ভিনদেশেও ছাত্রশিবিরের অপতৎপরতা

বৃন্দলেখক
Published : 14 Nov 2016, 03:13 AM
Updated : 14 Nov 2016, 03:13 AM

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বেশ কয়েকশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছাড়ছে। বিশেষ করে, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তবে এখনও এ দুটি দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগের চেয়ে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এদের অধিকাংশই স্নাতকোত্তর ও ডক্টরাল প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী। এদের মৌলিক উদ্দেশ্য ভালোভাবে পড়াশোনা ও গবেষণা করা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা নিতে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উগ্রবাদ প্রচারণায় ব্যস্ত। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি দেশের মৌলিক স্তম্ভগুলো আঘাত করে প্রচারণা চালাচ্ছে তারা। শিক্ষার্থীদের বড় অংশটির ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইল ঘেঁটে ভয়ানক উগ্র-মানসিকতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আবার আরেকটি বড় অংশ নীরবে সেসব উগ্রবাদী পোস্টে লাইক দিয়ে কিংবা কমেন্ট করে তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

জাপানে ও দক্ষিণ কোরিয়াতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বহু নেতা উচ্চশিক্ষায় রয়েছে। তারাই নানা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের নীরব উত্থান ঘটাচ্ছে। দেশ দুটির বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের মতাদর্শের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম, সেসব স্থানে তারা বাকি ছাত্রদের সঙ্গে আপস করে চলছে। তবে নিজেদের দল ভারী করার জন্য ধর্মের নানা অনুষঙ্গ ব্যবহার করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ ছাত্রদের কাছে টানার চেষ্টা করছে। আর যেসব ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির সংখ্যাগুরু, সেসব ক্যাম্পাস বাংলাদেশিদের জন্য স্রেফ আরেকটি 'পাকিস্তান'।

বহু ক্যাম্পাস রয়েছে যেখানে প্রগতিশীলরা একঘরে হয়ে বসে আছে। সেসব ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংহতি বাড়ানোর জন্য প্রতি সপ্তাহেই 'গেট টুগেদার'-এর আয়োজন করে। বিভিন্ন শহরে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। জাপানের ও দক্ষিণ কোরিয়ার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে যেখানে শিবিরের প্রভাব বেশি, সেখানে গেট টুগেদার একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। অনেকেরই ধারণা, ছাত্রশিবিরের এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্র থেকে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে অনুদান নেওয়া হয়, যা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়।

উচ্চশিক্ষার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছাত্রশিবির খুবই কৌশলে একটি ভয়ানক জাল দেশ দুটিতে বিস্তার করছে। এই জাল থেকে মুক্তি পাওয়া যে কোনো ধর্মপ্রাণ সাধারণ ছাত্রের পক্ষে কঠিন। ধর্মের নামে তারা সাংগঠনিক শক্তি এবং ব্যাপ্তি বাড়াচ্ছে। ধারণা করা যায়, দেশ দুটিতে পড়তে আসা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় জামায়াত-শিবিরের উগ্র আদর্শ সমর্থন করছে।

দেশের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দেখা যায়। নতুন কর্মী সংগ্রহ করতে ছাত্রশিবির যখন যা দরকার তা-ই করছে। জাপান ও কোরিয়াতে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বিশ্বের অন্যান্য দেশে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর চেয়ে দুটি বিষয়ে আলাদা। যারা এ দেশ দুটিতে আসছে, তাদের ৯০ শতাংশই আসছে মাস্টার্স ও ডক্টরাল প্রোগ্রামে। তাদের আসার আগে অবশ্যই স্কলারশিপ নিশ্চিত করতে হয়।

এমতাবস্থায় বলা যায়, বাংলাদেশের মেধাবীদের একটি বিরাট অংশ জাপান ও কোরিয়াতে আসছে। জামায়াত-শিবির খুব পরিকল্পিতভাবেই জাপান ও কোরিয়াতে আসা শিক্ষার্থীদের টার্গেটে নিয়েছে। যখন সময় ও সুযোগ হবে, জামায়াত-শিবির তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে সুবিধাজনক স্থানে বসিয়ে দেবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশে ছাত্রদল করা একজন শিক্ষার্থী কোরিয়াতে এসে শিবিরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হল। শিবিরের হাত শক্তিশালী করতে চার বছর নানা ভূমিকা পালন করল। বছর খানেক আগে সেই শিক্ষার্থী বাংলাদেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেল।

