সাইবার অপরাধ ও আমাদের প্রস্তুতি

এনামুল হক ভূঁইয়া
Published : 15 Nov 2016, 03:28 AM
Updated : 15 Nov 2016, 03:28 AM

সাইবার অপরাধ ও সাইবার নিরাপত্তা বর্তমান বিশ্ব সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। 'উইকিলিকস'-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও 'সিআইএ'-এর তথ্য ফাঁসকারী এডওয়ার্ড স্নোডেনের কল্যাণে বিষয়টি এজেন্ডা হিসেবে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে চলে আসে। তা ছাড়া 'পানামা পেপার্স' কেলেঙ্কারি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি এতে নতুন মাত্রা যোগ করে। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সদ্য অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজিত প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল ফাঁসের ঘটনায় সাইবার নিরাপত্তা ভোটের রাজনীতিতে নতুন ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি চরম উদ্বেগের বিষয়।

চলতি বছরের শুরুর দিকে সাইবার হ্যাকারেরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯৫১ মিলিয়িন মার্কিন ডলার চুরি করে। ২০১২ সালে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে কক্সবাজারে বৌদ্ধ সম্প্রাদায়ের ওপর হামলা করা হয়। অতিসম্প্রতি কে বা কারা পূর্ণিমা শীলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার ছবি ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে তার নামে পর্নগ্রাফির ফেসবু্ক পেজ খোলে। কয়েকদিন আগে ঢাকায় মাদকাসক্ত এক তরুণীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার মায়ের নামে অপবাদ দেওয়া হয়। ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিকে গোপনে মোবাইলে নারী রোগীর ভিডিও ধারণ করে এক কর্মচারী।

বেশ কিছুদিন আগে পারসোনার কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার গুজব রটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়। বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। তা ছাড়া ফটোশপের মাধ্যমে এর ছবি ওর সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এন্তার ঘটছে। ছোট ও বড় পর্দার অভিনেত্রীদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে অহরহ। এসব ঘটনা আমাদের সাইবার নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

একটা সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ব্যঙ্গ করা হত। কিন্তু ২০১৬ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি বাস্তবতার নাম। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম কম্পিউটার আসে বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশনে। ব্যক্তিগতভাবে প্রথম কম্পিউটার নেন সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন। দুটি ঘটনাই ১৯৮২ সালের পর। ২০১৬ সালে এসে কম্পিউটার হাতের মুঠোয়, ইন্টারনেট হাতের কাছে। এ ছাড়া আছে ট্যাব, স্মার্টফোন (অ্যান্ড্রয়েড়, আইফোন) ইত্যাদি। এসব ব্যবহার করে নিমিষে 'বিশ্বভ্রমণ' করা যায়! অ্যাকসেস করা যায় ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, স্কাইপ, ভাইভার, ইমু, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপে। এ ছাড়া আছে গুগল, গুগল প্লাস, ডুডুল, লিংকডইন, ইনস্টাগ্রাম, ফ্লিকার, কম্পিউটার ও মোবাইলের ক্লাউড; আরও কত কী!

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে মানুষ বাস্তব জগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করছে অনেক বেশি। এই ভার্চুয়াল জগতের কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনাচার, চিন্তাজগত ও মনোবৃত্তি। তাতে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন প্রকৃতির অপরাধ প্রবৃত্তি। হ্যাকিং, সাইবার বুলিং, ইমেইল স্পাম ও পিশিং, অনলাইন কেলেঙ্কারি ও প্রতারণা, পরিচয় ও তথ্যচুরি, ক্লাউড থেকে তথ্যচুরি, ইকমার্স ও অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণা, বিভিন্ন সেক্সুয়াল সাইটে নারী ও শিশুদের অপব্যবহার, বিদ্রূপাত্নক ও অনায্য মন্তব্য ছাড়াও রয়েছে নানাবিধ সাইবার অপরাধ। আরও রয়েছে ইলেক্ট্রনিক মানি লন্ডারিং, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের জন্য পারস্পারিক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র, সাইবার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদি।

২০১০ সালে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ওয়াশিংটন ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে রাটগার্স ইউনিভার্সিটির ছাত্র টাইলর ক্লেমেনসি। এদিকে ২০১৫ সালে নরওয়েতে এক কনফারেন্সে মনিকা লুইনস্কি বলেন, "১৯৯৮ সালে ক্লিনটনের সঙ্গে তার গোপন অভিসারের বিষয়টি প্রকাশিত হয়। ঠিক সে বছর গুগল খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে ও তাতে অনলাইন ট্রলিং আমার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।"

আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছরে কত মেয়ের জীবন যে দুর্বিষহ করে তুলেছে তার ইয়াত্তা নেই। আমাদের 'প্রাইভেসি' ও 'পাইরেসি' দুটোর অবস্থাই খুব নাজুক। কয়েকদিন আগে 'আয়নাবাজি' ছবিটি চুরি করে ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়া হয়। এতে সিনেমা হল মালিকদের মাথায় হাত। বাংলাদেশে শিক্ষা ও গবেষণার সর্বত্রই চলছে কুম্ভিলতার (plagiarism) ছড়াছডি। গুগলে সার্চ দিয়ে কপি-পেস্ট করে অ্যাসাইনমেন্ট থেকে তথাকথিত গবেষণাপত্র সবই হচ্ছে দেদারসে। এসব নিয়ন্ত্রণের আইন বা প্রযুক্তি কোনোটিই আমাদের নেই।

আমেরিকা, ইরান, চীন, ইজরায়েল, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ভারতে সাইবার নিরাপত্তা কিছুটা শক্তিশালী বলে মনে করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তবে এসব দেশে পর্যাপ্ত আইন তৈরির পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতায় বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু এজেন্সি গড়ে তুলেছে। আমেরিকাতে পেন্টাগন গড়ে তুলছে 'ইউএস সাইবার কম্যান্ড' (US CYBER COMMAND)। ইরানিয়ান সাইবার আর্মিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাইবার আর্মি বলে বিবেচনা করা হয়। মনে করা হয়, ব্যুরো-১২১ উত্তর কোরিয়ার সরকার কর্তৃক গঠিত 'সাইবার এজেন্সি' রাষ্ট্রীয় সাইবার নিরাপত্তা দেখভাল করে। রাশিয়ার 'এফএসবি'-তে রয়েছে শক্তিশালী 'সাইবার ক্রাইম ইউনিট'। কিন্তু প্রশ্ন হল, ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা কতটা নিরাপদ?

অতিসম্প্রতি সরকার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে 'কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট' গঠন করা হয়েছে, যা সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো দেখছে। তবে পুলিশে সাইবার অপরাধ বিষয়ক নতুন ইউনিট খোলা সময়ের দাবি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অধিকতর সংশোধিত আকারে পাস করে। কিন্তু সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তারের পর অনেকে একে 'নিবর্তনমূলক' আইন বলছেন।

সাইবার অপরাধ দমনের জন্য নিবর্তন নয়, সংশোধনমূলক আইন প্রণয়ন করা উচিত। তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে। কারণ, আইনের ফাঁকফোকর গলে অনেক অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে, আবার আইনের অপব্যবহারে অনেক নিরাপরাধী ফেঁসে যাচ্ছে।

পুলিশের তদন্ত থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, নীলয় হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ও সহযোগীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখনও এদের অনেকের টিকির নাগাল পায়নি। কারণ, আইনের দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তির অভাব রয়েছে।

