দীপাবলী: অন্তরের আলোয় দেখা, অন্তরের আলো দেখা

রীতা রায় মিঠু
Published : 29 Oct 2016, 05:19 PM
Updated : 29 Oct 2016, 05:19 PM

বিশ্বব্যাপী মহাসমারোহে উদযাপিত হচ্ছে আলোক উৎসব 'দিওয়ালি' বা দীপাবলী। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাবে, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি তিথি অনুযায়ী দিওয়ালি উদযাপিত হবে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দীপাবলী বা দিওয়ালির দিনটি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মরিশাস, গায়ানা, ত্রিনিনাদ, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ফিজিতে সরকারি ছুটি থাকে। যদিও বলা হয়ে থাকে দিওয়ালি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু অন্য সম্প্রদায়, যেমন, শিখ, জৈন, আর্য সমাজ, বৌদ্ধরাও এ উৎসবে যোগ দেয়।

দিওয়ালি মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও, আলোকের পুণ্যশিখার ব্যাপ্তি শুধু হিন্দুদের ঘরে আটকে থাকে না। আলোকোৎসবের ছটায় প্রত্যেক মানুষের জীবন থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়, সব অশুভ পালিয়ে যায়– এই হচ্ছে দিওয়ালির মূল বার্তা।

প্রদীপের মালা অথবা 'রো অব লাইট' থেকেই 'দিওয়ালি' নামকরণ হয়েছে। দিওয়ালির সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ির চারদিক ঘিরে সারি সারি মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়, যা সারা রাত আলো দেয়। এভাবে সব অন্ধকার ও অশুভ বিদায় করে ধনলক্ষ্মী দেবীকে আবাহন করা হয়। লক্ষ্মী দেবী প্রদীপের আলোয় পথ চিনে গৃহীর গৃহে প্রবেশ করে সংসারের আসনে অধিষ্ঠিত হন।

দিওয়ালির সন্ধ্যায় সবাই নতুন জামা-কাপড় পরেন। খুব ধুমধাম করে বাজি পোড়ানো হয়। বিশ্বাস করা হয়, বাজি ফোটার আওয়াজে ভয় পেয়ে আশেপাশে ওত পেতে বসে থাকা সব বিপদ-আপদ, অসুর-শয়তান দৌড়ে পালাবে। বাজি পোড়ানো শেষে পরিবার, প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব মিলে চলে মিষ্টিমুখ করা।

জড়িয়ে থাকা বিশ্বাস:

১. অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, ত্রেতা যুগে ১৪ বছরের বনবাস কাটিয়ে এই দিনে শ্রী রামচন্দ্র অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে ২০ সারিতে প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং দিবসটি রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবেই পালিত হয়। আবার কারও কারও মতে, মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস শেষে এই দিনে ফিরে এসেছিলেন নিজেদের গৃহে।

২. বিশ্বাস করা হয়, দ্বাপর যুগে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নরকাসুরের যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর স্ত্রী সত্যভামা দেবী নরকাসুরকে হত্যা করেন। সবার মধ্যে শান্তি ফিরে এলে ঘরে ঘরে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো হয়। সেই থেকে দিওয়ালি উদযাপিত হয় নরকা চতুর্দশীতে।

৩. শিখ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং কারামুক্ত হয়েছিলেন এই দিনে। তাই মহাসমারোহে তারা দিওয়ালি উদযাপন করে। পাঞ্জাবের অধিকাংশ শিখ পরিবারে সারা দিন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ 'গ্রন্থসাহিব' পাঠ করা হয়। এই দিনে সবাই নিরামিষ খান। সন্ধ্যায় যথারীতি আলোর মালায় সাজানো হয় ঘরবাড়ি, গুরুদুয়ারা। বাতাসে বাজি ছুঁড়ে দেওয়া হয়, যার সরল অর্থ হচ্ছে 'ফ্রিডম'।

৪. বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকেই দিওয়ালি উদযাপন করেন। তারা দিনটি 'অশোক বিজয়াদশমী' হিসেবেও গণ্য করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, এই দিনে সম্রাট অশোক সবাইকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিতে আহবান জানিয়েছিলেন।

৫. আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ দেহত্যাগ করেন ১৮৮৩ সালের ৩০ অক্টোবর। সেই থেকে আর্য সমাজে দিওয়ালি উদযাপিত হয় 'স্বামী দয়ানন্দ প্রভুর মৃত্যুবার্ষিকী' হিসেবে। পুণ্যময় এই দিনে সবাই প্রার্থনা করেন। সন্ধ্যায় মঙ্গলালোক জ্বালানো হয়