প্রাকাশ্য ও গোপনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নামে বিষোদগার করে বিদেশিদের কাছে জামায়াত-শিবির বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে বিদেশিরা বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছে।

গুলশান হামলাতে সাত জাপানি নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে জাপানিদের একধরনের বৈরিতাও বিরাজ করছে। হামলার পর সাধারণ বাংলাদেশিদের প্রতি জাপানিদের দৃষ্টিভঙ্গির আকাশপাতাল পরিবর্তন সূচিত হয়। তবু জামায়াত-শিবিরের উগ্র কর্মকাণ্ড থেমে নেই। অনলাইনে নিজেরা বিভিন্ন সিক্রেট গ্রুপ খুলে সময় ও সুযোগ বুঝে নিজেদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কমিউনিটির মধ্যে আইএসের মতাদর্শ ধারণকারীদের সংখ্যাও জাপানে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জাপানি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

পাঁচ বছর আগেও জাপানে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে আজ তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অর্ধ-ডজন সংগঠন তৈরি করে নানা উগ্র কর্মকাণ্ড, সরকার ও দেশবিরোধী প্রচারণায় মাঠে এগিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। খুব দ্রুতই জাপানের বড় বড় শহর থেকে ছোট ছোট শহরগুলোতেও ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ছে।

জাপানে জামায়াত-শিবিরের উত্থান বেশি দিন আগে থেকে শুরু হয়নি। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা জাপানে শিকড় গজানো শুরু করে ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় থেকে। সেই সময় ঢালাওভাবে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেওয়ার ফসল তারা এখন পাচ্ছে। সে সময় থেকে জাপান সরকারের স্কলারশিপ 'মনবুশো' নিয়ে পড়তে এসে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা নিজেদের সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে থাকে। অধিকন্তু, বহু প্রবাসী বাংলাদেশিদের– যারা বহু বছর ধরে জাপানে আছে– তাদের অনেককেই জামায়াত-শিবির নিজেদের আদর্শে অনুপ্রাণিত করছে। ফলে ব্যাকটেরিয়ার কালচারের মতো শিবিরের কার্যক্রম খুব বিস্তৃতি লাভ করছে।

জাপানের মতো একই পদ্ধতি ব্যবহার করে জামায়াত-শিবির কোরিয়াতে ছড়িয়ে পড়ছে। এখন এমন কোনো শহর পাওয়া যাবে না, যেখানে জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম নেই। ২০১২ সাল পর্যন্ত কোরিয়াতে জামায়াত-শিবিরের কোনো অস্তিত্ব সেই অর্থে ছিল না। এখন এটি ভয়ানক আকার ধারণ করছে।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ এখন জামায়াত-শিবিরের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। যেখানে তারা সংখ্যায় কম, সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে গোপন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। প্রতি সপ্তাহে নিজেরা মিলিত হয়ে নতুন নতুন কৌশল প্রণয়ন করে নিজস্ব আদর্শিক জগতে ধর্মপ্রাণ সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। সামাজিক ঘৃণা থেকে বাঁচার জন্য ছাত্রদলের খোলস পরে অনেকেই শিবিরের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। অনেকেই আবার আওয়ামী লীগের পরিবারের সদস্য হিসেবে বাইরে প্রচার এবং গোপনে ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

মজার বিষয় হল, এখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি দল ক্ষমতায় থাকার পরেও অধিকাংশ স্কলারশিপ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের আদর্শিক লোকেরাই জাপান আসছে। প্রশ্ন হল, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও কীভাবে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সেই সুযোগ পাচ্ছে? কারা তাদের সেই সুযোগ করে দিচ্ছে?

