পরিবর্তন আনা ভালো, তবে পরিকল্পনা থাকা জরুরি

গৌতম রায়
Published : 23 Oct 2016, 08:30 AM
Updated : 23 Oct 2016, 08:30 AM

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসারে ২০১২ সালে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। ওই বছরে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে যেসব পরিবর্তন আনা হয় সেগুলো ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে বাস্তবায়িত হতে শুরু করে।

প্রথম পর্যায়ে ২০১৩ শিক্ষাবর্ষের জানুয়ারিতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রচলন করা হয় এবং পরবর্তীতে ওই বছরেরই জুলাই থেকে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক বাজারে ছাড়া হয়।

পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমে যে কাজটিতে হাত দিতে হয় সেটি হচ্ছে শিক্ষাক্রম (curriculum) পরিমার্জন, সংশোধন বা সংস্করণ। ২০১৩ সালে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনের আগেই শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজটি করা হয় এবং পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুসারে নতুন বইসমূহ লেখা হয়।

অপরদিকে, যখনই নতুন বই তৈরি করা হয়, তখন এর পাশাপাশি শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরির কাজটিও করতে হয়। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তককে শুধু আলাদাভাবে বদলে ফেললেই হয় না; এর সাথে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষক নির্দেশিকাও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ-প্রক্রিয়ার সাথে আরও বেশ কিছু বিষয় জড়িত, তবে আজকের আলোচনায় সেগুলো উহ্য থাকলেও ক্ষতি নেই।

যে বই ও শিক্ষাক্রম মাত্র তিন বছর আগে তৈরি করা হয়েছে এবং তৈরির পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুনরায় সংশোধনও করা হয়েছে, সেগুলো আবার নতুন করে তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত ৯ অক্টোবর শিক্ষাবিদদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ-বিষয়ে একটি সভা করে সিদ্ধান্তটি নেয়।

এটি স্বীকার করে নেয়া প্রয়োজন যে, নির্দিষ্ট সময় পর পর শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকায় পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি। সময়ের সঙ্গে আপডেট থাকার জন্য এটি যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদেরকে অন্যদের সমপর্যায়ে রাখার প্রয়াসেও এ-ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

প্রশ্নটা এখানে— ঠিক কতোদিন পর পর শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য উপকরণে এ পরিবর্তন আনা প্রয়োজন? এর নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই বা সময় ধরেবেধে উত্তর দেয়া সম্ভবও নয়। কারণ সার্বিক চাহিদার ওপর নির্ভর করে পরিবর্তন আনা যেমন জরুরি, তেমনি কোথাও ঘাটতি দেখলে সে অনুযায়ী দ্রুত পরিবর্তন আনাটাও জরুরি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, ধারণা করি, দৃশ্যমান কিছু ঘাটতি বা সমস্যাকে কেন্দ্র করেই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় কেন এ-সময়ে সিদ্ধান্তটি নিলো সে বিষয়ে তথ্য মিডিয়াতে পাইনি, ফলে এ-বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না; কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে খুব দ্রুত এবং পরিকল্পনাহীনভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে।

দ্রুত বলার কারণ হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-কে সামনে রেখে যে পরিমার্জন ও পরিবর্তন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে আনা হয়েছিল ২০১২-১৩ সালে, তা ছিল এক বড় ধরনের পরিবর্তন। সাম্প্রতিককালে এতো বড় পরিবর্তন আর দেখা যায়নি। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি ও বর্ধিত প্রাথমিক শিক্ষার দর্শনকে বিবেচনায় নিয়েও কাজগুলো করা হয়েছে। একই কাজ করা হয়েছে মাধ্যমিকের ক্ষেত্রেও।

বলা হচ্ছে, মাধ্যমিকের বই সংস্কার করা হবে। বইগুলোকে আরও সহজ করা হবে। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হবে। তার মানে, ২০১৩ সাল থেকে যে বইগুলো নতুনভাবে চালু করা হয়েছে, সেগুলোতে নিশ্চয়ই অনেক ও বড় ধরনের সমস্যা ছিল। না হলে তো আজকে এই সিদ্ধান্ত আসতো না! যদি তাই হয়, তাহলে যারা আগের কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদেরও মতামত জানা প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সিদ্ধান্ত তো এই প্রশ্নেরও জন্ম দেয়— যারা তখন ওই বইগুলো লিখেছিলেন, তাঁরা সহজভাবে লিখতে পারেননি বা নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসারে লিখতে পারেননি। তা-ই যদি হয় তাহলে তখনকার ব্যর্থতার দায়ভার কে বহন করবেন?

সুখের কথা এই যে, মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বইগুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব পেয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি সুলেখক, বিজ্ঞান-লেখক ও সহজ ভাষায় লিখতে পারঙ্গম। তাঁর হাতে বিজ্ঞান বইগুলো সুখপাঠ্য হবে— আস্থা রাখা যায়।

কিন্তু অন্য বইগুলো কে দেখবেন? বাংলা? ইংরেজি? বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়? এবং অন্যান্য বিষয়? পূর্বে যারা বইগুলো লিখেছেন, আমার জানামতে, তাঁরা তাঁদের ফিল্ডে সেরা। এই মানুষগুলো তো তাঁদের মেধা ও শ্রম ইতোমধ্যেই বর্তমান বইগুলোতে দিয়েছেন। তাঁদেরকেই যদি আবার এ-কাজে নিয়োজিত করা হয়, নতুন করে কী পরিবর্তন আনবেন তাঁরা? নাকি এক্ষেত্রে শুধু পরিবর্তন আনার জন্যই পরিবর্তন আনা হবে? অবশ্য যদি যোগ্যতর কাউকে দিয়ে পরিবর্তন আনা হয়, সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয় হবে।

