বিশেষ বয়স্করা

নাসরীন মুস্তাফা
Published : 6 Dec 2016, 10:02 AM
Updated : 6 Dec 2016, 10:02 AM

আমার স্কুলশিক্ষক মায়ের সহকর্মী ছিলেন তিনি; আমাদের খালাম্মা। তাঁর মেয়েটা বড় আর ছেলেটা ছোট। মেয়েটা বিশেষ মানুষ, সমাজ যাকে নির্দয়ভাবে নানা বিশেষণে বিশেষিত করতে ব্যস্ত। খালাম্মা কত শত শিশুকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন দেশের সুযোগ্য নাগরিক হওয়ার জন্য; অথচ নিজের মেয়েটাকে তিনি স্কুলে নিয়ে যেতে পারেননি।

যদিও ছেলেটা স্কুলে যায়, বোনটাকে দারুণ ভালবাসে, স্কুল থেকে ফিরে এলে বোনের শিশুসুলভ কৌতুহল মেটায়, নানা প্রশ্নের জবাব দেয়। একসময় ভাইটা পড়াশোনা শেষে চাকরিতে ঢোকে, বিয়েও করে। ভাইয়ের স্ত্রী তার সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে পরিণত শরীরের অপরিণত বুদ্ধির বিশেষ মানুষটির সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করতে সাহস পেল না। মেয়েটাকে নিয়ে নির্জনবাস শুরু হল খালাম্মার।

এ রকম সময়ের একদিন খালাম্মার সঙ্গে দেখা। তিনি আমার হাত আঁকড়ে ধরে প্রশ্ন করেছিলেন, "বিশেষ বয়স্কদের জন্য কোনো আশ্রম নেই, বৃদ্ধাশ্রমের মতো?"

তিনি যদি ওখানে মেয়েটাকে রাখতে পারতেন, তবে মরেও শান্তি পেতেন। মায়ের মৃত্যুর পর এই বিশেষ বয়স্ককে দেখার যে কেউ নেই! ও যে এখনও নিজের হাতে খাওয়াটাই শেখেনি!

খালাম্মার প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব হয়নি আমার। তাই তাঁর সঙ্গে আর যে দেখা হয়নি, আমাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করার জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন বিশেষ মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার মতো কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি এ দেশে। আর এখন?

বিশ্ব অটিজম দিবস ২০১৬ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন– "অভিভাবকহীন বিশেষ মানুষদের সমস্ত দায়িত্ব সরকারই নেবে", তখন সবার মনে সত্যিকারের মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় জেগে ওঠে।

বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ শিশুদের আঁকা ছবিসংবলিত শুভেচ্ছা কার্ড ব্যবহার করেন প্রধানমন্ত্রী। এ খবরটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ শিশুদের প্রতি মমত্ববোধের পরিচয় তুলে ধরে। আর তাই তিনি যখন মানবিক বাংলাদেশে অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধীদের প্রতিপালনে আলাদা ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট গড়ে তোলার ঘোষণা দিলেন, তখন মনে হয়েছে তাঁর কাছ থেকে এ রকম ঘোষণা আসাই স্বাভাবিক।

সত্যিই তো, অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধীদের অভিভাবক রাষ্ট্র। এ রকম একটি ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্টের মাধ্যমে রাষ্ট্র অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে– এমন চিন্তা এর আগে কেবল প্রতিবন্ধীদের অসহায় মা-বাবাদের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই হয়তো বা লুকিয়ে ছিল।

স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন অসাধারণ দায়িত্ববোধ নিয়ে এ রকম মানবিক উদ্যোগের ঘোষণা দেন, তখন দীর্ঘশ্বাসের আঁচ পরম মমতার আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। আশীর্বাদ আবারও দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হতে পারে! কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের নোংরামিতে পরবর্তী সরকারের কাঁচিতে বাদ পড়তে পারে এ উদ্যোগ, এমন সম্ভাবনা জেগে ওঠার সুযোগই দেননি প্রধানমন্ত্রী। ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলেও প্রতিবন্ধীদের প্রতিপালনের কার্যক্রম বন্ধ হবে না– এমন ব্যবস্থা তিনি করবেন।

কেন তিনি এত কিছু করবেন?