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে জাপান সরকারের বৃত্তি 'মনবুশো' নিয়ে অন্তত আড়াইশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। দুটি আলাদা প্রক্রিয়ায় এ স্কলারশিপের চূড়ান্ত তালিকা করা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে ঢাকাস্থ জাপানের দূতাবাস একটি স্কলারশিপ মনোনীতদের তালিকা চূড়ান্ত করে। আরেকটি হল, জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি সুপারিশ ক্রমে মনোনীতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। জাপান দূতাবাস মূলত বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারা সুপারিশকৃত তালিকা হালকা স্ক্রিনিং করে জাপান সরকারের বিজ্ঞান, শিক্ষা-খেলাধূলা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

গত কয়েক বছর ধরে জাপানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর কাছে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেটি হল, বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সুপারিশে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষায় আসা বড় একটি অংশ জামায়াত-শিবিরের সমর্থক; অনেকেই আবার ছাত্রশিবিরের পদে থাকা নেতা। জামায়াত-শিবিরের আঁতাতের ফলে অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় 'মনবুশো' স্কলারশিপের জন্য জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও দলটির আদর্শিক চিন্তা-ধারকদের মনোনীত করছে। এটি এখন বেশ পুরনো অভিযোগ।

একটি উদাহরণ দিলেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মার উপস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যাবে। কয়েক বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন প্রতিষ্ঠিত ছাত্রশিবিরের নেতাকে 'মনবুশো'র জন্য মনোনীত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ তার অ্যাকাডেমিক রেকর্ড অন্যান্য আবেদনকারীর তুলনায় খুবই খারাপ ছিল।

দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের সবচেয়ে নামকরা বৃত্তি হল 'কোরিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রাম' (সংক্ষেপে 'কেজিএসপি')। এটি ঠিক 'মনবুশো' বৃত্তির নির্বাচন পদ্ধতির মতো না হলেই বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রভাব থাকে বলে শোনা যায়। ঢাকাস্থ কোরিয়ার দূতাবাস মনোনীতদের তালিকা চূড়ান্ত করে। এটি এখন আর ধারণার বিষয় নয় যে যারা 'মনবুশো' ও 'কেজিএসপি' স্কলারশিপে নিয়ে আসছে, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ জামায়াত-শিবির আদর্শিক ঘরনার।

কয়েক বছর আগেও কেজিএসপিতে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রাধান্য দেখা যেত। এখন আর সেটি নেই। এখন যারা এ স্কলারশিপ নিয়ে আসছে তাদের বড় একটি অংশ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের। কেজিএসপি যেহেতু জিপিএ-ভিত্তিক একটি স্কলারশিপ, ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুযোগটি হাতিয়ে নিচ্ছে।

মনবুশো ও কেজিএসফি স্কলারশিপ প্রদানের আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সুপারিশ। আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।

অন্যদিকে জাপানের ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তারা জাপানে বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজের সুযোগ কিংবা কারিগরি কলেজগুলোতে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়ে দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের চিহ্নিত তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদেরও জাপানে আনছে। এই ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই গাড়ি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত। এ ছাড়া কলিং কার্ড সেবা, হালাল সামগ্রী সরবরাহ, রেমিটেন্স ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে জামায়াত-শিবির। এরা মূলত জাপানে তাদের কর্মীদের চাঙ্গা করার দায়িত্বে নিয়োজিত।

ঠিক একই চিত্রটি কোরিয়াতে বিরাজ করছে। যদিও প্রথম সারির বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তবে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। কোরিয়াতে আওয়ামী লীগের মোট তিনটি কমিটির কথা শোনা যায়। অন্যদিকে বিএনপি সেই অর্থে কোরিয়াতে নেই। আবার আওয়ামী লীগ-বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীরা আলাদা আলাদাভাবে জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আঁতাত করে চলে।

উপরন্তু, অনেকেই আছে বিএনপির খোলস পরে গোপনে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কোরিয়া কমিটির প্রাক্তন এক নেতা ও ব্যবসায়ী দিনের পর দিন সিউলের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরে এক নেতার সরকারবিরোধী নানা ফেসবুক পোস্টে 'লাইক' দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি শেখ হাসিনাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে যেসব পোস্ট দেওয়া হয়, সেগেুলোতেও আওয়ামী লীগের এই নেতার 'লাইক' দেখা যায়।

