নাগিনীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে

আবেদ খান
Published : 3 Nov 2016, 04:33 PM
Updated : 3 Nov 2016, 04:33 PM

মুখ লুকিয়ে ছোবল দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষধর সর্প। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সিলেটের হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ছাতক এ তিনটি স্থানই মুহূর্তের মধ্যে সর্পদংশনে নীল হয়ে গেল। এবারও সেই পুরনো অজুহাত। ফেসবুকে তথাকথিত স্ট্যাটাস। সেই পুরনো কায়দায় নাম এসে গেল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক তরুণের। এ ঘটনা আমাদের কাছে নতুন নয়। রামুর ঘটনা, বগুড়া, যশোরের মালোপাড়া, সাতক্ষীরা সর্বত্রই একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য।

আমাদের এখানে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। কোনো একটি মুসলিম সম্প্রদায়ের বাড়িতে এক টুকরো ইট এসে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের শতাধিক বাড়িতে ভাঙচুর হয়। ১০-১৫টি মন্দির লুণ্ঠিত হয়। ৪০-৫০টি প্রতিমা চুরমার করে দেওয়া হয়। শঙ্কিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবার অসহায়ের মতো নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকে।

অনেকেই এমনভাবে এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দোষ চাপান যেন তারা দেশত্যাগের জন্য এক পা বাড়িয়ে আছে। এই বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর ভিটেমাটি ছাড়ার জন্য যেন তাদের নিরন্তর আয়োজন। এ ধরনের বিকৃত যুক্তি যখন শুনি, তখন মনে হয় আমরা সাম্প্রদায়িকই রয়ে গেলাম, 'মানুষ' হলাম না।

কেউ কি সাধ করে নিজের মূল উৎপাটন করে অনিশ্চয়তার দিকে এগোয়? ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা দেশ ছেড়েছে সেই '৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত; কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তাদের চলে যেতে হয়েছে? তা কি কখনও অনুসন্ধান করা হয়েছে? দেশত্যাগীদের আর্তকণ্ঠ আমি শুনেছি। জন্মভূমির জন্য যে হাহাকার, যে দীর্ঘশ্বাস, যে রক্তক্ষরণ তা কি অনুভব করবেন, যারা এই বিপর্যয়ে আক্রান্ত নন?

সেই ভারত বিভাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েই চলছে। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে উত্তর পেতে এতটুকু কষ্ট হবে না। সেই '৪৭ সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে তৎকালীন পাকিস্তানকে মুসলমানদের দেশ বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে দেখলাম একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে সংখ্যালঘু বিতাড়নে নিরন্তর পাঁয়তারা চলতেই থাকল। আর এই স্বার্থসিদ্ধি চরিতার্থ করার জন্য অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হল সাম্প্রদায়িকতাকে।

'৪৭-এ দেখলাম হিন্দুপ্রধান ও মুসলমানপ্রধান অঞ্চল নিয়ে ভাগাভাগির সে কী মহোৎসব! যেন মানুষের শেকড়ের কোনো মূল্য নেই, পিতামহ-প্রপিতামহের স্মৃতির কোনো মূল্য নেই। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। সব শুধু রাজনীতি আর রাজনীতি, লোভ আর লোভ, ক্ষমতা আর ক্ষমতা!

চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যারা চলে গেছেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যারা চলে যাচ্ছেন কিংবা যারা চলে যাবেন– তাদের অক্ষিগোলকে যে অভিসম্পাতের অগ্নিবাণ বর্ষিত হয় তা কি অন্যরা অনুভব করেন কখনও?

কী কারণ ছিল '৫০-এর দাঙ্গার? কাদের স্বার্থে বাঁধানো হয়েছিল সেই দাঙ্গা?

কাশ্মীরের একটি মসজিদে রাসুল (স.)-এর রক্ষিত একটি কেশ অপহৃত হওয়ার পরিণতিতে বাংলাদেশে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হল ১৯৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি। এসবই ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করার চতুর কূটনৈতিক চাল। সেদিন নিরাপত্তার অভাবে হাজার হাজার পরিবার ছেড়ে গিয়েছিল তাদের জন্মভূমি। তাদের তো কোনো অপরাধ ছিল না।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে আবার আক্রান্ত হল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিশাল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। পাকিস্তানের দুর্বৃত্তশাহী বাধ্য করল তাদের প্রচণ্ড অপমানজনক নানাবিধ শর্ত গ্রহণ করতে। তাদের মধ্যে যারা এই অপমান সইতে পারলেন না, তারা দেশত্যাগ করলেন। বাকিরা পড়ে রইলেন মাতৃভূমির মাটি কামড়ে। তাদের বিষয়-সম্পত্তি পরিণত করা হল শত্রু সম্পত্তিতে। অর্থাৎ পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অমুসলিম সম্প্রদায়কে শত্রু ঘোষণা করল। তারপর এল '৭১।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা তখনও দেশে পড়েছিলেন, তাদের নির্দয় গণহত্যার মাধ্যমে মানবতার বহ্নুৎসব ঘটানো হল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অনেকেই ভেবেছিলেন– বোধ হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক নিরাপত্তা, মর্যাদা নিশ্চিত হবে। কিন্তু '৭৫-এর পর আবার শুরু হল সেই পাকিস্তানি নীলনকশার বাংলাদেশি সংস্করণ। আশির দশকের শেষভাগে আবার একটি দাঙ্গা বাঁধানো হল ভারতের বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে। আবার সেই নিরাপত্তাহীনতা, আবার সেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিতাড়ন। আবার এই গাঙ্গেয় জনপদকে মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করার ভয়াবহ চক্রান্ত।

সাংবিধানিকভাবে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের ব্যবস্থা করে সেই একইভাবে 'ছিনতাই' করা হল এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার। হয় তোমাদের সম্পত্তি দাও, নয় তোমাদের ভোট আমাদের বাক্সে দাও– এই প্রবণতা পরিদৃষ্ট হল রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র। নতুন নতুন অজুহাতে বারংবার সুকৌশলে বাংলাদেশকে এককভাবে মুসলমানদের আবাসভূমি বানানোর চেষ্টা করা হল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা, রামুর ঘটনা, সাতক্ষীরা, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ঘটনা ঘটিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব করে তোলা হল। অনেক মাদ্রাসা-মসজিদকে ব্যবহার করা হতে থাকল সাম্প্রদায়িকতা তৈরির কারখানা হিসেবে। আর বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটছে তা শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রা অনিশ্চিত করাই নয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি বিপন্ন করাই এসবের গোপন উদ্দেশ্য।

জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করার যে ভয়াবহ দুরভিসন্ধি আন্তর্জাতিকভাবেও ক্রিয়াশীল, সেটিকে কোনো অবস্থাতেই উপেক্ষা করা যাবে না।

অবাক লাগে যখন এ দেশের প্রশাসকযন্ত্রের একাংশ একধরনের নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করে যাবতীয় ঘটনাকে তুচ্ছ করার চেষ্টা করে। অবাক লাগে যখন এ দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর একাংশ বারংবার বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে সংখ্যালঘুদের দুয়েকজন উদ্ভ্রান্ত যুবকের অবিমৃষ্যকারিতায় এ ধরনের ঘটনার উদ্ভব হয়েছে। তাদের এই ভাবনার কারণে বিকারগ্রস্ত ধর্মব্যবসায়ীরা নিরপদ্রুবে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূল ক্ষতবিক্ষত এবং রক্তাক্ত করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বিপন্ন হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিপন্ন হবে বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্য।

পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এসব ঘটনা হচ্ছে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করা, সরকারের উন্নয়ন ভাবনা বিপন্ন করা এবং সুস্থ প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা বিধ্বস্ত করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। এ কর্মকাণ্ড সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কাজেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া সরকারের আর কোনো বিকল্প নেই।