আমরা ষোল কোটি ‘মালাউন’

ওমর শেহাব
Published : 4 Nov 2016, 12:49 PM
Updated : 4 Nov 2016, 12:49 PM

আগের লেখায় বলেছিলাম আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছে যারা হিন্দু ধর্মাবললম্বীদের তাদের আড়ালে খুব খারাপ ভাষায় ডাকে। উদাহরণ হিসেবে দুটি শব্দ বলেছিলাম– 'ডান্ডি' আর 'মালু'। এখানে 'মালু' কথাটি হল 'মালাউন'এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এখন দেখা যাচ্ছে আড়ালে ডাকার ব্যাপারটি ভুল বলেছিলাম। নভেম্বরের তিন তারিখ ভোরের কাগজে নিচের খবরটি পড়লাম:

গত মঙ্গলবার রাতে নাসিরনগরের ডাকবাংলোতে স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের উদ্দেশ্য করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক বলেন, "মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আর এ ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতিরঞ্জিত করেছে সাংবাদিকরা। অথচ ঘটনা কিছুই নয়।"

প্রথমে আমি নিজের চোখের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছিলাম না। সব সময় জেনে এসেছি অন্য ধর্মের মানুষদের অপমান করার জন্য বিশেষ শব্দ ব্যবহার করা ভীষণ খারাপ কাজ। এতটাই খারাপ যে, খারাপ মানুষেরাও সেটি গোপনে করে, তাদের আড়ালে করে। কিন্তু এখন দেখছি মন্ত্রী হলে এত বাছবিচার না করলেও চলে। সরকারের উঁচু পদে থাকলে এ ধরনের শব্দ প্রকাশ্যে ব্যবহার করার পরও চাকরি টিকিয়ে রাখা যায়!

জানতাম এটি একটি গালি (শব্দটির পুনরাবৃত্তি করতে ঘেন্না হচ্ছে)। কিন্তু কখনও ভেবে দেখিনি আসলে কথাটি কোথা থেকে এসেছে। তারপর কিছু বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে জানলাম এটি নাকি আরবি ভাষা থেকে আসা। এই কথাটির অর্থ হল, 'অভিশপ্ত'!

ব্যাপারটি জানার পর ঝাঁ করে আমার কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। আসলে তো মাননীয় মন্ত্রী ভুল কিছু বলেননি! ওনার মতো মানুষের মন্ত্রী হতে পারা এবং এ রকম কথা বলার পর চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারো আমাদের মতো যারা সাধারণ নাগরিক তাদের জন্য কি অভিশাপ নয়?

আরেকটু গোঁড়া থেকে চিন্তা করে দেখি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা তো আমাদের দেশে আজকে প্রথম হচ্ছে না। অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। এই হামলা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর হয়েছে। নিধার্মিক ও বাউলদের উপর হয়েছে। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্ম ইসলামের যে বিভিন্ন বিকল্প ধারা রয়েছে তারাও হামলা থেকে বাদ যায়নি।

এই যে এতবার হামলা হল তা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিয়েছি? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বা সরকারই-বা কী শিক্ষা নিয়েছে? ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত সন্ত্রাসের জন্য কোনো আলাদা আইন হয়েছে? শত্রুতা করে ব্যক্তিগত শত্রুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া আর পুরো একটি সম্প্রদায়কে আতংকিত করার জন্য তাদের একজনের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। দ্বিতীয় আরও অনেক ভয়ংকর অপরাধ। আমাদের আইনি কাঠামো কি এই দু ধরনের অপরাধের গুরুত্বের মধ্যে যে পার্থক্য সেটি ধরতে পারে?

আমাদের প্রশাসনে যেসব কর্মকর্তা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন না তাদের আলাদাভাবে চেনার এবং ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বে না দেওয়ার মতো সতর্কতা কি নেওয়া হয়? ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুলিশের নিয়োগ দেওয়ার সময় তারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন কি না সেটি জানার কোনো ব্যবস্থা আছে কি? যদি সে রকম কোনো ঘটনা ঘটে আর অপরাধীদের যদি তারা আইনের কাছে সোপর্দ না করেন তাহলে তার প্রতিকারের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা আছে কি?

যদি এসব না থাকে তাহলে এ রকম হামলার ঘটনা বার বার ঘটাই স্বাভাবিক। যদি এসব না থাকে তাহলে আমাদের এই সমাজ এমন একটি সমাজ যেটি সবাইকে সমান মর্যাদা দেয় না। এটি কি অভিশপ্ত সমাজের চিহ্ন নয়? যদি তাই হয় তাহলে 'মালাউন' কথাটি বলে মন্ত্রী কি ভীষণ অপরাধ করেছেন? তিনি তো সত্যি কথাই বলেছেন! তিনি কেবল ছোট্ট একটি ভুল করেছেন। এখানে কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই মালাউন নন। এখানে আমরা সবাই মালাউন, আমরা সবাই অভিশপ্ত।

যে সমাজে একজন আদিবাসী তার নিরাপত্তা পান না, সেই সমাজে সেই আদিবাসী মালাউন, কারণ তিনি অভিশপ্ত। যে সমাজে একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিরাপত্তা পান না, সেখানে সেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মালাউন, কারণ তিনি অভিশপ্ত। নিধার্মিক যেখানে নিরাপত্তা পান না, সেখানে তিনি মালাউন, কারণ তিনি অভিশপ্ত। যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে একজন আহমদিয়া বা শিয়া মুসলিম নিরাপদ নন, সেই সমাজে সেই বিকল্প ধারার মুসলমান একজন মালাউন, কারণ তিনি অভিশপ্ত।

যার ধর্মপরিচয় বা বিশ্বাস থাকা বা না-থাকা তার প্রাপ্য নিরাপত্তার পরিমাপ ঠিক করে দেয়, সেই তো সমাজের সবচেয়ে অভিশপ্ত সদস্য। তার চেয়ে বড় মালাউন আর কে আছে? সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, নিধার্মিক, শিয়া বা আহমদিয়া যা-ই হোক না কেন, তার মূল পরিচয় অভিশপ্ত। তার মূল পরিচয় হল সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে নিপীড়িত হওয়াই তার নিয়তি। তার মূল পরিচয়, সে মালাউন।

আমার হিসাবে এই বাংলাদেশের খুব অল্প কিছু মানুষ এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তার সঙ্গে আর অল্প কিছু রাজনীতিবিদ আছে যারা এই মানুষদের প্রশ্রয়দেয়। এই গুটিকয়েক মানুষ বাদ দিলে আমরা বাকি ষোল কোটি মানুষের সবাই মালাউন!

বিশেষ দ্রষ্টব্য, এই লেখা শেষ করতে করতে খবর পেলাম নাসিরনগরে আবারও হামলা হয়েছে। কমপক্ষে পাঁচটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পৃৃথিবীতে আর কতদিন মালাউন হয়ে থাকতে হবে কে জানে!