জামায়াত-শিবির দেশে কোণঠাসা। তারা এখন ইউরোপ ও নর্থ-আমেরিকার মতো পূর্ব-এশিয়াতেও শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের বিদেশি বোদ্ধারা 'উচ্চশিক্ষার' ছত্রছায়ায় শিবিরের মেধাবী ও আগামীর নেতৃত্বে তৈরি করার অভিনব কায়দায় নেমেছে।

জাপানে ও কোরিয়াতে জামায়াত-শিবির ভিন্ন কৌশলে এগিয়ে চলছে। তারা জামায়াত-শিবিরের নামে প্রচারণা করছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন নামে পেজ খুলে কিংবা অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে নিজেদের বিষাক্ত আদর্শ ছড়াচ্ছে। যেমন: 'সেভ হিউম্যানটি ইন বাংলাদেশ', 'ইসলামিক মিশন', 'ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন', 'জাপানবাংলানিউজ', 'প্রবাসে বাংলাদেশ ডটকম' ও 'সিএনএনটিভি'সহ অন্তত ডজনখানেক সংগঠনের নামের আড়ালে জামায়াত-শিবির প্রচারণা চালাচ্ছে।

যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মীর কাসেমের ফাঁসির পর এই অনলাইন গ্রুপগুলোতে শুধু অপ্রচারই চালায়নি, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে অশ্লীল ও অশালীন ছবি পোস্ট করে উল্লাস করতে দেখা যায়।

গত ২৬ ও ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরের সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ করে যুদ্ধাপরাধী কামরুজ্জামান-মুজাহিদ ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের 'মুমিন বান্দা' বলে আখ্যা দিয়ে রাস্তায় নামে। জাপানি পত্রিকাগুলোকে ফোকাস আনতে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা জাপানি ভাষায় বক্তব্য দেয়।

জাপানের জামায়াত-শিবিরের দুর্গ হিসেবে পরিচিত কাগুশিমা, সায়তমা, কোবে, ওসাকা ও চিবাতে মসজিদে মসজিদে জাপানি, ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ব্যানার নিয়ে 'মাতম' করতে দেখা যায়।

জাপানের মতো কোরিয়ার কিছু শহর জামায়াত-শিবিরের দুর্গ হিসাবে বেশ পরিচিতি পাচ্ছে। বিশেষ করে সিউল, দেজন এবং জিঞ্জুতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেজনে ছাত্রশিবিরের এক নেতা প্রতি সেমিস্টারেই বাংলাদেশ থেকে অনেক ছাত্রকে বেনামি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে নিয়ে আসছে, যাদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। কোরিয়ার অন্যান্য শহরগুলোতেও জামায়াত-শিবির ঘাঁটি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে কিছু কিছু শহরে জামায়াত-শিবির বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

কোরিয়াতে জামায়াত-শিবিরকে একটি প্ল্যাটফর্মে এনে দেয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের একটি সংগঠন। সংগঠনটির নাম 'Bangladeshi Student's Association in Korea' (সংক্ষেপে 'BSAK')। সংগঠনটির জন্মের সময় সদস্যসংখ্যা ছিল ৩২; বর্তমানে সদস্যসংখ্যা সহস্রাধিক। শুরুতে সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিল উদারপন্থীরা। বাম আদর্শে বিশ্বাসীরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আদর্শের মানুষ।

জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সংগঠনটির উদারপন্থী নেতাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে সংগঠনটির নেতৃত্ব হাতে নেয়। সংগঠনটি গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন 'গেট টুগেদার' ছাড়া অন্য কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে না। শিবিরের নেতাকর্মীদের হাতে নেতৃত্ব যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে প্রথমে আওয়ামী লীগপন্থীদের এবং পরে বিএনপিপন্থীদের সরিয়ে দেয়।

বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন ভাসমান উদারপন্থীদের সংগঠনটির নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়; তবে অনেকেই টিকতে পারেনি। এই সংগঠনটি যখনই ছাত্রশিবিরের হাতে চলে যায়, তখনই ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত গেট টুগেদারে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কথা বলা বন্ধ করা হয়, বন্ধ ছিল রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া।