এবারের বিশ্ব অটিজম দিবসের আয়োজনে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশা জাগানিয়া সেই অসাধারণ ভাষণে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন বিশেষ শিশুদের মায়েদের কথা। এ রকম শিশুদের মমতার আঁচলে আগলে রেখে বড় করে তোলার অপরিমেয় কষ্ট ভোগ করেন মায়েরা, তিনি সেটা জানেন। এই মায়েদের অবর্তমানে অসহায় হয়ে পড়ে বিশেষ শিশুরা; এই শিশুরা ততদিনে বয়স্কতে পরিণত হলেও অসহায় বইকি।

তখন এরা কোথায় যাবে? যাবে রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে এদের। কেননা, আর সবার মতো এদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। মেধা ও যোগ্যতার প্রকাশ ঘটাতে পারে এরাও, যদি সেই সুযোগ তাদের দেওয়া হয়। বিশেষ মানুষদের সেই সুযোগ দেবে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। কেননা, এ রকম মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একাত্তরের বীরযোদ্ধারা।

ইতোমধ্যেই বিশেষ মানুষদের জন্য ভাতা-পুনর্বাসন কেন্দ্র-চিকিৎসা সহায়তাসহ সাহায্য কেন্দ্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সরকারের আন্তরিক ও মানবিক প্রচেষ্টায়। ৬৪টি জেলায় এবং ৩৯টি উপজেলায় ১০৩টি 'প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র' করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে চালু হয়েছে অটিজম কর্নার, যা থেকে প্রায় ২০ লাখ প্রতিবন্ধী সেবাগ্রহণ করছে।

ঢাকার শিশু হাসপাতালসহ ১৫টি মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে ১৫টি 'শিশু বিকাশ কেন্দ্র' করা হয়েছে, যার ফলে অটিজম সমস্যাজনিত শিশুদের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগ আরও বাড়িয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী সেদিন ঘোষণা দিয়েছেন শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলাতে একটি করে অটিজম চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করবে তাঁর সরকার। বিশেষ শিশুদের শিক্ষাসুবিধা বাড়ানোর কাজও অনেক দূর এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীই জানালেন, দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে 'প্রয়াস' নামে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় করা হয়েছে।

বাংলাদেশ নামের প্রতিবন্ধীবান্ধব 'বিশেষ' এই রাষ্ট্র 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইন ২০১৩' প্রণয়ন করেছে। 'নিউরো প্রতিবন্ধী ডেভেলপমেন্ট সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩' পাশ হয়েছে। গঠিত হয়েছে নিউরো প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড, যার বাজেট বরাদ্দ তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে 'নিউরো প্রতিবন্ধী একাডেমি' প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে খুব দ্রুত এর কাজ এগিয়ে চলছে।

হয়তো এই দেশেই দ্বিতীয় কোনো স্টিফেন হকিং জন্ম নেবেন! হকিং প্রতিবন্ধিত্ব জয় করে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন হয়ে উঠেছেন। আমাদের শিশুদের প্রতিবন্ধিত্বকে রাষ্ট্র যদি এভাবে শক্তিতে পরিণত করে, তবে এ রকম স্বপ্ন দেখার সত্যিই ইচ্ছে জাগে।

অটিজম সচেতনতায় জোরালো প্রচারনার ফলে দেশের আপামর জনগোষ্ঠী আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, মমতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগের চেয়ে অনেক সচেষ্ট, এ কথা বলাটা অত্যুক্তি হবে না। ব্যক্তিগত খাতেও প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কৃতজ্ঞতার সাথে ভাষণে এর উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ একাডেমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বই প্রকাশ করছে, পাশাপাশি একই রকম উদ্যোগ নিয়ে ব্রেইল বই প্রকাশ করে বিনামূল্যে বিতরণও করছে অনেক বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থা।

রাষ্ট্র যখন মানবিক আবেগকে জাগ্রত করে, তখন ব্যক্তি-সমাজ 'বিশেষ' না হয়ে কী পারে?

বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেওয়ার মত চওড়া বুক আমাদের, অসহায় বিশেষ মানুষদেরকে আগলে রাখার মত হাত আছে, যাতে পরিবারের আপনজন কাউকে 'বিশেষ' বলে ছেড়ে যেতে না হয়।

'বিশেষ' মানুষগুলোর জন্য 'বিশেষ' হয়ে উঠছি আমরাও।