কোনো চমক থাকবে কি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে?

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 20 Oct 2016, 04:33 AM
Updated : 20 Oct 2016, 04:33 AM

বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের সম্মেলন নিয়ে তোড়জোড় চলছে ব্যাপক। অতীতের যে কোনো সম্মেলনের তুলনায় এবারের চাকচিক্য, বিলাসিতা কিংবা ঢাকঢোল বেশি। অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত কিছুদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই সম্মেলনের নানা দিক নিয়ে গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের সম্মেলন এমনিতেই জাঁকজমকপূর্ণ হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে; রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে জাতির কী যায় আসে? জাতীয় রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে কি?

ছয় মাস আগে আরেক বৃহৎ দল বিএনপিরও জাতীয় সম্মেলন হয়েছে; তাতে রাষ্ট্রের বা জনগণের কী এমন এসেছে বা গেছে? বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বাস করছি তাতে এসব প্রশ্ন উঠতেই পারে। যে কেউই প্রশ্ন তুলতে পারেন, রাজনৈতিক দলের সম্মেলন কি দিনকেদিন গুরুত্ব হারাচ্ছে?

আপাতদৃষ্টিতে দেখলে তা-ই মনে হবে। যে দেশে প্রধান দুটি দলের শীর্ষ নেতা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন এবং দলের অন্যান্য নীতি নির্ধারক কারা হবেন সেটিও যেখানে এক ব্যক্তিই ঠিক করে দেন, সেখানে নেতৃত্বের বিকাশ নিয়ে কথা ওঠা খুবই স্বাভাবিক। দলের ঘোষণাপত্রে যা উল্লেখ করা হয় তা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারও করা হয়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয় না। আবার যে নীতি-আদর্শ দলের কাউন্সিলররা ঠিক করে দেন সেই পথে দলগুলো সবসময় চলে না। এসব কারণে দলের জাতীয় সম্মেলন অনেকটা অলঙ্কারিক হয়ে উঠেছে।

এত প্রশ্ন ওঠার মধ্য দিয়েও আমরা যদি স্বাধীনতা-পূর্ব আওয়ামী লীগের আটটি সম্মেলনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই– রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন কিংবা জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে দলটির কাউন্সিল বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসেরই কথা বলে।

আবার স্বাধীনতা-পরবর্তী দলটির ১১টি সম্মেলন কখনও ক্ষমতায় থেকে, কখনও সামরিক শাসনামলে আবার কখনও সরকারি দলের নির্যাতনের মুখে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সম্মেলন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারই কথা বলেছে। যদিও দলটি নানা সময়ে বিচ্যুত হয়েছে, পথ হারিয়েছে, আদর্শিক দ্বন্দ্বে পড়েছে এবং কখনও কখনও তাদের মূল চরিত্রের বিরুদ্ধেও গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটিকে কর্মীরাই সঠিক পথে চালিত করেছে।

সাধারণত যে কোনো দলের সম্মেলনে দুটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়–

১. সাংগঠনিক অর্থাৎ, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব বিকশিত করার প্রক্রিয়া শুরু করা এবং
২. দলের নীতি-আদর্শ ঠিক করা।

আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এ কাজটি কতটা করতে পেরেছে, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে দলটির অতীতের সম্মেলনগুলো সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা দরকার।

১৯৪৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে ১৯টি সম্মেলন হয়েছে এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দল এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের নীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার এই ৬৭ বছরে প্রায় ৩০ বছর সামরিক বা অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ের মধ্যে ক্ষমতাসীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ সম্মেলন করেছে ছয়বার আর ১৩টি সম্মেলন হয়েছে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়।

প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশে ১৯৪৯ সালে কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি আত্মপ্রকাশ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগেরই একটি প্রগতিশীল অংশ এ সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সম্মেলন ছিল নির্বাচন সামনে রেখে। ওই সম্মেলনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে 'যুক্তফ্রন্ট' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ২১ দফা কর্মসূচির খসড়া চূড়ান্ত হয়। ১৯৫৫ সালে তৃতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা ঠিক করেন, রাজনৈতিক দল হবে সব ধর্মের মানুষের জন্য। তাই 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' হয়ে ওঠে 'আওয়ামী লীগ'।

চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে, টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনেই কাউন্সিলররা সিদ্ধান্ত নেন– দলের কোনো নেতা একই সঙ্গে দলের কর্মকর্তা ও মন্ত্রিত্বে থাকতে পারবেন না। দল চালাবে এক গ্রুপ, আরেক গ্রুপ চালাবে সরকার।

'৬৪ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ষষ্ঠ সম্মেলনে বাঙালির স্বাধীনতার সনদ ৬ দফার পক্ষে রায় দেন কাউন্সিলররা। এই সম্মেলনেই শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন। '৭০ সালে অষ্টম সম্মেলনে ৬ দফা ও ১১ দফা গ্রহণ করে আওযামী লীগের কাউন্সিলরা দলকে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন এবং বিজয়ী হয়ে স্বাধীনতার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যান।

নবম সম্মেলনটি হয় স্বাধীন বাংলদেশে, ১৯৭২ সালে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ সম্মেলনটি হয় ১৯৭৪ সালে। দশম এ সম্মেলনে সভাপতি পদ ছেড়ে দেন 'বঙ্গবন্ধু' থেকে 'জাতীর জনক' হয়ে ওঠা শেখ মুজিব।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে দুই বার সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগে শুরু হয় শেখ হাসিনার আমল। '৮১ সালে ১৩তম সম্মেলনে দলের অনেকেরই ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। সম্মেলনের শেষ দিনে দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করা হলে কাউন্সিলররা সর্বসম্মতভাবে তা গ্রহণ করেন।

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামালে একবারই আওয়ামী লীগ সম্মেলন করেছে, ১৯৮৭ সালে। সেটা ছিল ১৪তম সম্মেলন।

দ্বিতীয় দফায় গণতন্ত্রে উত্তরণের পর অর্থাৎ, সামরিক একনায়ক জেনারেল এরশাদের পতনের পর বিএনপির আমলে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ১৫তম সম্মেলন। এ সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পটভূমিতে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র থেকে সরে এসে 'মুক্তবাজার অর্থনীতি' গ্রহণ করে এবং ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনে।

আওয়ামী লীগের জন্মের পর তৃতীয় দফা এবং স্বাধীন দেশে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে ১৬তম সম্মেলন করে ১৯৯৭ সালে। এরপর বিএনপির আমলে ২০০২ সালে হয় ১৭তম সম্মেলন। আবারও ক্ষমতাসীন হয়ে সাত মাসের মাথায় আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ১৮তম এবং ২০১২ সালে ১৯তম সম্মেলনের আয়োজন করে।

এই ১৯টি সম্মেলনের কার্যক্রম সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দিয়ে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে দলটি। তখন দলটির প্রধান দাবি ছিল, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দুই পাকিস্তানের বৈষম্য দূরীকরণ।

আওয়ামী লীগের জন্ম হয় দেশে একটি বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থেকে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের একদল নেতাকর্মীই উপলব্ধি করেন, দেশে একটি বিরোধী দল প্রয়োজন। একটি কার্যকর বিরোধী দল যে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, সেটি '৪৯ সালে কারাগারে বসেই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন।

তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে লিখেছেন–

"আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য, আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলিম লীগ করে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও উচিত হবে না। কারণ, এরা কোটারি করে ফেলেছে, একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোন কর্মপন্থা নাই। আমাকে আরো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব নাকি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ, বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।"

৬৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, বিশেষ করে দল ক্ষমতাসীন হলে যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এর পরিনতি কী হতে পারে। একই সঙ্গে বিরোধী দল গঠন না হলে যে একনায়কত্ব চালু হয়ে যেতে পারে, সেটাও তিনি পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন। আজকের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এ দুটি বিষয় অনুভব করেন কি না, সে প্রশ্ন যে কেউ তুলতেই পারেন।

দ্বিতীয় সম্মেলনে (১৯৫৩ সালে) যে ২১ দফার অনুমোদন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে করা হয়েছিল, তা না হলে মুসলিম লীগকে তাড়ানোই সম্ভব হত না। ওই ২১ দফা যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সেটা পরবর্তী ইতিহাসই বলে দেয়। তৃতীয় সম্মেলনে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিদায় দেয়। কিন্তু আজ এত বছর পর ধর্মের মঞ্চে যেমন রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে তেমনি রাজনৈতিক মঞ্চে ধর্মের বয়ান দেওয়া হচ্ছে।

এখনকার আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক সমাজ গঠনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখে চলেছে। দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে নীতি নির্ধারক বেড়েছে, নয়তো ১০ বছর আগে তারা খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করতে পারতেন না, যা কর্মীদের চাপের মুখে বাতিল করতে হয়েছে। এই আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কখনও কখনও আপস করে যে কৌশল নিয়েছে সেটাও হিতে বিপরীত হবে।

যে আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে ধর্মকে বিদায় করে দিয়েছিল রাজনীতি থেকে, সেই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে ধর্মকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা শুরু করে। এবং সেটির ইতিবাচক ফল পাওয়ায় সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই চলেছে। সে কারণেই আওয়ামী লীগ বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করছে না। রাষ্ট্রকেও ধর্ম থেকে বিযুক্ত করছে না, যা সামরিক একনায়ক এরশাদ ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে সংবিধানে যুক্ত করে দিয়ে গেছেন।

৬০ বছর আগে আওয়ামী লীগ দলের নামই সংশোধন করে 'মুসলিম' শব্দটি কেটে ফেলতে পেরেছিল সেই আওয়ামী লীগের এখন নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিতে হয়– কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।

যারা দলের কর্মকর্তা হবেন তারা সরকারে থাকতে পারবেন না– এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা ১৯৫৭ সালের চতুর্থ সম্মেলনে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩৭ বছর বয়সী শেখ মুজিব স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

৬০ বছর আগে আওয়ামী লীগ যে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল আজকের বাস্তবতায় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন সম্ভব না, তার নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। যদিও দলের প্রধান বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করলে তিনি খুশিই হবেন।

১০ বছর আগে শেখ হাসিনার একটি একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় প্রশ্ন করেছিলাম, দলের সভানেত্রী আর প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হলে দল চালাতে সমস্যা হয় কি না? জবাবে তিনি বলেছিলেন–

"আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও ওই রকম বিধান ছিল। কিন্তু অন্য কোনো দল এটি অনুসরণ করছে না, এবং বিএনপির মতো বড় দলের প্রধানও সরকার প্রধান হন বলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা দলের গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনেন।" (সূত্র: ডেইলি স্টার, ১৭ জুন ২০০৭)

'৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু যেমন মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে দল গঠনে ব্যস্ত হন, তেমনি '৭৪ সালে দশম সম্মেলনে দলের পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশ গঠনেও ব্যস্ত হন। বর্তমানে সেই রকম চিন্তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করতে চাইলেও দলের নেতাকর্মীরা তা মানবেন কি না, সেটাও দেখার বিষয়। দলের ২০তম সম্মেলনে গঠনতন্ত্রে ওই ধারা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করার দুঃসাহস হয়তো কোনো কাউন্সিলর দেখাবেন না। আর এমন ধারা যুক্ত করতে হলে শেখ হাসিনার ইঙ্গিতেই করতে হবে, এটাই এখন বাস্তবতা।

আবার '৬৬ সালের ষষ্ঠ সম্মেলনে ব্যপক প্রচার ছিল ৬ দফার বিপক্ষে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলররা শেখ মুজিবের ৬ দফার পক্ষেই সায় দেন। দলের অনেক বড় বড় নেতা প্রচার চালিয়েছিলেন ৬ দফার বিপক্ষে, কিন্তু সঠিক পদক্ষেপই নেন কাউন্সিলররা। সেই সম্মেলনে যদি দলের সিনিয়র অনেক নেতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে কাউন্সিল ৬ দফার অনুমোদন না দিতেন তাহলে স্বাধীনতার আন্দোলনও যে পিছিয়ে যেত। ওই সম্মেলনই শেখ মুজিবকে সভাপতি নির্বাচিত করে। এবং তিনি সারা দেশে ৬ দফার পক্ষে প্রচার শুরু করেন, যা হয়ে ওঠে বাঙালির স্বাধীনতার সনদ।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। আবার সামরিক শাসনের জাঁতাকলে যখন দল ভেঙে যায় যায় তখনও আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা নেতৃত্ব নির্বাচনে ভুল করেননি। বঙ্গবন্ধু '৫৩ সাল থেকে '৬৬ সাল এই ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদক এবং '৬৬ থেকে '৭৪ সাল এই আট বছর দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা '৮১ সালে দলের হাল ধরার পর ১৯৮৭, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০২, ২০০৯ এবং ২০১২ সালের সম্মেলনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। কাউন্সিলরা সবাই তাঁর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেন। এই ৩৫ বছর একই পদে থেকে তিনি এখন বলতে শুরু করেছেন, "আর কত? এবার নতুন নেতা নির্বাচিত করুন।"

দলের ২০তম সম্মেলনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বের প্রশ্নে কোনো চমক দেবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

২০০৯ সালে সম্মেলনে বেশ কিছু নতুন মুখ দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরপরের কমিটি ঘুরেফিরে একই রয়ে গেছে। দলের শুধু শীর্ষপদই নয়, কেন্দ্রের অনেক পদেই খুব একটা নড়চড় হচ্ছে না। এবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম থেকে অনেকে দলের কাউন্সিলর হয়েছেন। তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসারও এটা একটা ইঙ্গিত।

দলটি যে নীতি আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল সেখান থেকে কিছুটি দূরে সরে গেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বর্তমানে খুব শক্তিশালী অবস্থান থাকা দেশের প্রাচীন এই দলের ২০তম সম্মেলনে প্রত্যাশা থাকবে– মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, সব ধর্ম, বর্ণ ও নৃ-গোষ্ঠীর সমান অধিকার নিশ্চিত করে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গৃহীত হবে। আরও প্রত্যাশা থাকবে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করে নাগরিকদের মানবিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর পাশাপাশি উদার গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখবে আওয়ামী লীগ।