কেরোসিন শিখা বলে…

Published : 11 Nov 2016, 03:30 PM
Updated : 11 Nov 2016, 03:30 PM

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম মাতোয়ারা। কে কবে থেকে হিলারির পক্ষে কাজ করেছেন গলা ফুলিয়ে সে কথা বলছেন; নির্বাচনী ফলাফল, মার্কিন রাজনীতি ইত্যাদি কে কত ভালো বিশ্লেষণ করতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় সবাই ব্যস্ত। বলতে গেলে আমরা অনেকেই মার্কিন রাজনীতি যে মার্কিনিদের চেয়েও ভালো বুঝি– এটা প্রমাণ করতে পারলে দারুণ আরাম বোধ করি। বলতে গেলে ওরা তো আমাদের প্রায় আত্মীয়ই বলা যায়! কোনো না কোনো সূত্রে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে তাই আমাদের ব্যস্ততারও কমতি নেই।

শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গেই 'ব্রাদারহুড' ফলানোর আগ্রহে কমতি নেই আমাদের। কিন্তু ভিনদেশি ধনীদের নির্বাচনের খবরাখবরের নিচে, বলতে গেলে, প্রায় চাপা পড়েই গেছে দেশেরই কয়েক হাজার দরিদ্র মানুষের খবর।

ঘটনাটি ঘটেছে ৬ নভেম্বর। বিভিন্ন খবরে জানা যায়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জে বাগদা ফার্ম এলাকায় আদিবাসী সাঁওতালদের ৬০০ বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন ও মিল কর্তৃপক্ষ মিলেমিশেই কাজটি করেছে! আখ কাটার নামে ওই এলাকার সাঁওতাল আদিবাসীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুল।

সাঁওতাল পল্লিসহ আশপাশের কয়েকটি বাঙালি গ্রামের অধিবাসীদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে অনেক আদিবাসী আহত হন। শ্যামল হেমব্রম নামে এক আদিবাসীকে গুরুতর আহত অবস্থায় দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। অন্য আহত ব্যক্তিদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

উচ্ছেদ চালানোর সময় আদিবাসী ও বাঙালিদের বাড়িঘরে যখন আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় তখন পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে 'তামাশা' দেখে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানকার আদিবাসী ও প্রান্তিক বাঙালিদের বাপ-দাদার ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। কিন্তু প্রশাসন কখনও বিষয়টিতে আমল দেয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ৮ নভেম্বর 'হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম' সাহেব বাজারে মানববন্ধনের আয়োজন করে।

আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমতলের আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান চূড়ান্তভাবে প্রান্তিক। মধুপুর, উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকার সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, দলিত, হরিজন সম্প্রদায়ের জনগণ চরম দরিদ্র ও অবহেলিত।

আমরা বাঙালিরা কখনও কাশী-কনৌজের ব্রাহ্মণের সঙ্গে, কখনও খাঁটি আর্যদের সঙ্গে, কখনও আরব, ইরান, তুর্কিস্তানের মানুষের সঙ্গে সুদূর আত্মীয়তা ফলাতে গৌরব বোধ করি! কার শরীরে কয় ফোটা আর্য বা আরব রক্ত আছে, কার পূর্বপুরুষ কাশ্মীর, মগধ, কোশল থেকে বা আরব, ইরান, তুর্কিস্তান থেকে এসেছিল– সে কথা ফলাও করে বলতে আমাদের জুড়ি নেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই ওই কয়েক ফোটা রক্ত দিয়ে বাঙালির 'দেহ' গঠিত হয়নি, বরং কোল, মুন্ডা, সাঁওতাল, দলিতদের মতো কালা আদমিদের রক্তমাংসই আমাদের 'দেহের ৮০ ভাগ'জুড়ে আছে। আমাদের চামড়ার কালো রঙ, চোখ ও চুলের রঙ, গঠন, বোচা নাক আর খর্বাকৃতির মধ্যে যে তাদের রক্তই কথা বলে ওঠে– সেটি তো শত চেষ্টাতেও ঢাকা যায় না।

আর্য ও আরব-তুর্কিদের আগমনের আগে আমরা মানে, এই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দারা যে সবাই ওই সব সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, সে কথা ভুলতে চাইলেও যে ভোলা যায় না। নৃতাত্ত্বিকভাবে আমরা যে 'অস্ট্রালয়েড'– সেটাও তো অস্বীকারের উপায় নেই। আমাদের খাঁটি বাংলার মধ্যেও যে কুলা, ডালা, কুড়ি, কড়ির মতো শব্দগুলো পূর্বপুরুষদের কণ্ঠস্বর হয়ে বেজে ওঠে। বাংলা ভাষার যে শব্দগুলো আমরা 'দেশি' শব্দ বলে জানি সেগুলো যে কোল, মুন্ডা, সাঁওতাল, দলিতদেরই শব্দ।

