বাফুফের নেতৃত্বে পরিবর্তন চাই

মারুফ মল্লিক
Published : 7 Oct 2011, 11:38 AM
Updated : 13 Oct 2016, 03:23 AM

গত বছরের শেষ দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে এক লেখায় বলেছিলাম, বাফুফের সভাপতি সালাউদ্দিন যেন পদত্যাগ করে চলে যান। কারণ, বাংলাদেশের ফুটবলে এই ভদ্রলোকের আর দেওয়ার কিছু নেই। তিনি অনেক দিয়েছেন খেলোয়াড় হিসেবে। সংগঠক হিসেবে তিনি কতটা কী করতে পারবেন তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। বর্তমান সভাপতির সাংগঠনিক অদক্ষতা এতটাই প্রকট যে তাঁর আমলেই ভুটানের কাছে হার মানল বাংলাদেশ। ভুটানের কাছে আমাদের হারার কথা নয়। দেশের ফুটবল সংগঠনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণেই এটা হয়েছে।

বাফুফের সভাপতি আমাদের অনেক আকাশকুসুম স্বপ্নের কথা বলেছেন। এবং উনি সভাপতি পদে থাকলেই এসব উদ্ভট স্বপ্ন দেখা সম্ভব মাঠে খেলা না রেখেই! যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুসরণ করেও ফুটবলে থই পাচ্ছে না সেখানে সালাউদ্দিন নানা ধরনের উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে বেড়ান। ভুটানের দুটি ফুটবল একাডেমি আছে। সেখানে একটা ফুটবল একাডেমি পরিচালনা করার ক্ষমতা নেই আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের। আর আমাদের সভাপতি একবার ঘোষণা দেন ২০১৮ বিশ্বকাপ তাঁর টার্গেট, আবার বলেন ২০২২। 'উন্মাদের' পক্ষেই এসব বলা সম্ভব! একটা মানুষ এতটা বাস্তবতাবিবর্জিত হয় কী করে?

আগের লেখার গল্পটা আবার বলি। ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে নেপালের কাছে বাংলাদেশের পরাজয়ের পরের ঘটনা। তখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় ফুটবলের তথাকথিত বড় শক্তি। নেপালের সঙ্গে খেলা মানে নিদেনপক্ষে এক গোলের জয় অথবা ড্র। কিন্তু নেপালের সঙ্গে হেরে যাওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। অপ্রত্যাশিত সেই হারের পর আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিএনডি বাঁধের দেয়ালে কেউ একজন লিখে রেখেছিলেন, "এই হার শেষ নয় আরও হার আছে, সেই হার নিয়ে যাবে ভুটানেরও কাছে।"

ওই সময় টেলিভিশনে প্রচারিত আবদুল কুদ্দুস বয়াতির একটি শিক্ষামূলক বিজ্ঞাপনের অনুকরণে এই দেয়াললিখন। সেটা ছিল হয়তো কোনো সমর্থকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ওই সময় দেয়াললিখনটি নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, তখন আমরা মনে করতাম, বাংলাদেশ কোনো দিনই ভুটানের সঙ্গে হারতে পারে না। কিন্তু ভুটানের কাছে পরাজয় আমাদের দেখতে হবে– এটা কোনোদিন চিন্তাই করিনি। আমরা সেই সময় ভুলেও ভাবিনি, আসলেই বাংলাদেশের ফুটবলের মান ভুটানের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে।

কিন্তু এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভুটানের ফুটবলের মধ্যে এখন আর বিশেষ কোনো ইতরবিশেষ নেই। ১০ অক্টোবরের পরাজয় আমাদের এক কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটা ঠিক যে ভুটান এখন মালদ্বীপের কাছে ৩-১ গোলে হার মানে। ভারতের সঙ্গে ড্র করে। বাংলাদেশও এখন মালদ্বীপ ও নেপালের সঙ্গে ম্যাচে হরহামেশাই হেরে যায়। আর ভারতের সঙ্গে জেতে কদাচিৎ।

সব থেকে বিবেচ্য হচ্ছে, ভুটানের কাছে তিন গোল হজম। এ-ও কী সম্ভব? ভাগ্যিস চার গোল হয়নি গোলরক্ষক একটা পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেওয়ায়। ইদানিং খেলা দেখার একটা সহজ উপায় হচ্ছে ইন্টারনেটে লাইভ স্ট্রিমিং কোনো চ্যানেলে ঢুঁ দেওয়া। বিভিন্ন সাইটে ঢুঁ মারার ফাঁকে কোনো একটা সাইটে দেখলাম বাংলাদেশকে ভুটান তিন গোল দিয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশ দিয়েছে এক গোল। আমি স্তদ্ধ হয়ে গেলাম! ভুল দেখছি না তো? এটা কী করে সম্ভব?

আমার মনে হয়, যতদিন দিন ধরে আমি খেলাধূলা অনুসরণ করি, কোনোদিন এত কষ্ট পাইনি! বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে বার এশিয়া কাপের ফাইনালে হেরে গেল, কষ্ট পেয়েছিলাম। বা গেল বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে বা টি-২০ তে আবারও ভারতের সঙ্গে হারে মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু এতটা খারাপ হয়নি, যেটা ভুটানের কাছে হারে হয়েছে। মানছি, ভুটানের খেলায় অনেক উন্নতি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময় তারা ভারত ও মালদ্বীপের সঙ্গে ভালো খেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল কি এতই পিছিয়ে পড়েছে যে ভুটানের সঙ্গে চার গোল হজমের শঙ্কার সামনে পড়তে হবে?

ফুটবলে এই পতনের কারণ কী? এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে অযোগ্য লোকের হাতে ফুটবল ফেডারেশনের নেতৃত্ব চলে যাওয়া। এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। যাঁরা এখন আছেন তাঁদের যদি নূন্যতম আত্মমর্যাদা থাকত তাহলে এতক্ষণে তাঁরা বাফুফে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু তাঁরা যাননি।

বাফুফে বিশেষ করে সভাপতি বার বারই বলে থাকেন অর্থ সঙ্কটকের কারণে তাঁরা কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এটা ডাহা মিথ্যা কথা। একটা দেশে কোনো একটা সুনির্দিষ্ট খেলা কিভাবে উন্নতির দিকে যায়, তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশের ক্রিকেট। একটা সময় ছিল যখন দেশে সব স্পনসর ফুটবলেই যেত। সেখান থেকে ক্রিকেট আস্তে আস্তে আজকের পর্যায়ে এসেছে তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে। আর ফুটবল তলানিতে চলে গেছে। ফিফা র‌্যাংকিংয়ে এখন বাংলাদেশ ১৮৫তম স্থানে, যা দেশের ইতিহাসে সব থেকে খারাপ।

গত কয়েক বছরের ফুটবল দলের ফলাফল বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে, ভুটানের কাছে পরাজয় কিন্তু হুট করে নয়। এটা অনেকদিনের ব্যর্থতার পরিণতি। বাংলাদেশে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে আট ম্যাচে ৩২ গোল হজম করেছে। এর মধ্যে জর্দানে গিয়ে আট গোল খেয়েছে, সাফে আফগানিস্তানের সঙ্গে চার গোল, তাজিকদের কাছে পাঁচ গোল। এবং সর্বশেষ মালদ্বীপের কাছে পাঁচ গোল হজম। এরই ধারাবাহিকতায় ভুটানের কাছে পরাজয়।

ধারাবাহিক এত বাজে ফলাফলের কারণ হিসেবে অনেক সময়ই একটা কথা বলা হয়ে থাকে যে, খেলোয়াড়দের মধ্যে দেশপ্রেম নেই, নেই দায়িত্ববোধ। খেলোয়াড়রা কোচের কথা শোনেন না। কোচকে না জানিয়েই অন্যত্র খেলতে চলে যান। তাঁরা কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা করেন না। কারণ, খেলোয়াড়রা জানেন, তাঁদেরই আবার ডাকতে হবে। আর কোনো ভালো খেলোয়াড় নেই। কিন্তু এই সার্বিক পরিস্থিতির জন্য খেলোয়াড়রা দায়ী নন, দায়ী বাফুফে।

আমরা মনে করি, বাফুফের কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো দেশপ্রেম নেই। নেই দায়িত্ববোধ। আছে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লোভ। বাংলাদেশে সবচেয়ে 'বেহায়া' লোকগুলো এখন বাফুফের শীর্ষস্থানে অসীন। তাঁরা মনে করেন, বিদেশ থেকে একজন কোচ ধরে আনলেই ভালো ফলাফল আসবে। সারা দেশে মাঠে খেলা থাকুক আর না-ই থাকুক।

ফুটবলের পুনর্জন্ম চাইলে বাফুফের সব কর্মকর্তাকে বিদায় করে দিতে হবে। এর পর নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে ফুটবলকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের ফুটবলে ক্রিকেট সংগঠক সাবের হোসেন চৌধুরী বা আ হ ম মোস্তফা কামালের মতো সংগঠক দরকার।

বাফুফের পুনর্গঠনের পরপরই সারা দেশে নিয়মিত খেলা শুরু করে দিতে হবে। সব থেকে জরুরি হচ্ছে, দেশের তৃণমূলে তিনটি লিগের আয়োজন করতে হবে। প্রতিটি জেলায় অনূর্ধ্ব ১৪, ১৬ ও সিনিয়রদের লিগ আয়োজন করা। প্রতিটি জেলায় লিগের আয়োজন বাধ্যতামূলক করতে হবে। না পারলে জেলার ফুটবল কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করতে হবে। জেলা পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন দল নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে লিগ বা টুর্নামেন্ট হবে। এরপর বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে একটা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্ট করতে হবে। আর স্কুল টুর্নামেন্ট তো চলবেই।

এসবের পাশাপাশি কমপক্ষে একটি একাডেমির কাজ শুরু করে দিতে হবে জরুরিভিত্তিতে। তবে পর্যায়ক্রমে একাডেমির সংখ্যা বাড়াতে হবে। কারণ, বিকেএসপি থেকেও আর ভালো মানের ফুটবলার আসছে না। আপাতত এসব কর্মসূচি শুরু করে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বাফুফের কর্মকর্তারা বিশেষ করে সভাপতি প্রায়ই একটি কথা বলে থাকেন যে, ইউরোপে ক্লাবগুলোর নিজস্ব একাডেমি থাকে। সেখান থেকেই খেলোয়াড়রা বেরিয়ে আসেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে ইউরোপে ফুটবল একটি পেশাদার কাঠামো লাভ করেছে; বাংলাদেশে সেটা নেই। এখানে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর অবশ্যই ইউরোপের দেশগুলোর ন্যাশনাল একাডেমি আছে। বস্তুত এসব দেশে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগেই ফুটবলের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে যদি বাংলাদেশের ফুটবলকে বের করে আনা না যায়, তবে দেশের ফুটবলের 'এপিটাফে' লেখা থাকবে যে সালাউদ্দিনরা দেশের ফুটবল জন্ম দিয়েছিলেন সেই সালাউদ্দিনদের হাত ধরে ফুটবল পরলোকগমন করে! বাফুফের সভাপতি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন। বলা চলে তিনি বা তাঁদের হাত ধরেই বাংলাদেশ ফুটবল দলের জন্ম।

কখনও ভাবিনি আমার শৈশবের 'স্বপ্নের নায়ক'কে নিয়ে আমাকে এ ধরনের কথা লিখতে হবে। আমরা যারা সালাউদ্দিনের খেলা দেখিনি, তবে তাঁর খেলার গল্প শুনে আর 'লাইফবয় সাবানে'র বিজ্ঞাপন দেখে তাঁর ভক্ত হয়েছিলাম, সেই আমরা চাইনি এতটা ব্যর্থ সালাউদ্দিনকে দেখতে।