নারীনিপীড়নের ব্যাধিরও নির্মূল সম্ভব

সৌরিন দত্ত
Published : 27 Oct 2016, 04:44 AM
Updated : 27 Oct 2016, 04:44 AM

বছর তিনেক আগে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া 'নির্ভয়া-কাণ্ডে' কেঁপে ওঠে পুরো ভারত। এর পরপরই পত্রপত্রিকায় আসতে থাকে ভারতে নারীনির্যাতনের আরও কিছু ঘটনার কথা। আমার এক ভারতীয় সহকর্মীকে তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কী ভাই, তোমরা সবাই হঠাৎ পশু হয়ে উঠলে কেন?"

ভয় হয়, সে সব খোঁচা সে না আরও বাজেভাবে ফিরিয়ে দেয়!

বদরুল-সাইফুলরা যা করছে ঘুরেফিরে 'পশু' উপমাটাই মনে আসে। সিলেটে ছাত্রীকে নির্মমভাবে কোপানো বদরুল কিংবা পাঁচ বছরের শিশুর উপর পাশবিক নির্যাতন করা সাইফুলরা ভিনগ্রহ থেকে আসা কেউ নয়, তারা আমাদের দেশের মমতাময়ী মায়েদের গর্ভেই জন্ম নিয়েছে। দুঃখ এই যে, এরা ক্রমে সংখ্যায় বাড়ছে। নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনের এই ঘৃণ্য ধারা কি চলতেই থাকবে?

দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সত্যিকারের বিপদ ভুলে থাকছি আপন মনে। মহাকালের মাপকাঠিতে ঘটনাগুলো হয়তো তেমন বড় কিছু নয়। যে দেশে প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটে (দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা মনে হয় তাদের নারীদের প্রতি অত্যাচারের বিষয়টি একরকম মেনেই নিয়েছে 'নিয়তি' বলে), কিন্তু আমাদের প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং আমরা শিক্ষিতরা একটা বিষয় বুঝতে পারছি কি না জানি না, পুরো শক্তি দিয়ে এই ভয়াবহ ব্যাধি প্রতিরোধ করতে না পারলে বিষবৃক্ষটি আমাদের খেয়ে ফেলতে আর দেরি নেই।

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল ডায়রিয়া রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্যাম্পেইন। প্রাকৃতিক কাজের পর সাবান, সাবান না থাকলে মাটি দিয়ে হাত ধুয়ে নিলে ডায়রিয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়, এমনধারা প্রচারণা চলতে থাকে। রোগীকে এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় আর আধা সের পানিতে বানানো স্যালাইন খাইয়েও মৃত্যুর হার কমানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়। এ নিয়ে রেডিও, টিভি ও গণমাধ্যমে চলেছিল ব্যাপক প্রচারণা। সারা দেশে তখন ডায়রিয়ায় মৃত্যু রুখে দেওয়া নিয়ে এত বেশি পোস্টার ছাপানো হয়েছিল যে, গ্রাম-গঞ্জে মুদি দোকানের ঠোঙ্গাও বানানো হত সে সব পোস্টার দিয়ে। পোস্টারের এই ব্যবহার সম্পর্কে দাতা গোষ্ঠীও জানতেন। অপব্যবহার না বলে ব্যবহার বলছি এ কারণে যে, দাতাদের উদ্দেশ্য ছিল, ঠোঙ্গাগুলোও যাদের হাতে পড়বে তারা সেটি পড়বে, আর তাতেই লক্ষ্য অর্জন হবে। মনে আছে হুমায়ুন আহমেদও একটি বিজ্ঞাপন বানিয়েছিলেন তাঁর জনপ্রিয় 'এইসব দিনরাত্রি' ধারাবাহিকের চরিত্রগুলো দিয়ে।

নানামুখী এসব প্রচারণার ফলাফল, দেশ এখন ডায়রিয়ামুক্ত। পোলিও নির্মুলেও কিন্তু আমরা পৃথিবীতে এক বিস্ময়। শুধু পাকিস্তান বা ভারতের চেয়ে নয়, এসব ক্ষেত্রে আমরা চীনের চেয়েও এগিয়ে। সবই সম্ভব হয়েছে সুপরিকল্পিত কর্মপ্রক্রিয়ায়। ধর্ষণ ও নারীনিপীড়নের প্রসঙ্গেও বলব, আমরা যদি এখন থেকেই বিচারিক আদালত ও শাস্তির পাশাপাশি সামাজিকভাবে পরিকল্পনা নিয়ে এগোই তবে হয়তো আমার আপনার কন্যাসন্তানটি না পারুক, আমাদের নাতনিরা এক ভয়হীন পরিবেশে বড় হতে পারবে। যে পরিবেশে থাকবে না নারী ও শিশুর প্রতি কোনো ধরনের সহিংসতা