প্রায় প্রতিটি গেট টুগেদারে সংগঠনটি একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করত। আগে সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল উদারপন্থীদের হাতে, পরে সেটি চলে যায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের হাতে। একাত্তর নিয়ে গল্প প্রকাশ করতে দেয়নি সেই সাহিত্য সাময়িকীতে সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা জামায়াত-শিবির। মূলত এই সংগঠনটির মাধ্যমেই জামায়াত-শিবির তাদের মতাদর্শের মানুষদের খুঁজে পায়। পরবর্তীতে তারা আলাদা সামাজিক গ্রুপ খুলে নিজেদের চিন্তাচেতনার প্রসার ঘটায়। এখন অন্যান্য সামাজিক সংগঠন খুলে নিজেদের আরও সুসংহত করছে। সামাজিক বৈধতার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি কৌশল করে নিশ্চিত করে নিচ্ছে জামায়াত-শিবির।

ঢাকায় আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর জাপানের গোয়েন্দারা বাংলাদেশিদের প্রতি নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। জাপানের গোয়েন্দা সংস্থার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা লেখকদের একজনকে জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএসকে অন্তত ২০ বাংলাদেশি অর্থসহায়তা দিয়েছেন বলে তাদের ব্যাংক আকাউন্ট তলবে উঠে এসেছে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এরা সবাই ইসলামিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, জাপান প্রবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে সুজিত চন্দ্র দেবনাথই পরবর্তীতে ধর্মন্তারিত হয়ে সাইফুল্লাহ ওজাকি 'মনবুশো' স্কলারশিপে ২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর রিসুমেকান ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন। আইএসে যোগ দেওয়ার আগে এই বাঙালি জাপানের অন্যতম 'সুমিতমো ব্যাংক' থেকে ১৫০ মিলিয়ন ইয়েন (জাপানি মুদ্রা) অনলাইন ব্যাংকিং মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ের একটি ব্যাংকে লেনদেন করেন বলে গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়। আইএসে যাওয়ার আগে এই ওজাকি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক গোষ্ঠীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করতেন।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যে উগ্রবাদের চাষাবাদ হচ্ছে সেই বিষয়ে সম্যক ধারণা জাপানে ও কোরিয়াতে বাংলাদেশের দূতাবাসের আছে বলে মনে হয় না। দূতাবাসগুলো কেবল কিছু পাসপোর্ট প্রদান এবং বাংলাদেশ থেকে আগত সরকারের প্রতিনিধিদের প্রটোকল দেওয়া মধ্যেই নিজেদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখছে বললে ভুল হবে না।

দেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা রুখতে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত বরাবর ইমেইল করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেওয়া টেলিফোন নম্বরে ফোন করে তাদের পাওয়া যায়নি।

উগ্রবাদ নিরসনে সিউলস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসকেও তেমন কোনো কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। রবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দূতাবাসের সুপারিশে 'উজং স্কলারশিপ' নামে একটি স্কলারশিপ দেওয়া হয়। বহু ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মী অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ নিয়ে সেই স্কলারশিপ পাচ্ছে। দূতাবাসের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের একাংশের ভালো সম্পর্কের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে আলোচনা রয়েছে।

এমতাবস্থায় জাপানে ও কোরিয়াতে ছাত্রশিবিরের উত্থান ঠেকাতে হলে সবার আগে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে 'জামায়াত-শিবিরপ্রীতি' বন্ধ করতে হবে। দেশ দুটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা– যারা উদার মতবাদে বিশ্বাসী– তাদের একটি প্লাটফর্মে আসতে হবে। ধর্মকে সামনে রেখে যেন ছাত্রশিবির কোনো ক্যাম্পাসে ঘাঁটি গড়তে না পারে, তা প্রবাসীদেরই নিশ্চিত করতে হবে। দূতাবাসগুলোকে আরও সতর্ক হতে হবে যেন দূতাবাসের কোনো কর্মকাণ্ডে ও নিষ্ক্রিয়তার ফলে জাপানে ও কোরিয়াতে ছাত্রশিবির অনুপ্রাণিত ও শক্তিশালী না হয়।

লেখকদ্বয়–
বিজন সরকার ভাষা গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং
নাদিম মাহমুদ জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত।