ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: শ্রদ্ধাঞ্জলি

কবীর চৌধুরী
Published : 1 Nov 2016, 05:51 PM
Updated : 1 Nov 2016, 05:51 PM

কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের মনে রাখা দরকার, যাদের কথা বলা দরকার, তাদের স্বার্থে নয়, আমাদের নিজেদের স্বার্থে। এমনি একটি মানুষ শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কথা বলা দরকার আমাদের কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করার জন্য নয়, ওই জাতীয় ঋণ শোধ করা যায় না। যেটা দরকার ইতিহাসের প্রয়োজনে, ইতিহাসকে সঠিক প্রেক্ষিতে তুলে ধরবার জন্য। বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মকে তা অনুপ্রাণিত করবে, তাদের নিজেদেরকে বরণীয় করে তুলবার পথ দেখাবে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী, কিন্তু সেটা তাঁর গৌণ পরিচয়। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতচিত্ত দেশপ্রেমিক, দৃঢ়চেতা ও নির্ভীক রাজনীতিবিদ, খাঁটি বাঙালি। ১৯৪৮ সনে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তার কথা হয়তো আমরা কেউ কেউ জানি, কিন্তু তার আগেও তিনি যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলেন তার কথা বিশেষ জানি না।

বর্তমান শতকের প্রথম দশকের শেষ দিকে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করে, তারপর আইনের ডিগ্রি নিয়ে, তিনি স্বজেলা কুমিল্লায় আইন ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি তাঁর যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর কাজকে শুধু আইনের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারল না। ১৯২১ সালে তিনি কংগ্রেসের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিলেন, ১৯৩০-এ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য গ্রেপ্তার হলেন, ১৯৩৭-এ কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্যপদ লাভ করলেন।

তিনি ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সুবক্তা, যুক্তিবাদী, সর্বদা পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে। শুধু একজন সফল আইনজীবী হিসেবেই তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে তথাকথিত শান্তিপূর্ণ নিরুদ্বেগ স্বাচ্ছল্যের জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া মানুষ। ১৯৪২-এ গান্ধীজীর আহ্বানে যখন 'ভারত ছাড়' আন্দোলন শুরু হল তখন তিনি নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে পারলেন না। ফলে আবার তিনি গ্রেপ্তার হলেন।

তারপর ১৯৪৭-এ ব্রিটিশরাজের পতন, ইংরেজের উপমহাদেশ ত্যাগ, ভারত বিভাগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বেশ কিছু বিত্তশালী, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ভারতে চলে গেলেও ধীরেন দত্ত পাকিস্তানেই থেকে যান। এই অঞ্চল তাঁর জন্মভূমি, এখানেই তাঁর প্রায় সারা জীবন কেটেছে, এ দেশকে একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে তাঁর কিছু করার আছে, এই প্রত্যয়ই তাঁকে পাকিস্তানে থেকে যাবার প্রেরণা যোগায়। তাই তিনি শুধু থেকেই গেলেন না, নিজেকে নতুন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সোৎসাহে যুক্ত করলেন।

১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর যখন পাকিস্তান গণপরিষদ গঠিত হল তখন তিনি তার সদস্য হলেন। পরিষদ পরিচালনার নিয়মকানুনে উল্লেখিত হয়েছিল যে, গণপরিষদের আলোচনায় ইংরেজি বা উর্দু ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। ১৯৪৮-এর ২৩ ফ্রেরুয়ারি যখন গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয় তখনই এ কথা বলা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারলেন না। এর অযৌক্তিকতা, এর অগণতান্ত্রিকতা প্রভৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনলেন এবং বাংলা ভাষাকে সমান মর্যাদা দানের দাবি জানালেন। তিনি জোরের সঙ্গে বললেন যে গণপরিষদে বাংলাতেও বক্তৃতা দানের অধিকার স্বীকৃত হওয়া উচিত, কেননা সমগ্র পাকিস্তানের অধিবাসীদের শতকরা ষাট জনের বেশি বাঙালি এবং তাদের শতকরা পঁচানব্বই জনেরও বেশি লোকের মাতৃভাষা বাংলা।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভাষার প্রশ্নে সংশোধনী প্রস্তাব আনেন এবং বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নেন। তাঁর ঐতিহাসিক সংশোধনী প্রস্তাবটি অবশ্য সেদিন ভোটে টেকেনি। এই অঞ্চলের অনেকের মনে তখনও বাঙালিত্বের চেতনা গভীর নিদ্রায় সুপ্ত, পাকিস্তানের অলীক মোহে তারা তখনও অন্ধ।

তবে সকলেই যে ওরকম ছিলেন তা নয়। বাংলা ১৩৫৪ সালের 'সওগাত' পত্রিকার একটি সংখ্যায় কাজী মোতাহার হোসেন তখন লিখেছিলেন, "বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশী দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।"

পাকিস্তানি শাসকবর্গের গোঁয়ার্তুমি এবং সাধারণভাবে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার দুর্বল অবস্থা দেখে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কিন্তু হতোদ্যম হননি কিংবা অভিমানভরে নিজেকে রাজনীতির অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে আনেননি। ১৯৫৪ সালে তিনি আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। আবু হোসেন সরকার ও পরে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেন। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সভায় বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করার জন্য বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও ধর্মান্ধ মহল তাঁকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ধারক, পাকিস্তানবিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী, পাকিস্তানের সংহতি ধ্বংসের চক্রান্তকারী প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ওই রকম আরও কিছু মানুষের অবস্থানের মধ্য দিয়েই যে সেদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সূচিত হয়েছিল আজ তা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। সেই চেতনার বিকাশ ধারাতেই একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই স্বাধীন বাংলাদেশ বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই বর্বর পাক হানাদার বাহিনী যে নির্মম গণহত্যা অভিযান শুরু করে তিনি তাঁর শিকার হন। তাঁকে কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় ২৯ মার্চ, ১৯৭১। বেছে বেছে যাঁদের হত্যা করা হয় তাঁদেরই একজন ছিলেন শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

তাঁকে আমরা ভুলতে পারব না।

[কবীর চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি তিনি এই স্মৃতিতর্পণ করেছিলেন একটি সংকলনে।]

— ছবি ও লেখার সৌজন্য: এ্যারোমা দত্ত।