প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে কি?

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 12 Nov 2016, 04:37 AM
Updated : 12 Nov 2016, 04:37 AM

বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাত দশমিক ১১ শতাংশ, যা অতীতের সব অর্জনের চেয়ে বেশি এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলনের সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার হিসাব এবং এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ মহলের ধ্যানধারণা বা প্রক্ষেপণ অতিক্রান্ত করে রের্কড সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল, এবারের প্রবৃদ্ধির হার বড় জোর ছয় দশমিক সাত শতাংশ অর্জিত হবে। কিন্তু তার অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রমাণ করে বাংলাদেশ সত্যিই এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে, যা বিশ্বের অনেক দেশের কাছে চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২০১৫-২০১৬ সালে ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকায়। গত বছরে এর পরিমান ছিল ১৫ লাখ ১৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। এই হিসাবে দেখা যায়, ২০১৪-২০১৫ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ছয় দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে ছিল ছয় দশমিক ছয় শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি এবং প্রবৃদ্ধির হারের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে।

লক্ষণীয় যে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের কিছুটা অবনতি হিসাব করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বা গ্রস ন্যাশানাল ইনকাম (জিএনআই) উপনীত হয়েছে এক হাজার ৪৬৫ ডলারে, যা বড় ধরনের সাফল্য। কিন্তু গরিব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে কি? এ প্রশ্ন দেশবাসীর, অর্থনীতিবিদদের এবং সুশীল সমাজের অনেক মানুষের।

বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ২৫ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সন্মেলনে গত অর্থবছরের এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরে উল্লেখ করেন যে, এ তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন, এই অর্জন দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদানের সুফল। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, দেশের সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে দারিদ্র্য জয়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

তবে অনস্বীকার্য যে, দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে কমপক্ষে আট দশমিক আট শতাংশ এবং তা চলতে হবে কয়েক বছর ধরে। লক্ষণীয় যে, এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়লে দারিদ্র্য কমতে পারে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে। এমন প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করতে পারলে তবেই ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে হতদরিদ্র মানুষের হার তিন শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে, যা হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) লক্ষ্য। এখানেই হচ্ছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে দারিদ্র্য নিরসনের এবং ক্ষুদামুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়নের সর্ম্পক।

আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎযাপন করব ২০২১ সালে। এ সময়ে দেশের কত মানুষ দুই বেলা খেতে না পাওয়ার বেদনায় রাত্রিযাপন করবে সে হিসাব শুরু করতে হবে এখনই। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ হতদরিদ্র। এরা অনেকেই ভিক্ষুক; দুই বেলা খেতে পায় না। হতদরিদ্র এসব লোকজন তাদের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেয়।

অথচ তাদের স্বজন এবং পরিবারের লোকজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দিয়েছে, চরম নির্যাতন ভোগ করেছে, দেশ ছেড়ে শরণার্থী হয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার হিসাবে এই ১২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ হচ্ছে প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ। এর অর্থ হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষ দুই বেলা খেতে পায় না। জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন-প্রতিরাত সংগ্রাম করে তারা, বেদনায় অশ্রু বিসর্জন করে নীরবে-নিভৃতে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, আনন্দ তাদের কাছে অপরিচিত শব্দ। তারা শুধু শুনতে পায় কান্না, নবজাতকের আর্তনাদ, প্রবীণের আহাজারি। পৃথিবীর প্রায় ১৭৫টি দেশ আছে যাদের মোট জনসংখ্যা দুই কোটির কম।

সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী লোকজনের পরিমান হচ্ছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। যার অর্থ হচ্ছে প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। এই চার কোটি মানুষ সত্যিই গরিব। জীবনকে উপভোগ করার মতো তাদের কোনো সাশ্রয় নেই। তাদের জীবনে 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়'। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পরিকল্পনাকারীদের ভাবতে হবে– আমরা কি ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে নির্বাসনে পাঠাতে পারব?

জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে সব ধরনের দারিদ্র্যকে নিরসন করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে বিরাজিত দারিদ্র্য হ্রাস করে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। জনসাধারণের সবার অর্থনৈতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশের সমান অধিকার ও সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সব ধরনের বঞ্চনা ও বেদনা থেকে সব স্তরের নাগরিককে মুক্ত করতে হবে। ২০৩০ সালের লক্ষ্য হচ্ছে, হতদরিদ্রের হার তিন শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা এবং এই লক্ষ্য অর্জন করতেই হবে অবশ্যই। এ এক কঠিন পরীক্ষা।

বাংলাদেশে যেভাবে প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত আছে তার ফলে দারিদ্র্য নিরসন কি সম্ভব? কর্মজীবী মানুেষর মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ এখনও কৃষিনির্ভর। কিন্তু এবারের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর আহরিত তথ্য অনুসারে দেখা যায় যে, কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়েনি, পক্ষান্তরে হ্রাস পেয়েছে। এ খাতে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল তিন দশমিক ৩৩ শতাংশ, কিন্তু এবার হয়েছে মাত্র দুই দশমিক ৭৯ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতির ভিত্তিমূলে প্রবৃদ্ধির গতিবিধি টেকসই হচ্ছে না। বেশিরভাগ শ্রমজীবী বা কর্মজীবী মানুষের আয় বাড়েনি।

শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৯ হারে, অথচ গত অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় আয় বেড়েছে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত কর্মচারীদের। তবে কমপক্ষে আগামী পাঁচ বছরের এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যার অর্থ হচ্ছে এ খাতে প্রবৃদ্ধি আর বাড়বে না। এ হচ্ছে সরল হিসাব, কিন্তু আরও বিষয় আছে যা প্রবৃদ্ধির হার প্রভাবিত করতে পারে। সেই সূক্ষ্ম আলোচনায় না-ই বা গেলাম।

শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রগতি। কিন্তু এই শিল্প হচ্ছে কাঁচামাল আমদানি-নির্ভর শিল্প। অনেক সরঞ্জাম আমদানি করতে হয় এ শিল্প রক্ষা করতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো অঘটন ঘটলে অথবা মুদ্রা বাজারে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় হলে এ শিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশের অপর একটি উপার্জন খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। এখানেও কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

এত সব চ্যালেঞ্জর মধ্যেও বাংলাদেশ যে হারে দারিদ্র্য নিরসনের অঙ্গনে অবদান রেখেছে, তা বিশ্ববাসীকে চমক দিয়েছে। বড় কথা হল এ দেশে ২০০৫ সালে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশে। অর্থাৎ, বিগত ১০ বছরের এমন অসামান্য অগ্রগতি সাধন করেছে যা বিশ্বে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাই বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম, গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং; তাঁরা এসেছেন দেখতে এবং অনুধাবন করতে অজেয় মানুষের অপরিসীম শক্তি, যা তাঁরা ১৯৭১ সালে দেখলেও বুঝতে পারেননি।

তাই ভরসা করা যায়, বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে জাতীয় চেতনায় ঐক্যের সুর, কর্মে থাকতে হবে উৎসাহ ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবনা। বলাই বাহুল্য, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকেই।