গৌরবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একজন সুশান্ত পাল

চৌধুরী শহীদ কাদেরচৌধুরী শহীদ কাদের
Published : 10 Oct 2011, 07:45 PM
Updated : 28 Oct 2016, 12:18 PM

প্রতি বছর বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একটি র‌্যাংকিং প্রকাশিত হয়। কয়েক দিন আগে এক ছাত্র ক্লাসে বলছিল, "স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বিশ্বের সেরা দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই।"

উত্তরে বলেছিলাম, "ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় যেখানে আছে, বিশ্বের সেরা দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয় কখনও সেখানে যেতে পারবে না। এই দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাটা তুমি দেখ, সেখানে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে কি না, যেটি একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে! দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে?"

বিশ্বের সবচেয়ে 'প্রভাবশালী' বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি কোনো র‌্যাংকিং করা হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিঃসন্দেহে সেখানে এক নম্বরে থাকবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে চুয়ান্নর নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফার সংগ্রাম, আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন সর্বোপরি স্বাধীনতাসংগ্রাম; বাঙালির ইতিহাস মানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস।

গত কয়েক দিন ধরেই গৌরবের এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এক নব্য আমলার 'কুরুচিপূর্ণ' মন্তব্য নিয়ে সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই নব্য আমলা সুশান্ত পাল নিজেকে যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীর পরিচয় দিয়েছেন, প্রকৃত অর্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এমবিএর ছাত্র ছিলেন। এটা আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করছি, সান্ধ্যকালীন 'সার্টিফিকেট বিক্রি'র কোর্সের সুবাদে অনেকেই নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'গর্বিত' ছাত্র বলে পরিচয় দেন। তাতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টি তখনই দৃষ্টিকটু দেখায় যখন চার বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচয় বেমালুম ভুলে গিয়ে মুখ্য করে তোলে সান্ধ্যকালীন কোর্সের পরিচয়।

তবে বিষয়টি যথেষ্ট ইতিবাচকভাবে দেখি এবং মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটাই ঢাবির কৃতিত্ব। সুশান্ত পালের তথাকথিত মন্তব্য এবং তা নিয়ে আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের যে প্রতিক্রিয়া, সেটা যথার্থ। নিজের 'মা'-কে অসম্মান করলে কোনো সন্তানেরই চুপ থাকার কথা নয়। আর স্বভাবতই প্রতিক্রিয়ায় সরব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে আমাদের কতটা প্রভাবিত করে তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন একজন অগ্রজ ও বন্ধু সাংবাদিক। তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, "আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা অনুভূতি। কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে মানুষ বানিয়েছে। আমাকে নতুন করে জন্ম দিয়েছে।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনারও অনেক জায়গা রয়েছে। যৌক্তিক সেসব সমালোচনা অবশ্যই করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই। আমি দেখেছি, বাংলাদেশের প্রায় সবখানে বিশেষ করে মফস্বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী কী করছে, সেটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী গ্রামের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চোখে 'আইকন'। তাই ঈদ, পূজা বা নানা পার্বণে ঢাবির কোনো শিক্ষার্থী যখন গ্রামের বাড়িতে যায়, তখন সে বিষয়টি অজান্তে হলেও তার মাথায় থাকে। সে সচারচর এমন কিছু করে না যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। কারণ, তার একটি ভুল আচরণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়।

ঠিক সেই কারণেই ঢাবি নিয়ে, নারী নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হল জীবন, র‌্যাগিং নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মিথ্যাচারের প্রতিবাদটাও করতে হবে জোরালোভাবে। তা না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি ভুল বার্তা যাবে সবখানে। যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

সুশান্ত বিসিএসে প্রশাসনে প্রথম হয়েছেন। আমিসহ একই বিসিএসে ঢাবি থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী নানা ক্যাডারে যোগদান করি। (যদিও পরবর্তীতে আমি ক্যাডার সার্ভিস ছেড়ে চলে আসি।) ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে ভালো ছাত্র হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কিংবা এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়নের একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর সুশান্তর মতো হাজার হাজার ক্যাডার জন্ম দেয়।

ঢাবির সার্থকতা এখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ক্যাডার বানানোর আগে একজন শিক্ষার্থীকে 'মানুষ' বানায়। মানুষ বানানোর এই প্রক্রিয়াটি যে শুধুমাত্র ক্লাস রুমে সীমাবদ্ধ থাকে, তা নয়। ঢাবির পারিপার্শ্বিকতা তাকে মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে রঙিন দিনগুলো কেটেছে ঢাবির ক্যাম্পাসে, আবাসিক হলে। ঢাবি আমাদের মনকে উদার হতে শিখিয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দিয়েছে। এর সোনালী অতীত আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে নিয়ত, শিখিয়েছে দেশপ্রেমের মন্ত্র। এখন সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হয়ে যদি কেউ ঢাবিকে মূল্যায়ন করতে চায় তাহলে তো ঘাপলা হবেই!

সুশান্তর ঘটনা নিয়ে অনেকেই বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাড়াবাড়ি করছে। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে ঢাবি নিয়ে এ রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করার জন্য সুশান্তকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। ইতোমধ্যে তিনি তার কিছুটা পেয়েছেনও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সুশান্ত মোটামুটি সেলিব্রেটি। তিনি যদি 'ক্ষমা' পেয়ে যান তাহলে ঢাবির ছাত্রীদের তিনি যেভাবে বিশ্রী অভিধায় কলংকিত করেছেন সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। সুশান্তর শাস্তির মধ্য দিয়ে সমাজের মুখোশ পরা পুরুষদের আসল চরিত্রটাও প্রকাশিত হবে আশা করি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের সুযোগে মেয়েদের যেভাবে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন, তা যদি সত্যি হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই যৌন নির্যাতন আইনে মামলা হওয়া উচিত। উচিত পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে নারীঘটিত বিষয়গুলো তদন্তের। তা না হলে সিভিল সার্ভিসে কালিমার দাগটি স্থায়ীভাবে লেপ্টে থাকবে। অবশ্য এরই মধ্যে ২৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে এক ছাত্র শাহবাগ থানায় সুশান্তের বিরুদ্ধে তথ্য ও​ যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন।

শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের কথা বলছিলাম। আসলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিম্মমুখী। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে প্রয়োজন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। শিক্ষার্থীদের মূল ভিতটা গড়ে দেয় স্কুল-কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় সে ভিতের উপর দালান তোলে। এখন ভিত নড়বড়ে হলে তো সমস্যা হবেই। আমরা এখন দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে কোনো শিক্ষার্থী রাখিনি, দেশে সব পরীক্ষার্থী!

বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা এবং প্রায় ৭০টি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাহলে বলুন, তার জীবনে আর থাকে কী?

পাশাপাশি গবেষণা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। বিদেশে কোনো গবেষক যখন পিএইচডি করেন তখন তাকে সর্বোচ্চ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়। যাতে সংসারের আর্থিক দিকটা তাকে ভাবতে না হয়। আর আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গবেষণার জন্য প্রতিমাসে বরাদ্দ দেয় মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।

ঢাবির একজন শিক্ষকের বার্ষিক গড় গবেষণা খাতে বরাদ্দ থাকে ২৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বরাদ্দ আরও কম, ৫০০ থোকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন বলুন, এই বরাদ্দ দিয়ে যদি আপনি মানসম্মত শিক্ষা চান, তাহলে তা কিভাবে সম্ভব?

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে যদি তৃতীয় গ্রেডে নামিয়ে দেন, গবেষণায় বরাদ্দ না দেন, গবেষণায় বিদেশ যাওয়ার সুয়োগ না দেন, আর বলেন র‌্যাংকিং কমছে কেন? তাহলে বিষয়টি কি পরস্পর সাংঘর্ষিক হয় না?

আমরা অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে মনে করি না। বাস্তবিক ক্ষেত্রে ঢাবি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি রাষ্ট্রের আশা আকাঙ্ক্ষারও অন্যতম কেন্দ্র। একে ঘিরে এখনও বাংলাদেশের সংস্কৃতির অনেকটাই আবর্তিত হয়। পহেলা বৈশাখ থেকে ফাল্গুন, যে কোনো উৎসব, জাতীয় দিবসে রাজধানীবাসীর অনেকে ছুটে আসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে।

ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরিরা এখনও জন্ম নেন এই ক্যাম্পাস থেকে। এখনও যে কোনো অন্যায়ের প্রথম প্রতিবাদটি শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

সংকটে-সংশয়ে পুরো জাতি এখনও অনেকটা আশা নিয়ে চেয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ইঞ্চি মাটি ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর মেজর কারবেরির কথা কাটাকাটির জেরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও শিক্ষার্থীরা। প্রায় ৮০ বছর পর ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আবার মুখোমুখি হয় ঢাবির শিক্ষার্থীরা। কী সে কাল, কী এ কাল, কোনোকালেই ঢাবির শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যেন বোস, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, কাজী মোতাহার হোসেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আবদুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, বুদ্ধদেব বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, হুমায়ুন আজাদের মতো কৃতি সন্তানদের স্মৃতিধন্য।

বরকতের মতো ভাষা শহীদ কিংবা ঊনসত্তরের শহীদ আসাদ নব্বইয়ের নূর হোসেনের জন্ম দিয়েছিল ঢাবি। শিক্ষার গুণগত মানের দিক থেকে এটি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বটে, তবে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব– সব মিলিয়ে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে 'প্রভাবশালী' বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছে।