মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘রাশিয়া ফ্যাক্টর’

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 21 Oct 2016, 11:21 AM
Updated : 21 Oct 2016, 11:21 AM

শীতল যুদ্ধোত্তর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবারই প্রথম রাশিয়া ইস্যুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশিয়া ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্পর্কে সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে আমেরিকান নীতিনির্ধারক এবং সিভিল সমাজের মধ্যে এ ধারণা জন্মেছে যে, ট্রাম্প রাশিয়ার এজেন্ট এবং তিনি নির্বাচিত হলে মূলত রাশিয়ার এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করবেন।

বিশেষত সিরিয়া নিয়ে ট্রাম্পের যে বক্তব্য, যেখানে তিনি মার্কিন সরকারি অবস্থানের বিপরীতে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাশিয়া সিরিয়ায় যে নীতি গ্রহণ করেছে তার প্রতি ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, যা অনেক আমেরিকানকেই ট্রাম্প নির্বাচিত হলে দেশটির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

সাম্প্রতিকালের ইতিহাসে এবারের নির্বাচনটি নানা কারণে নজিরবিহীন। বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন রাজনীতির মূল পার্থক্য এত দিন পর্যন্ত যেটি মনে করা হত সেটি হল, বাংলাদেশে যেমন জাতীয়, আন্তর্জাতিক সব বিষয়েই প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ভিন্নমুখী অবস্থান নেয় তাদের মৌলিক রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিমালার ক্ষেত্রে ঐক্যমত্য থাকার ফলে ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিকান দলের মধ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে তেমন কোনো মতবিরোধ দেখা যায় না। ভিন্নতা দেখা যায় শুধু নীতিমালা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে প্রশ্নে। সাধারণত নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের রক্ষণশীল আর ডেমোক্র্যাটদের তুলনামূলকভাবে উদার মনে করা হয়।

ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে এই ঐক্যমত্যের নীতিমালা যেমন দেখা যায় সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে (War on Terror), তেমনি ঐক্যমত্য দেখা যায় রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা চীনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক নীতি কী হবে, সে প্রশ্নেও। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং রাশিয়া সম্পর্কে প্রচলিত নীতি থেকে বেরিয়ে এসে এমন একটা অবস্থান নিতে চাইছেন, যা কিনা মার্কিন নীতিনির্ধারকরা রাশিয়ার স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করেন। রিপাবলিকান দলের প্লাটফরম থেকে একজন প্রেসিডেন্ট পদপার্থীর এ ধরনের অবস্থান অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষককে অবাক করেছে।

প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন, নাকি দলের নাম ব্যবহার করে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অভিলাষ বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। আর এ অভিলাষ যখন আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে তখন সেটি কি শুধুই ব্যক্তিগত অর্বাচীন চিন্তাচেতনার ফল, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমানে নতুন রূপে বিশ্বমঞ্চে ফিরে আসা রাশিয়ার এজেন্ডাই ট্রাম্পের এজেন্ডা– এ প্রশ্নগুলো অনেক মার্কিন ভোটারের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি কিভাবে রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচনের টিকেট পেলেন?

বস্তুত যেসব বক্তব্য ট্রাম্পকে বিতর্কিত করেছে, সেসব বক্তব্য দিয়েই তিনি রিপাবলিকান দলের সমর্থকদের একটি বড় অংশের মন জয় করেছেন, যা তাঁকে দলের মনোয়নয়ন পেতে সাহায্য করেছে। দীর্ঘদিনের 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে' মার্কিন জনগণ ক্লান্ত, অর্থনীতি অনেকটা বিপর্যস্ত। ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি জাতীয় ঋণ যা কিনা সমগ্র মার্কিন জিডিপির চেয়েও বেশি। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৬০,৩৪০ ডলার, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটু পুরনো হিসাব অনুযায়ী সেটি ১৫০ ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের একটি বড় অংশ এসেছে গণচীন থেকে। পাশাপাশি রয়েছে গত বছরের হিসাব অনুযায়ী ৭০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে বাণিজ্য ঘাটতি।

অর্থনীতির এই যে সংকট যুক্তরাষ্ট্র মোকাবেলা করছে তার জন্য বিপুলসংখ্যক মার্কিন নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে চলা 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ'কেই কারণ বলে মনে করেন। শুধুমাত্র ইরাকেই যুদ্ধে মার্কিন ব্যয় ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে আফগানিস্তান যুক্ত করলে সার্বিক খরচ প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন (২.৫) ডলারের উপরে চলে আসে।

এ বিপুল পরিমাণ অর্থ যুদ্ধ খাতে ব্যয় করার খেসারত দিতে হচ্ছে মার্কিন জনগণকে। পাশাপাশি ৭০টির বেশি দেশ এবং ভূখণ্ডে আট শতাধিক সামরিক ঘাঁটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে, যা মার্কিন নীতিনির্ধারকরা তাঁদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য জরুরি বলে মনে করেন।

ক্রমাগত অর্থনৈতিক চাপের ফলে আগের ৭৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে মার্কিন সামরিক বাজেট গত বছর ৫৯৭ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ অর্থ সমগ্র বাজেটের শতকরা ১৬ ভাগ। এখানে উল্লেখ্য, সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে রাশিয়া এবং গণচীনের সামরিক বাজেট ছিল যথাক্রমে ৫২ এবং ১৪৬ বিলিয়ন ডলার।

মার্কিন জনগণ আজকে ইরাক অভিযানের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। এত অর্থ ব্যয় এবং সাড়ে চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনার জীবন দেওয়ার বিনিময়ে 'ইরানপন্থী' সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কী লাভ হল? এ ছাড়া রয়েছে অবৈধ অভিবাসী ইস্যু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত অধিবাসী অবৈধভাবে বসবাস করে পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রে এত অধিবাসী অবৈধভাবে বাস করে না। অবৈধ অভিবাসী সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও অনুমান করা হয়, সংখ্যাটা এক কোটি ২০ লাখের মতো। অর্থাৎ, মার্কিন জনসংখ্যার প্রতি ৩০ জনে একজন অবৈধ। এ অভিবাসীদের অধিকাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ঘণ্টায় কাজের ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কমে কাজ করেন।

মার্কিন জনগণের একটা বড় অংশেরই অবৈধ জনগোষ্ঠীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। এ ছাড়া গত ১৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার ফলে জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে। এর পরিণতিতে 'ইসলাম ভীতি' বা 'ইসলামোফোবিয়া' তৈরি হয়েছে। ইসলামোফোবিয়া জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মার্কিন জনগণের এসব 'সেন্টিমেন্ট' পুঁজি করেই মূলত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ট্রাম্প নির্বাচনে নেমেছেন। পূর্বে রাজনীতি করার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশের 'পালস' (Pulse) তিনি ধরতে পেরেছেন। যেহেতু মার্কিন সমাজের একটা বড় অংশ অভিবাসনবিরোধী; তাই তিনি অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য বা অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার করার কথা বলে খুব সহজেই জনপ্রিয় হতে পেরেছেন। একইভাবে তিনি দৃষ্টি কেড়েছেন মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ বা নাফটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলে। তবে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলে, যেখানে তিনি প্রকারান্তরে সব মুসলিমকেই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছেন।

বর্তমান মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তবতাবর্জিত, আবেগঘন বক্তব্য যে কোনো রাজনীতিককে দ্রুত জনপ্রিয় করার জন্য সহায়ক। ট্রাম্প কোনো নতুন কথা বলেননি, বরং মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশের কিছু বাস্তববর্জিত চিন্তাধারা সামনে নিয়ে এসেছেন।

মার্কিন রক্ষণশীল দার্শনিক মাইকেল নোভাক যেমন বলেছেন, কোনো দেশের নেতা সে দেশের জনগণকেই প্রতিফলিত করেন, তেমনি ট্রাম্প সে দেশের জনগণের একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক নানা বক্তব্যের মধ্যে।

কোনো সময় রাজনীতি না করা ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ধনী ব্যবসায়ী, যিনি সরকারকে কর দেন না। তিনি যে কর দেন না– এটা নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই, বরং তিনি মনে করেন, কর-ফাঁকি দেওয়াটা তাঁর কৃতিত্ব। এ জন্য তিনি নিজেকে নয়, মার্কিন রাজস্ব নীতিকে দায়ী করেন। কারণ, এ নীতির ফলেই তাঁর মতো ধনী ব্যক্তিদের কর না দিলেও কোনো সমস্যা হয় না।

দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি কর দেন না। হিলারি ক্লিন্টনের নির্বাচনী প্রচারে যাঁরা ফাইনান্স করছেন অর্থাৎ, জর্জ সরোসসহ তাঁরাও কর দেন না।

অভিযোগ শুধু ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নয়, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে হিলারি বিরুদ্ধেও। বৈদেশিক সচিবের (বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমপর্যায়) পদ ব্যবহার করে 'ক্লিনটন ফাউন্ডেশন'-এর নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করা, যেখানে বাংলাদেশের অধ্যাপক ইউনূসও অর্থ প্রদান করেছেন– এমন খবরও এসেছে। বাংলাদেশ সরকারের গ্রামীণ ব্যাংক-সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন আনার জন্য মার্কিন সরকার যাতে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ দেয়, এ জন্য ড. ইউনূস ওই অর্থ দেন বলে অনেক সমালোচক মনে করেন।

টাকা লেনদেন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে হিলারি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান কোনো স্বচ্ছতা বজায় রাখেনি বলে রিপাবলিকানসহ বিভিন্ন মহল থেকে যে অভিযোগ উঠেছে তার কোনো সদুত্তর এখনও তিনি দিতে পারেননি। ফলে বিরোধীরা তাঁর এ ধরনের লেনদেনকে দুর্নীতি হিসেবে অভিহিত করছেন।

ধনিক শ্রেণির কর-ফাঁকির বিষয়টা যে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেই ঘটছে তা নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত প্রভাবশালী রাষ্ট্রেও ঘটছে অনেকটা রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ের কারণে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দুই দেশই তাদের ধনিক শ্রেণিকে নানাভাবে সুরক্ষা দিচ্ছে।

ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের নামে এ দুর্নীতির অভিযোগ বাংলাদেশে 'হাওয়া ভবন'-এর নামে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল অনেকটা তার সঙ্গে তুলনীয়। দুই ক্ষেত্রেই ব্যক্তির প্রভাব খাটিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং জনগণের সামনে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ হিসাব তুলে ধরা হয়নি। যেসব কারণে সে সময় 'ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল' বাংলাদেশকে কয়েকবার দুর্নীতিতে বিশ্বে এক নম্বর ঘোষণা করেছিল তার মধ্যে প্রতিপত্তি খাটিয়ে হাওয়া ভবনের নাম করে অর্থ সংগ্রহ একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে ২০১৫ সালে দুর্নীতি সূচকে (কম থেকে বেশি, সবচেয়ে কম ১ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ১৬৭) যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৬ আর বাংলাদেশের ১৩৯।

হিলারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বা ট্রাম্পের মুসলিম এবং অভিবাসীবিরোধী বক্তব্যে আমেরিকার নীতিনির্ধারক বা সিভিল সমাজকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি। তাঁদের মধ্যে প্রথম বিচলিত ভাব পরিলক্ষিত হয় যখন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ট্রাম্প কথা বলতে শুরু করেন, বিশেষত তিনি নির্বাচিত হলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেবেন, সেসব বক্তব্য দেওয়ার সময় থেকে।

প্রাথমিকভাবে মনে এটা করা হতে থাকে ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে অনভিজ্ঞ বা বিদেশনীতি বোঝেন না, এসব কারণেই তিনি এমন বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধতে শুরু করে তখন, যখন তিনি পুতিনকে প্রশংসা বা 'পুতিন ওবামার চেয়ে যোগ্য নেতা' বলতে থাকেন। পাশাপাশি রাশিয়ার সিরিয়া অভিযান এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকেও সমর্থন করতে থাকেন তিনি। এমনকি এ-ও বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ভুল এবং এর ফলেই মধ্যপ্রাচ্যে আইএসসহ ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটেছে।

তিনি আরও বলেন, রাশিয়া যদি আইএসসহ ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে পারে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়া। এবং দরকার হলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত সিরিয়া সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।

ট্রাম্প সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসন ও নীতনির্ধারক মহলের সন্দেহ আরও প্রবল হয়ে ওঠে যখন রাশিয়ার বিভিন্ন নীতিনির্ধারক ও মিডিয়া প্রকাশ্যেই ট্রাম্পকে যোগ্য প্রার্থী বলা শুরু করে। তাদের ভাষ্য, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উন্নতি হবে। বস্তুত এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকের মধ্যে এ ধারণা জন্মে যে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে শুধু যে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবেন তা-ই নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চরম বেকায়দায় পড়তে হবে রাশিয়ার কাছে।

কমিউনিজমের পতনের পর থেকে রাশিয়া সম্পর্কে এত দিন পর্যন্ত মার্কিন নীতি ছিল শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার রাশিয়ার পক্ষে আর কোনোদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের ভাবনা মূলত রাশিয়া সংক্রান্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি ছিল। যেমন: কমিউনিজমের পতনের পর ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা লেখেন, 'ইতিহাসের পরিসমাপ্তি'। অর্থাৎ, কমিউনিজমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের স্থায়ী বিজয় হয়েছে, যেটি প্রকারান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বিজয় ইঙ্গিত করেছে। ফলে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাঁর চিন্তার আলোকে তাঁদের বিদেশনীতি নির্ধারন করলেন তিনি হলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটন।

কমিউনিজম উত্তরকালে হান্টিংটন বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব খুঁজে পান এবং এর মধ্য দুটো সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে মনে করেন। এ তত্ত্ব দিয়ে হান্টিংটন একই সঙ্গে প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে 'ইসলামি মৌলবাদ',– এ ধারার রাজনীতি যারা করেন তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে যান। দুপক্ষই মনে করতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেহেতু শেষ হয়ে গেছে, তাই এখন ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা গণতন্ত্রের লড়াই হবে পরিবর্তিত বিশ্বের মূল দ্বন্দ্ব, যার ফল হল মার্কিন নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সূচনা।

কিন্তু ২০০০ সালে পুতিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা শুরু হয়। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মধ্যে রাশিয়া সম্পর্কে অবজ্ঞা ভাব, নিজেদের বিশ্বের একমাত্র 'সুপার পাওয়ার' ভাবা এবং রাশিয়াকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতার ফলে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে রাশিয়ার পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। হান্টিংটনের চিন্তাধারার প্রভাবে তাঁরা ভাবছিলেন একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসেবে তাদের এখন ইসলামভিত্তিক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। তবে ভবিষ্যতে চীন তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে এবং এ ভাবনার পেছনেও ছিল হান্টিংটনের চিন্তার প্রভাব।

তবে পুনরুত্থিত রাশিয়া সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের প্রথম টনক নড়ে যখন হান্টিংটনের চিন্তা ভুল প্রমাণিত করে রাশিয়া সিরিয়াতে হস্তক্ষেপ করে, যা একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসলামভিত্তিক রাজনীতি যারা করেন, এ দুই পক্ষকেই অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ অস্বস্তি চরম রূপ ধারণ করে যখন প্রচলিত সব হিসাব-নিকাশ বাইরে ফেলে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপার্থী রাশিয়াকে সমর্থন করে বক্তব্য দিতে থাকেন। পাশাপাশি ডেমোক্রেটিক দলের ওয়েবসাইট হ্যাক, উইকিলিকসের মাধ্যমে হিলারি ইমেইল প্রকাশ– এসবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একাংশের মধ্যে এ ধারণা জন্মে যে রাশিয়া নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনতে চাইছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ইতিহাসে যা ঘটেনি তাই ঘটছে এবার। অর্থাৎ, প্রায় সবগুলো সংবাদমাধ্যম (ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট) হিলারিকে সমর্থন করছে। এমনকি যে অ্যারিজোনা রিপাবলিক গত ১২৬ বছর ধরে রিপাবলিকান দলকে সমর্থন করে আসছিল তারাও প্রথা ভেঙে হিলারিকে সমর্থন জানাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার মিডিয়া জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সাধারণত সরকারি অবস্থানের বাইরে ভিন্ন অবস্থান নেয় না।

শুধু তাই নয়, এবার মার্কিন মিডিয়াতে ট্রাম্পকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে লিবারেটেরিয়ান দলের প্রেসিডেন্ট পদপার্থী নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর গ্যারি জনসনকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যিনি গত নির্বাচনে ১২ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলেন। মনে করা হচ্ছে, তিনি হয়তো ট্রাম্পের ভোট কাটবেন। অপরদিকে গত নির্বাচনে চতুর্থ স্থান লাভকারী, প্রখ্যাত নারী ইহুদি চিকিৎসক ও গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইনকে কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না এই ভেবে যে তিনি হয়তো হিলারির ভোট কাটবেন।

উল্লেখ্য, অন্যান্য দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ জন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সব নির্বাচনেই অনেক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মার্কিন মিডিয়াতে দুই প্রধান দলের বাইরের কাউকে সাধারণত সমর্থন দেওয়া হয় না, এমনকি মোট কতজন নির্বাচনে প্রার্থী হলেন– এ সংবাদও পরিবেশন করা হয় না।

গ্যারি জনসনকে এবার মিডিয়া সুযোগ করে দিলেও বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে তিনি যে কিছুই জানেন না তা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন। আলেপ্পো কী, উত্তর কোরিয়া বা মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের নাম, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কোনো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের নামও বলতে পারেননি তিনি। অবশ্য তিনি মনে করেন, প্রেসিডেন্ট হতে হলে এসব না জানলেও চলে। ফলে এখন ট্রাম্পকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে মিডিয়া ফোকাস করছে অতীতে কোন কোন নারীকে ট্রাম্প যৌন হেনস্থা বা নিপীড়ন করেছেন– এ বিষয়গুলোর ওপর।

অন্যদিকে ট্রাম্প পক্ষ নতুন করে আবার সামনে নিয়ে আসছেন বিল ক্লিন্টন কোন কোন নারীকে যৌন হেনস্থা করেছিলেন এবং এতে হিলারির কী ভূমিকা ছিল– এ বিষয়গুলো। ট্রাম্প আরেক ধাপ এগিয়ে হিলারি অবৈধ ড্রাগ ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ এনেছেন। অর্থাৎ, দুই পক্ষই রাজনৈতিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং এক অন্যকে হেনস্তা করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছেন। তবে ট্রাম্প অনুসারীরা ভয় পাচ্ছে যে ভোট কারচুপি করে তাদের বিজয় ঠেকিয়ে দেওয়া হবে।

যিনিই নির্বাচিত হন না কেন, তাঁর সামনে নির্বাচিত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় যে ইস্যু প্রথমেই আসবে, সেটি হল বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার প্রশ্নটি। এটি অনুমান করা যায় যে হিলারি জয়লাভ করলে তিনি হয়তো এ ইস্যুতে ওবামার পথেই হাঁটবেন। তবে ট্রাম্প জয়লাভ করলে তিনি কী করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।