৬. বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মিথিলার হিন্দু সম্প্রদায় দিওয়ালি উদযাপন করে ভিন্ন নামে, ভিন্ন আঙ্গিকে। দুর্গাপুজার ঠিক দুই সপ্তাহ পরেই অনুষ্ঠিত হয় কালীপুজা বা শ্যামাপুজা, যার আরেক নাম 'দীপাবলী'। কালীপুজা হয় অমাবস্যা তিথিতে। পুজার সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ি সেজে উঠে সারি সারি মাটির প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয়। শহরে-নগরে মাটির প্রদীপের পরিবর্তে জ্বালানো হয় রঙ-বেরঙের মোমবাতি। ধর্মীয় বিশ্বাস, দীপাবলীর সন্ধ্যায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে পূর্বপুরুষদের আলো দেখানো হয়। বাঙালি হিন্দুও রাতভর বাজি পোড়ান একই উদ্দেশ্যে– সব অশুভ শক্তি যেন দূরে পালিয়ে যায়।

টুকরো টুকরো শৈশব-স্মৃতি:

ছোটবেলায় কালীপুজার সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে বাড়ির চারদিক সাজাতাম আমরা। প্রতিটি বাড়ি আলোয় ঝলমল করত। যে দিকে তাকানো যেত শুধুই আলোর মালা। মোমবাতি প্রজ্জ্বলন শেষে শুরু হত বাজি-পোড়ানো উৎসব। কত আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে যে পোড়ানো হত বাজি।

সে সব বাজির নামও ছিল কত বিচিত্র। আতশবাজি, মাতাববাজি, মরিচবাজি, কাঠিবাজি, ডিল্লাপটাশ, মালাবাজি, ব্যাঙবাজি, সাপবাজি, ফুলঝুরি– আরও কত বাহারি নাম! আমরা দলবেঁধে মহল্লার ভেতর হাঁটাহাঁটি করতাম। এক দলের বাজি পোড়ানো শেষ হলে আরেক দলের শুরু হত। এভাবেই চলত অনেকক্ষণ।

কালীপুজা হত গভীর রাতে। এর মূল আকর্ষণ ছিল সারারাত জেগে থাকা। বাবা মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যেত সে জন্য। রাত তো কম লম্বা নয়। বছরের বার মাস ঘুমিয়ে রাত পার করে দিই। তাই জানা হয় না শুধু রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে রাত কাটাতে কেমন লাগে। কালীপুজার রাতে তা জানা হত।

আমাদের একটা মজার জিনিস ছিল, লক্ষ্মীপুজার সময় যত নারকেল ভাঙ্গা হত, তার খোল অর্থাৎ চারা (আমরা বলি 'আইচ্চা') জমিয়ে রাখতাম। কালীপুজার রাতে নারকেলের খোলের মধ্যে মোমবাতি বসিয়ে টর্চলাইট বানাতাম আমরা। খোলের ভেতরের মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই আলোয় পথ দেখে ঘোরাঘুরি করার মধ্যে বেশ একটা বাহাদুরি ভাব ছিল। রাত একটা কী দুটো বাজতেই আমাদের সারারাত জাগার উচ্ছ্বাস কমে আসত। তারপর যে যার ঘরে ফিরে ঘুম দিতাম।

ছোটবেলা পেরিয়ে এসেছি সেই কবে, কোন কালে! সংসারের প্রয়োজনে, জীবনের তাগিদে ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ দেশান্তর। যে দেশে যেখানেই থেকেছি, প্রতি বছর দীপাবলী উদযাপন করেছি। এর ভাবার্থ নিয়ে ভাবিনি, বাচ্চাদের সঙ্গে বাজি পোড়ানোতেই বেশি আনন্দ পেয়েছি। প্রবাসে দেখেছি ভারতীয় মহল্লাগুলোতে বাজি পোড়ানোর ধুম লেগে যায়। ধনী দেশে কত রকমের সুবিধা। তারা নিজেদের জাতীয় উৎসবে ও ফুটবল গেমে 'ফায়ারওয়ার্ক' করে। সেই ফায়ারওয়ার্কে কী-সব চোখধাঁধানো বাজি পোড়ানো হয়!

এগুলো দেখে মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় তিন পয়সায় কেনা একটি কাঠিবাজি হাতে পেলেই আনন্দে আটখানা হয়ে যেতাম আমরা। তারাবাতি হাতে নিয়ে ঘুরতাম। জ্বালালেই শেষ হয়ে যাবে এই ভয়ে জ্বালাতাম না। আর আমার বাচ্চারা তারাবাতির দিকে ফিরেও তাকায় না। আকাশের বুকে নানা বর্ণের, নানা ডিজাইনের বাজি ফুটতে দেখেই ওদের আনন্দ। তারাবাতি তো ওদের কাছে 'দুধভাত'।

দীপাবলীর মূল সুর:

দিওয়ালি বা দীপাবলী উৎসব মূলত 'ফেস্টিভ্যাল অব লাইট' নামে পরিচিত হলেও, ধর্মীয় দিক বিবেচনায় দিওয়ালির মূল অর্থ হচ্ছে 'অন্তরের আলো' বা 'আত্মার উজ্জ্বলতা'। হিন্দু দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে, দেহ ও মনের আড়ালে যা থাকে তার নাম 'অন্তর' বা 'আত্মা', যা অসীম, অবিনশ্বর এবং বিশুদ্ধ। সেই অন্তরের আলো জ্বালতে পারলেই শুভবুদ্ধির জয় হয়, অশুভ শক্তি পরাজিত হয়। মূর্খতা, অজ্ঞতা, হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ, লোভ, অহংকার, চৌর্য্যবৃত্তির অন্ধকারে যখন ঢাকা থাকে মানুষের অন্তর, তখনই নৈতিক স্খলন ঘটে। হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয় মানুষ।

এসব অশুভ রিপুর কারণে মানুষের অন্তরের আলোকিত অংশটুকু আড়ালে থেকে যায়। এই আড়াল ভেঙে যখন বিবেক জাগ্রত হয়, তখনই সত্যের জয় হয়। মানুষ তার নিজের আত্মা খুঁজে পায়, জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। বিকাশের এই অনুভূতির আরেক নাম 'আনন্দ' বা 'শান্তি'। যদিও গোষ্ঠী, জাতি, বর্ণ, স্থান বিশেষে দিওয়ালি বিভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপিত হয়, তবে এর মূল বাণী এক: অন্তরের আলোয় দেখা, অন্তরের আলো দেখা।

দিওয়ালির আলোতে সব কালিমা দূর হয়ে যাওয়ার কথা– বাজি ফোটার আওয়াজে সব অশুভ শক্তি, দৈত্য-দানব, অসুর, প্রেতাত্মার ছুটে পালিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু চারদিকে যখন বিষাক্ত নাগিনীর ফোঁসফোঁসানি শুনি, প্রতিদিনের খবরের কাগজে ভাইয়ে-ভাইয়ে, স্বামী-স্ত্রীতে, প্রতিবেশি-প্রতিবেশিতে হানাহানি, খুনোখুনি, ঝগড়া-বিবাদের খবর পড়ি, মন খারাপ হয়। তবে কি দিওয়ালির প্রদীপের আলো মানুষের অন্তরে পৌঁছায় না? কবিগুরু বলেছেন–

"আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও,
মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।
আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃত গান–
তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান।
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও…"

আগে মাটির প্রদীপ জ্বলত, কাঠিবাজি, তারাবাতি পুড়ত, সবশেষে হাতে দু-চারটি নারকেলের নাড়ু বা ক্ষীরের সন্দেশ পাওয়া যেত মিষ্টিমুখ করার জন্য। কালে কালে, যুগে যুগে মানুষের উন্নতি হয়েছে। চোখধাঁধানো জৌলুস, ধনরত্নের ঝনঝনানি বেড়েছে। মাটির প্রদীপের স্থলে আকাশ আলোকিত বাজি পুড়ছে। কিন্তু মনের উন্নতি হচ্ছে কি? এত ঝলমলে আলোর রোশনাই চারদিকে, তবু কেন আমাদের অন্তরের আলো জ্বলে না? চারদিকের আলোর ঝলকানিতে অনেক দূরের বস্তুও নজরে আসে। নজরে আসে না শুধু বুকের ভেতর চুপটি করে বসে থাকা 'আত্মা'!

সময় এসেছে অন্তরের আলো জ্বালানোর, চোখ খুলে নিজেকে দেখার। তা না হলে বছরের বার মাস আলোকোৎসব করেও লাভ হবে না।