হলি আর্টিজানে হামলার কিছুক্ষণের মধ্যে সব ছবি ও সংবাদ 'আমাক' নিউজের হস্তগত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, সন্ত্রাসীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চেয়ে শিক্ষায়, প্রযুক্তির ব্যবহার ও দক্ষতায় অনেক অগ্রগামী। কেবল আইনপ্রয়োগ করে বা শাস্তি দিয়ে সাইবার অপরাধ দমন অসম্ভব; চাই জনসচেতনতা, যথোপযুক্ত শিক্ষা। অতি শিগগির স্কুল-কলেজে সাইবার অপরাধ বিষয়ক কারিকুলাম চালু করা উচিত।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ আর পশুতে তফাৎ নেই। তফাৎ নির্ধারণ করে শুধু শিক্ষা। সে শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রতিটি মানুষের মধ্যে পশু লুকিয়ে থাকে, সেটিকে অবদমিত করে শিক্ষা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা পরিবেশ যদি মননশীলতার শিক্ষা দিতে অপারগ হয় তবে বাহ্যত দুই পায়ের মানুষগুলো 'চতুষ্পদী' থেকে যায়! যেহেতু শিক্ষায় আমাদের দীনতা আছে, তাই পশুত্ব দমনের জন্য চাই আইনের শাসন। সোজা কথা– ভয় থাকা চাই। পশু ভয় পায়। যে সমাজে দুটির কোনোটিই নেই সে সমাজে নৈরাজ্য বিরাজ করে। বনের মতো সিংহরা সে সমাজের রাজা। মেধা ও মননের বদলে গতরের শক্তি সেখানে রাজত্ব করে।

সাহিত্য কিন্তু আপন গতিতে চলছে। "আজ বানায় তালের পিঠা কাল বানায় খৈ। সিক্কাতে তুলিয়া রাখে গামছা বান্ধা দই।"

এ পঙক্তির আবেদন ফুরিয়ে গেছে। সিক্কা বিলুপ্ত হয়েছে ফ্রিজের আগমণে। নারীরা আর হেলিয়া-দুলিয়া ঢেঁকিতে চাল ভানে না, রাষ্ট্র পরিচালনা করে। ঢেঁকিছাটা চালও আর নেই। সাহিত্যে এসবের অবসান হয়েছে। কিন্তু আচার-বিচারে, শিক্ষায়-সংস্কতিতে আমরা পিছিয়ে আছি যোজন যোজন।

কেবল আইন তৈরি করে নয়, আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ বিভাগ রয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও দুয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি বিভাগ চালু করে সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে সাইবার ইথিকস ও সাইকোলজি বিভাগে সাইবার সাইকোলজি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা ও পর্যাপ্ত গবেষণা করা উচিত। গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সাইবার ল' বা 'ইন্টারনেট ল' নামে পাঠ্যসূচিতে সামান্য কিছু পড়ানো হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সাইবার ল' বাধ্যতামূলক করা উচিত। ইতিহাস বিভাগ সাইবার ক্রাইমের ইতিহাস পড়াতে পারে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আগামী দশ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাবে আমাদের এ পৃথিবী। মানুষ হয়তো চাঁদে বসতি স্থাপন করবে। মঙ্গল গ্রহে মানুষ যাবে। এলিয়ানেরা হয়তো পৃথিবীতে চলে আসবে। সুপার কম্পিউটার ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসবে। কোয়ান্টাম টেলিকমিউনিকেশন আসছি আসছি করছে। বদলে যাবে আইন-কানুন, জীবানাচার, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মানুষের ইতিহাস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলাতে হবে মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের বিষয়সমূহ। না হলে বিশ্বের অপরাপর অংশের তুলনায় আমরা পিছিয়ে পড়ব।

'পে-পাল' বাংলাদেশে আসছে। নিকট ভবিষ্যতে আসবে 'ইবে', 'আমাজান', 'আলিবাবা' ও আরও অনেকে। অনলাইন বিপণনে আর্থিক ব্যবস্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। চলতি বছরের গোড়ার দিকে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা আমাদের দুর্বল ব্যবস্থাপনার প্রতি একটি চপেটাঘাত। তথাপি আমাদের প্রস্তুতি যৎসামান্য।

যুগোপযোগী ও যথাযথ আইন প্রণয়ন করে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। শিক্ষার্থীদের সাইবার ইথিকস শিখানো হোক। পূর্ণিমা শীলদের বাকিটা জীবন নির্বিঘ্ন হোক। অভিজিৎরা তাদের চিন্তা-চেতনা নিয়ে বেঁচে থাক। রাজকোষ ও জনতার অর্থ নিরাপদ হোক।

ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।