শিক্ষাক্রমে কী পরিবর্তন আসবে? মৌলিক ও বড় কোনো পরিবর্তন আসার কথা তো নয়! যদিও ড. ইকবাল বলেছেন, মাধ্যমিক শিক্ষা ও পরীক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন আসবে, কিন্তু কী সেই মৌলিকত্ব? তিনি এ-ও বলেছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাক্রম জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে তৈরি। সেখানে একেবারে বলার মতো মৌলিক পরিবর্তন আসার সুযোগ কম বলে মনে হয়; তবে সেখানে গঠন ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

শিক্ষাক্রম পরিবর্তন তো অনেক খরুচে ব্যাপারও। ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন আনার সময় বিভিন্ন দেশ যেমন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, মালয়শিয়া, যুক্তরাজ্য, শ্রী লংকা, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করা হয়েছিল। প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষও বটে। কিছুদিন আগে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বদলানোর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞে এতো এতো অর্থ খরচ করা হলো, আবারও কি বিপুল খরচের বোঝা বইতে হবে দেশকে?

শুধু এটুকুতেই তো সীমাবদ্ধ নয়! ২০১৩ সালে প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষক নির্দেশিকা বা টিচার্স কারিকুলাম গাইডের সমস্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি। বেশকিছু কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি এবং কিছু কাজ করা হচ্ছে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (SESIP) থেকে। এদের কাজগুলো ফাইন্যাল পর্যায়ে আছে। এখন যদি নতুন বই বের হয়, তাহলে গত দুই বছর ধরে যে কাজগুলো হয়েছে, সেগুলোর সবই বিফলে যাবে। এতো এতো বিশেষজ্ঞ মিলে এতো অর্থ খরচ করে টিচার্স কারিকুলাম গাইড তৈরি করলো, যা বর্তমানে ছাপা হয়ে গেছে বা ছাপার অপেক্ষায় আছে, সেগুলো প্রকৃত অর্থেই অর্থহীন হয়ে যাবে।

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের খবরটি পড়ে খুশি হয়েছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। পরিবর্তন আনা ভালো, তবে গোছানো ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা জরুরি। না হলে যতো দক্ষ মানুষই কাজ করুন না কেন, হিতে বিপরীত হতে পারে।

এই বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশে একটি সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান আছে যাকে আমরা বাংলাদেশ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি বলে থাকি। যদিও প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনসিটিবির নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে কিন্তু এ-ধরনের সিদ্ধান্তগ্রহণের আগে এনসিটিবির সক্রিয় ও গবেষণাভিত্তিক অংশগ্রহণ থাকাটা জরুরি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিকে আরও কার্যকর ও সক্রিয় করা প্রয়োজন। এনসিটিবিরই ঠিক করা উচিত কখন কোন বইতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার, আলাদাভাবে এই কাজটি মন্ত্রণালয়ের করার দরকার আছে কি?

এনসিটিবি প্রতিনিয়তই শিক্ষাবিদদের সাথে কাজ করে। সুতরাং যেকোনো মতামতের জন্য প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছাড়াও নির্দিষ্ট বিষয়ের সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলার যে সুবিধা রয়েছে এনসিটিবির, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, অনেক বিশেষজ্ঞই আছেন যাঁরা জেনারেল পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু সেগুলো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম বা পাঠ্যপুস্তকের জন্য কার্যকর না-ও হতে পারে। একজন সুসাহিত্যিক যে ভালো বাংলা পাঠ্যপুস্তক লিখতে পারবেন— তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই। পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের কে কোন পর্যায়ে কতোটুকু কাজ করতে পারবেন— এ ব্যাপারে এনসিটিবি সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল।

একটি পাঠ্যপুস্তকে কী থাকা প্রয়োজন বা না প্রয়োজন সে সম্পর্কে অনেকে মতামত দিতে পারেন। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেকে নানা কিছু মনে করতে পারি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে সার্বিকভাবে কোন কোন বিষয় যাওয়া উচিত, কতোটুকু যাওয়া উচিত, সেগুলো শিশুর বয়স ও মানসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, বিষয়বস্তু শিক্ষাক্রম ও জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে কতোটুকু মানানসই ইত্যাদি নানা বিষয় দেখতে হয়। সবার সব বিষয়ে সমান দক্ষতা নাও থাকতে পারে। সেজন্যই একই পাঠ্যপুস্তক লেখার সাথে বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞের যুক্ত হতে হয়। পাশাপাশি সম্পাদক ও কনটেন্ট অ্যানালাইসিস করার জন্য দক্ষ গবেষকেরও প্রয়োজন। যদিও এনসিটিবির তৈরিকৃত পাঠ্যপুস্তকে সম্পাদক থাকেন এক বা একাধিক, কিন্তু সেসব সম্পাদনা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

পাঠ্যপুস্তক তৈরি হওয়া উচিত পরিকল্পনা অনুসারে। একবার পাঠ্যপুস্তক তৈরির পর কত বছর বিরতিতে নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই মাঝের বিরতিতে প্রকাশিত প্রতিটি পাঠ্যপুস্তকের ওপর নানাভাবে গবেষণা করা উচিত। বিশেষত বই চালু করার আগে বিস্তৃত পরিসরে পাইলটিং করা প্রয়োজন। আর এই পাইলটিং ও গবেষণার ভিত্তিতে বদলানো প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকের যেকোনো উপাদান। না হলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পাঠ্যপুস্তকে অদল-বদল করা হলে এর প্রভাব খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।