২০০০ সালে নতুন মিলেনিয়ামের শুরুর রাতে নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন এলাকায় এক নারীর ওপর যৌন-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। মূল অভিযুক্তটি ছিল এক ছাত্র সংগঠনের নেতা। সেই টিএসসি ও সংলগ্ন এলাকা এখনও কলঙ্কমুক্ত হতে পারেনি। পনের বছর পরে সে একই জায়গায় বাংলা নববর্ষে যা ঘটেছে তা সেই ঘটনারই পরবর্তী অংক। আমরা যদি ২০০০ সালের ঘটনাটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে নিয়ে নরপশুদের বিপক্ষে কঠোরতম বিচারিক শাস্তির পাশাপাশি তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে হয়তো পরের ঘটনাগুলো ঘটত না।

কার্বাইড দিয়ে পাকানো কলা ঢাকায় ঢুকতে না দেওয়ার পুলিশি ব্যবস্থার সুফল এ বছর আমরা হাতেনাতে পেয়েছি। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা, বিক্রি আর সংরক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে চলা ব্যাপক প্রচারণার ফলও কি আমরা পাচ্ছি না? ফরমালিনের নেতিবাচক দিক নিয়ে বলে বলে আর লিখে লিখে আজ মানুষের সচেতনতা বেড়ে গেছে। মানবশরীরের সংক্রামক নানা অসুখ দুর করেছি আমরা। এখন সময় এসেছে সামজিক অসুখ নির্মূল করার।

পাঠক, ২০০০ সালের নববর্ষের ঘটনার পর যদি এদেশের সব ছাত্র সংগঠন এক সুরে বলত, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংস কেউ আমাদের সংগঠনে স্থান পাবে না এবং সবাই যদি তা মেনে চলত তবে আমার বিশ্বাস খাদিজাকে নির্মমভাবে কোপানো ছেলেটির খুঁটির জোর অনেক কম থাকত, সে এই রকম কাজ করার সাহসই পেত না। প্রায় বিশ বছর আগে এই অভাগা দেশে সোনিয়া নামে এক তিন বছরের শিশু নির্মম পাশবিকতার শিকার হয়েছিল। আমরা কি সেই নরপশুকে ফাঁসি দিয়েছিলাম? যদি সেই ঘটনাকে আমরা দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিতাম তবে আজ সাইফুলরা কোনো ঘটনা ঘটানোর আগে দুবার ভাবত।

১৯৭৬ সাল থেকে সিনেমার টিকিট, রেল টিকেটসহ আরও অনেক কিছুতে ছিল যমুনা সেতু সারচার্জ। ২৫ বছর পর হলেও সে সেতু হয়েছে। আজ যদি আমরা এভাবে সবাই এগিয়ে আসি, তবে তেত্রিশ বছর পর সবাই কথা রাখবে।

আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজ এক বিস্ময়। ভারত-পাকিস্তান যা বিশ বছরে পারেনি আমরা সাত মাসে তা করে দেখিয়েছি। কিন্তু এই মহান অর্জনের কতটুকু আমরা কাজে লাগাচ্ছি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ ট্রাফিক আইন ভাঙলে কিংবা কোনো অপরাধ করলে সেটি তার সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরে লেখা হয়ে যা্য়। এমনটি কি করে দেওয়া সম্ভব যে, কেউ একজন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা্র জন্য জীবনে একবার অভিযুক্ত হলে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে বা ডাটাবেজে সেটা ঢুকে যাবে? সে কখনও ব্যাংক থেকে লোন পাবে না। পাবে না প্রণোদনামুলক সরকারি সাহায্য। সে যদি সরকারি বা বেসরকারি চাকুরীজীবী হয় তবে তার প্রমোশন হবে না।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংস পুরুষ যদি হয় নিম্নবিত্ত বা প্রান্তিক শ্রেণির সে কৃষি লোন পাবে না, ভিজিএফএর চাল পাবে না, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসুচীর আওতায় আসবে না। অভিযুক্তরা ছোট-বড় স্থানীয় বা জাতীয় কোনো নির্বাচনেই অংশ নিতে পারবে না। ইমিগ্রেশন ফরমে যেমন লেখা থাকে, Have you ever bee refused visa of any country– সে রকম লেখা থাকবে, Have you ever been convicted for any crime against women and children– যার উ্ত্তর তাকে দিতে হবে। অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত হলে সে যদি ছাত্র হয় তবে তার উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

এমন দেশ চাই যেখানে নারী ও শিশু নিপীড়নের মামলাগুলো বিচারকরা অগ্রাধিকার দিয়ে দেখবেন। অপরাধীদের কথা ফলাও করে প্রচার করা হবে, এমনকি সে সাংবাদিক হলেও। সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালের দিকে এক কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য। প্রত্যেক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে একজন প্রাপ্তবয়স্ককে সাক্ষর করতে হত। এখনও কি আমরা পারি না এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে তিন মাস পড়াশুনার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির কাজে লাগাতে?

সবচেয়ে বড় কথা, সামাজিকভাবে আমরা সবাই নিপীড়কদের এড়িয়ে চলব। এমন পুরুষ যখন বিয়ের পাত্র হয়ে পাত্রী দেখতে যাবে, তখন পাকা কথা হওয়ার সময় কোনো মুরুব্বী বলে উঠবেন, "তো বেয়াই সাহেব, শুনেছিলাম ছেলে নাকি একবার মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছিল?"

পা্ত্রের বাবা মাথা নিচু করে বের হয়ে এসে বলবেন, "তুই মরে যেতে পারিসনি আমাকে এই অপমান করার আগে!!!"

২০০০ সালে টিএসসিতে ঘটে যাওয়া নারীনিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত মুক্তি পেয়েছিল। জানি না সে বিয়ে করেছে কি না। জানি না সে যখন জোছনা রাতে স্ত্রীর গায়ে ভালোবাসার হাত রাখে তখন তার স্ত্রী ঘৃণাভরে সে হাত দূরে ঠেলে দেয় কি না। আধো আধো বোলে তার শিশুটি তাকে বলে কি না, "বাবা, তুমি নাকি মেয়েদের গায়ে হাত দাও।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে সু্স্থ মানসিকতার পীঠস্থান, যেখানে মেয়েরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবে– ধুমপানমুক্ত এলকার মতো আমরা বলব, এটি পশুমুক্ত এলাকা। আজ ঢাকা, কাল জাহাঙ্গীরনগর, তারপর চট্টগ্রাম– এভাবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান– তারপর সব অফিস-আদালত, মার্কেট– এভাবে একদিন গোটা দেশটা পশুমুক্ত হবে। তাহলে উপরি পাওনা হিসেবে দেখা যাবে আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোও বদলে গেছে। আদিবাসী নারী নির্ভয়ে জুম চাষ করছে। সংখ্যলঘু তরুণী নিঃশঙ্ক চিত্তে পুজা্য বা ক্রিসমাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের যে সাংবাদিক অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নারীনির্যাতনের মামলায় আটক হয়েছিল সে কি এখনও চাকুরীতে আছে? তার সহকর্মীরা কি এখনও তার সঙ্গে বসে চা খায়? তারা কি বলে না, 'ভাই, আপনি অন্য জায়গায় গিয়ে বসেন, আমাদের সাথে বসবেন না?' আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লজ্জা পাচ্ছেন, কিন্ত যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক শিক্ষক ছাত্রীর সঙ্গে অসদাচরণের জন্য গুরু পাপে লঘু দণ্ড পান তখন নীল-সাদা-হলুদ-কমলারা তাকে বাঁচানোর কী চেষ্টাই না করেছিল!

এমন দেশ চাই যেখানে কোনো নারীর ওপর যৌন-সহিংসতার ঘটনা ঘটতে দেখলে কোনো পুরুষ যদি প্রতিবাদ না করে তার স্ত্রী তাকে বলবে না যে, 'তোমার কী দরকার গোলমালে জড়াবার'– বরং বলবে, 'তুমি গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও কিছু একটা কর।' কোনো এক বৈশাখে বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে দলবদ্ধ নেকড়েরা যদি কোনো মেয়েকে বিরক্ত করে এবং কোনো পুরুষ তখন এগিয়ে না যায়, তবে তাদের স্ত্রী-বান্ধবীরা আকাশের দিকে তাকিয়ে একদলা থুতু ফেলবে।

ডায়রিয়া, পোলিও বা ম্যালেরিয়া নির্মুল করা গেলে এই ব্যাধিও নির্মুল সম্ভব। চাই কঠিন শাস্তি ও সামজিক ঘৃণা। আর সে জন্য প্রয়োজন মানুষের সদিচ্ছা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা।