আসছে কেন? ২০১২ সালের পর থেকে এতদিন তো দল বেঁধে গণহারে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেনি।

রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় মানছি, তাই বলে তাদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। বিশেষ করে জাতিসংঘকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার এবং দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করতে হবে।

বিশ্বময় মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের উপর যতটা আন্তর্জাতিক অনুরোধ এবং চাপ আছে ততটা মিয়ানমারের উপর আছে বলে মনে হয় না।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যাটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও রোহিঙ্গা নির্যাতন বিষয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের। বিষয়টি ধর্মের নয়, মানবতার। বিষয়টি ধর্মের হলে আমি বলব, মহামতি গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, "জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।"

জগতের সব প্রাণীর মধ্যে নির্যাতিত রোহিঙ্গারাও আছে। বৌদ্ধদের পঞ্চশীলের প্রথম শীল হল, "প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।" মানুষ তো দূরের কথা কোনো কীট-পতঙ্গকেও হত্যা করা যাবে না।

বুদ্ধ করণীয় মৈত্রী সূত্রে বলেছেন, "দিট্ঠা বা য়েব অদিট্ঠা য়ে চ দূরে বসন্তি অবিদূরে, ভূতা বা সম্ভবেসা বা সব্বে সত্তা ভবন্ত সুখিত'ত্তা।" অর্থাৎ যেসব প্রাণী দৃশ্য-অদৃশ্য, দূরে-কাছে বাস করে, যারা জন্ম গ্রহণ করেছে, যারা জন্ম গ্রহণ করেনি, যারা মাতৃগর্ভে অথবা ডিম্বের ভেতরে আছে, সেখান থেকে বহির্গত হবে তারা সবাই সুখী হোক।

আরও বলা হয়েছে, "মাতা য়থা নিয়ং পুত্তং আয়ুুসা এক পুত্ত মনুরক্খে, এবম্পি সব্বভুতেসু মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণং।" অর্থাৎ মা যেমন তাঁর নিজের জীবন দিয়ে হলেও একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করেন, তদ্রুপ সব প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী পোষণ করবে।

মিয়ানমার এবং সে দেশের জনগণ বুদ্ধের বাণীকে মান্য করলে কিছুতেই এমন মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে পারে না বা তা মেনে নিতে পারে না। মিয়ানমারের এই আচরণ সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য চরম লজ্জার। তাই এই সময়ে বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর উচিত মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা।

বাংলাদেশি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সর্বোচ্চ সাংঘিক সংগঠন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া যেতে পারে। বৌদ্ধদের বিভিন্ন সংগঠন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিতে পারে, সোচ্চার হতে পারে। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং প্রতিবাদ জানানোর দায়িত্ব কেবল শুধু বাংলাদেশের কিংবা মুসলমানদের নয়– এটা সমগ্র বিশ্বনেতৃত্ব ও বিশ্ববাসীর নৈতিক দায়িত্ব। মুসলিম নির্যাতিত হলে আরব বিশ্ব, অমুসলিম নির্যাতিত হলে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান বিশ্বকে সোচ্চার হতে হবে– এমন সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে সাম্প্রদায়িক আস্ফালন পৃথিবীর যে প্রান্তে দেখা যাবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্ববাসীকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।

তবে দুঃখজনক হল, এই সুযোগে একটি মহল সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়ার তৎপরতা শুরু করেছে। বিষয়টিকে জাতিগত এবং ধর্মীয় আখ্যা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে যে যার যার মত করে (বিভিন্ন ভুয়া ছবিসংবলিত) প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকের মনোভাব এমন যে, মিয়ানমারে যেহেতু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন করা হচ্ছে, এ দেশেও বৌদ্ধদের সঙ্গে তেমন আচরণ করা উচিত। এটা নিশ্চয় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ নয়। বরং সবাই মিলে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, মানবতার খাতিরে মিয়ানমারের উপর রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারলে রোহিঙ্গাদের উপকারে আসবে নিঃসন্দেহে।