কিন্তু তাদের সঙ্গে 'ভাতৃত্ব'-এর ('ভগ্নিত্ব'ও বলা যেতে পারে) কথা বলতে আমাদের মান-সম্মানে বড়ই লাগে! কারণ, তারা যে গরিব; তাদের যে শত শত বছর ধরে পায়ের নিচে চেপে রেখেছি আমরাই।

এই সাঁওতালরাই কিন্তু ব্রিটিশদের বন্দুক-কামানের বিরুদ্ধে নিজেদের তীর-ধনুক নিয়ে সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়। হাজং বিদ্রোহের সময় এ দেশের আদিবাসী হাজংরাই কিন্তু অস্ত্র ধরেছিল।

দলিতদের, হরিজনদের ধনীরা চিরদিন দরিদ্র বলে পায়ের নিচেই চেপে রাখতে চেয়েছে। সাঁওতালদের জমিজমা দখলে স্থানীয় ধনীদের উৎসাহের কমতি কখনও দেখা যায়নি।

সমতলের এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের উপর বছরের পর বছর ধরে চলে আসা জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশের সুধী সমাজকেও খুব বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তাদের অধিকার নিয়ে কোনো মানববন্ধন হলে সেখানে বাঙালি অংশগ্রহণকারী খুব বেশি যে পাওয়া যায়, তা-ও নয়। গরিব মানুষকে 'ভাই' বলে পরিচয় দিতে কারই বা ভালো লাগে! গুরুদেবের কথা উদ্ধৃত করে বলছি–

"কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে
ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!"

সাহেবগঞ্জে ভূমিহীন সাঁওতাল পল্লি থেকে অধিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য যে ৬০০ ঘরে আগুন দেওয়া হল, আড়াই হাজার পরিবারকে গৃহহারা করা হল, তার প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারা দেশে কয়টি মানববন্ধন হয়েছে? আর সাহেবগঞ্জের প্রশাসনই বা কী ব্যবস্থা নিয়েছে– সেটা জানার আগ্রহ আমাদের কতজনের আছে?

এখন কার্তিক মাসের শেষ পর্যায় চলছে। গাইবান্ধায় এর মধ্যেই শীত পড়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের তীব্র শীতের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা বুঝবে এই শীতের শুরুতে দরিদ্র মানুষগুলোকে গৃহহীন করা কতটা জুলুমের কাজ হয়েছে। শীতকাতর বৃদ্ধ ও শিশুদের কতটা কষ্ট হচ্ছে– সে কথা আমরা কি ভাবছি? স্কুলঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর এই দরিদ্র শিশুদের লেখাপড়াও তো বন্ধ হয়ে গেছে। আড়াই হাজার পরিবার মুখের কথা নয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধদের নিয়ে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে গ্রামছাড়া অসহায় মানুষগুলো!

আবহমানকাল ধরে যে ভূমিতে আদিবাসীরা বাস করছে সে ভূমি যে তাদেরই– এ কথা তো সহজ বুদ্ধিবলেই বোঝা যায়। কিন্তু পাহাড় ও সমতলের এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে 'সেটেলার'রা সেখানে নিজেদের স্থায়ী আবাস গড়ছে। সংঘর্ষ তাই বাঁধছে অনিবার্যভাবে। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের উচিত ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদিবাসীদের পক্ষে দাঁড়ানো। অথচ ঘটছে ঠিক এর উল্টোটা।

পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তুলনায় সমতলের আদিবাসীরা আরও বেশি অধিকার বঞ্চিত, আরও বেশি নিপীড়িত, আরও বেশি অবহেলিত। কিন্তু 'কেরোসিন-শিখা'রূপী বুদ্ধিমান বাঙালি 'চাঁদা'কে কাছে টানতে যতটা আগ্রহী তার এক শতাংশও নয় 'মাটির প্রদীপ' সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, দলিতদের সঙ্গে 'ব্রাদারহুড' প্রতিষ্ঠায়। কেন?

তারা কি আমাদের দেশের নাগরিক নয়? এই জনগোষ্ঠীর প্রতি তাহলে এত বৈষম্য কেন? একটি বাঙালি পরিবার যত সহজে একজন শ্বেতাঙ্গ বিদেশি বা বিদেশিনীকে জামাতা বা বধূ হিসেবে স্বীকার করে নেবে তত সহজে একজন সমতলের আদিবাসীকে স্বীকার করবে না, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তারা একই দেশের নাগরিক, একই রক্তধারার উত্তরাধিকার। এখানেই বাঙালির মজ্জাগত ভণ্ডামির বহিঃপ্রকাশ।

যেদিন আমরা এই ভণ্ডামির মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারব এবং সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াতে পারব, সেদিন আমরা সত্যিকারের 'মানুষ' হয়েছি বলে মনে করতে পারব; তার আগে কিছুতেই নয়।