প্রতিবন্ধীর জন্য সমঅধিকার

জিল্লুর রহমান রতন
Published : 5 Dec 2011, 01:21 PM
Updated : 5 Dec 2011, 01:21 PM

বিশ্বের প্রায় শতকরা ১০ ভাগ জনগোষ্ঠী যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধিতার সমস্যায় আক্রান্ত। বিশাল এ জনগোষ্ঠী অবিরাম সামাজিক বৈষম্যের শিকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সুযোগের উপর নির্ভরশীল। এ ধরনের সুযোগের অভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ ক্রমাগত সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বাইরে রেখে জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। এজন্য তাদের অন্যসব নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও সুযোগের সমতা বিধান ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য " প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্তকরণ ও সবার জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়ি"।

বিগত বছর গুলিতে এ দিবসের প্রতিপাদ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণের অন্তর্ভূক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । এবারও ঠিক একইভাবে প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের অন্তর্ভূক্তির উপর জোর দেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমঅধিকার রক্ষায় অগ্রগতি অনেক, কিন্তু এখনো তা কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌছেনি। প্রায় ত্রিশ বছর আগে জাতিসংঘ এ দিবসের সূচনা করে ২০০৬ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কনভেনশন (Convention on the Rights of Persons with Disabilities) প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে অধিকার রক্ষায় একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। কিন্তু সিআরপিডির আদলে এখনো আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ কিংবা প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১০ কোনটিরই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি যা দুর্ভাগ্যজনক। কাল বিলম্ব না করে এ বিষয়ে দ্রত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংসংস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অধিকার সুরক্ষা ও সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে সিআরপিডিতে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে। এ জন্য আমাদের দায়িত্বও বেশী।

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শুধুমাত্র আইনি সুরক্ষা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমাজে সহজগম্যতা বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রায়ই দেখা যায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বরাদ্দকৃত রাষ্টীয় সুযোগ সুবিধা অন্যরা অপব্যবহার করছে। বাসে বরাদ্দ সিট থেকে শুরু করে, স্কুলে বরাদ্দকৃত আসন ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ভাতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি প্রযোজ্য। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের অভিবাবকদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে অবহিত থাকা প্রয়োজন যাতে তারা সেটি গ্রহণ করতে পারেন। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যাযের অফিস হতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বিনামূল্যে চলাচল সহায়ক উপকরণ যেমন কৃত্রিম অঙ্গ, হুইল চেয়ার , স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, ক্রাচ প্রভৃতি সরবরাহ করা হয়। এ তথ্যটি জানা না থাকলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এ ধরনের সেবা গ্রহণ করতে পারবেন না।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণে ১৯৯৯ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠিত হলেও ২০০৯ সালে এর কার্যক্রমে নতুন গতি সঞ্চার হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ভবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার, বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা উপকরণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছে যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলায় সম্প্রসারণ করা হবে। এছাড়াও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র প্রতিবন্ধী ভাতা ও ছাত্রদের জন্য শিক্ষা বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে এসব কার্যক্রম মনিটরিংএর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। এদের মধ্যে মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধগণ বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষত প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট সিডর ও আইলার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ সবচেয়ে বেশী ক্ষতির শিকার। লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবন্ধী মহিলার ক্ষেত্রে আরো প্রকট। এছাড়াও শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন এবং সহিংসতাও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষেত্রে বেশী ঘটে থাকে। সম্প্রতি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী একজন শিশুকে মজা করে শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার মত নির্মম ঘটনা আমরা পত্রিকায় দেখেছি। এ ধরনের দুর্বৃত্তদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যাতে তা পুর্নবার না ঘটে। প্রতিবন্ধী শিশুদের বেশীর ভাগ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ হতে বঞ্চিত । বেকারত্ব ও দারিদ্র্র্য যেন প্রতিবন্ধিতার সমার্থক। আর দারিদ্র্য ও প্রতিবন্ধিতার রয়েছে একটি দৃষ্ট চক্র। একটি আরেকটিকে প্রভাবিত করে থাকে। এজন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উপযোগী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে যেটি পুর্নবাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রায়ই দেখা যায় প্রতিবন্ধিতার জন্য তার কাজের দক্ষতার কোন সমস্যা না হলেও শুধুমাত্র নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে চাকুরিচ্যুত কিংবা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভূক্ত করতে না পারলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন প্রতিবন্ধী বান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও এর দ্রত বাস্তবায়ন। উন্নয়ন বিষয়ক সকল কর্মকাণ্ডে প্রতিবদ্ধিতা বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু এজন্য প্রতিবন্ধিতার জাতীয় পরিসংখ্যান দরকার। সদ্য সমাপ্ত আদমশুমারিতে প্রতিবন্ধিতার তথ্য ঠিকমত সংরক্ষিত না হয়ে থাকলে তা হবে অনভিপ্রেত। কারণ এ তথ্য ঠিকমত না পেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সঠিক কর্মসূচী গ্রহণ সম্ভব নয় । আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া আছে সংবিধানে। অন্যসব নাগরিকের মত সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমান অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দাযিত্ব। তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য আমাদের সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে।

ডাঃ জিল্লুর রহমান রতন: সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।