বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি নয়

রজিউদ্দীন রতন
Published : 26 Nov 2011, 03:02 PM
Updated : 26 Nov 2011, 03:02 PM

বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর-এ ফাহাম আব্দুস সালাম সম্প্রতি একটি লেখায় বলেছেন, ইংরেজিতে বিজ্ঞান পড়া উচিত তো বটেই এমনকি তা বুঝতেও শেখা উচিত ইংরেজিতে। বাংলায় বিজ্ঞান বইয়ের অনুবাদ নাকি জ্ঞানের ইতরীকরণ! বিজ্ঞান বাংলায় অনুবাদ করা কীরকম অসম্ভব সেটা বোঝাতে লেখক একটি গবেষণা প্রবন্ধের 'অ্যাবস্ট্রাক্ট' দিয়েছেন এবং পরিভাষাগুলো বাদ রেখে হলেও সেটার অনুবাদ করে দেখতে বলেছেন। আমি নিজে ইংরেজি কাজ চালানোর মতো জানি। পারতপক্ষে বলি না, লিখিও না। আমার কাছে ইংরেজির তেষ্টা মেটানো গরম পানি পান করার মতো। তাতে জীবন বাঁচে, কিন্তু তৃপ্তি হয় না। ইংরেজি ভালো না জানলেও আমি বিজ্ঞানের ছাত্র বলে লেখকের দেয়া অ্যাবসট্রাক্টটি বুঝতে পারলাম। অন্তত আমার তাই মনে হল। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে একজন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম যার মাতৃভাষা ইংরেজি। তাকে লেখকের দেয়া অ্যাবস্ট্রাক্টের প্রথম অংশটি দিলাম। সেটি এরকম:

The cytokines interleukin-3 (IL-3), interleukin-5 (IL-5), and granulocyte-macrophage colony stimulating factor (GM-CSF) exhibit overlapping activities in the regulation of hematopoietic cells. All these cytokines signal via a specific alpha receptor () and the shared human beta common subunit (hβc). This thesis explores IL-3 and GM-CSF receptor binding and activation mechanisms.

অ্যাবসট্রাক্টটি পড়ে আমার বন্ধুর চেহারাটি হয়েছিল দেখার মতো! প্রতিক্রিয়ায় সে আমাকে যা বলেছিল সেটি কেবল বন্ধুদেরকেই বলা যায়। ভদ্রমহলে তার একটা অনুবাদ করতে পারি কেবল। আমার বন্ধুটি বলল, "ক্ষেপেছ নাকি! এটি কীসের ঘণ্ট! আমি কীভাবে এই জিনিস বুঝবো! তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে…!' তখন আমি তাকে আমার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বুঝলে হে, পরিবেশে যতো ক্ষতিকর জীবাণু কিলবিল করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে থাকে রক্ষীকোষ। তারা নানা উপায়ে জীবাণুদের ঘায়েল করে। রক্ষীকোষ অনেক রকমের হতে পারে। তাদের মধ্যে একটা হচ্ছে ম্যাক্রোফেজ। এই ম্যাক্রোফেজরা কী করে জানো? তাদের কাজ জীবাণুদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলা আর শরীরের অন্য যেসব বিশেষ রক্ষীকোষ আছে তাদেরকে সংকেত দেয়া। শরীরের রক্ষীকোষদের মধ্যে একটা দল আছে যাদের বলে গ্রানিউলোসাইট। গ্রানিউল মানেতো জানই, ওই গুঁড়ো গুঁড়ো অথবা দানাদার জিনিস। আর সাইট এসেছে সাইটো শব্দটা থেকে যার মানে হলো গিয়ে কোষ। সব মিলিয়ে এরা হচ্ছে সেই কোষ যাদের মধ্যে দানাদার বস্তু থাকে। এইসব কোষেরা বিশেষ ধরনের বিষ দিয়ে শরীরে অণুপ্রবেশ করা জীবাণুকে মারতে পারে।

আজকাল যে হর-হামেশা 'স্টেম সেল'-এর নাম শোন, তারা কী জানো? 'স্টেম সেল' মানে স্টেম কোষ; 'স্টেম কোষ' হলো শরীরে অনেক প্রয়োজনীয় কোষের প্রাচীন অবস্থা। মানে হলো, ধরো তুমি যেমন ময়দার কাই বা খামির দিয়ে রুটিও বানাতে পারো বিস্কুটও বানাতে পারো, সেরকম। 'স্টেম সেল' নিজে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে আরো 'স্টেম সেল' যেমন বানাতে পারে তেমনি অন্য অনেক ধরনের কোষও বানাতে পারে। যেসব 'স্টেম সেল' পরবর্তীতে 'ম্যাক্রোফেজ' অথবা 'গ্রানিউলোসাইট'দের মতো শরীরের রক্ষীকোষ তৈরি করে তাদেরকে বলে 'হেমাটোপোয়েটিক স্টেম সেল' অথবা 'হেমাটোপোয়েটিক' কোষ। 'স্টেম সেল' বৃদ্ধি পেয়ে অন্য কোন ধরনের বিশেষ কোষে রূপান্তরিত হবে সেটা নির্ভর করে এসব কোষ কী ধরনের সংকেত পাচ্ছে তার উপর। কোষেরা সংকেত পায় কীভাবে জানো তো? কোষেরা সংকেত পায় বিভিন্ন রকমের প্রোটিন কণা দিয়ে। এসব সংকেত দেয়ার প্রোটিন কণাকে বলে 'সাইটোকাইন'। 'সাইটো' মানে 'কোষ', আর 'কাইন' এসেছে 'কাইনোস' থেকে যার মানে 'গতি'। এসব কিন্তু গ্রীক শব্দ, তোমরা ইংরেজরা নিজের বলে চালাচ্ছ এখন! সে যাকগে, যা বলছিলাম, এই অ্যাবসট্রাক্ট-এ যে লেখা 'ইন্টারলিউকিন-৩' (আইএল-৩), 'ইন্টারলিউকিন-৫' (আইএল-৫) আর 'গ্রানিউলোসাইট-ম্যাক্রোফেজ কলোনি স্টিমুলেটিং ফ্যাক্টর' (জিএম-সিএসএফ)–এসবই হলো একেক ধরনের কোষকে সংকেত দেয়ার প্রোটিন মানে 'সাইটোকাইন'।

এখন পড়ে দেখ তো, অ্যাবস্ট্রাক্টের প্রথম লাইনটা খুব বিস্তারিত না হলেও খানিকটা বুঝতে পারো কিনা! আমি তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এতে বলছে, , "'আইএল-৩', 'আইএল-৫' এবং 'জিএম-সিএসএফ' নামের এই তিনটি 'সাইটোকাইন' 'হেমাটোপোয়েটিক স্টেম সেল'কে তার বৃদ্ধি অথবা ভবিষ্যৎ নির্ধারণে যে সংকেত দেয়, সেই সংকেত দেয়ার প্রক্রিয়ায় খানিকটা মিল রয়েছে।" এখন তোমার যদি এই বিষয়ে আগ্রহ থাকে তাহলে পুরো প্রবন্ধটা পড়ে বিস্তারিত জেনে নিতে পার। এতো কিছু বুঝিয়ে বলার পরেও অবশ্য আমার বন্ধুটি খুব খুশি হতে পারেনি। কারণ সে বিজ্ঞানের ছাত্র নয়। বিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান তার নেই। নিজে ইংরেজিভাষী হলেও 'সাইটোকাইন', 'ইন্টারলিউকিন', 'গ্রানিউলোসাইট' অথবা 'ম্যাক্রোফেজ'-এর মতো শব্দ তার পরিচিত নয়। এক লাইনে বুঝিয়ে বললেও সে এসব খুব বিস্তারিত জানবে না। একটি গবেষণা প্রবন্ধের একটি লাইনের আসল মানে কী, তার তাৎপর্য কতটুকু সেটা সে সহজে বুঝে উঠতে পারবে না। সেটি বুঝে উঠতে তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে হবে। অন্য বিষয়ের ছাত্র হলে তো দূরের ব্যাপার, একজন ইমিউনোলজি অথবা রোগপ্রতিরোধবিদ্যার ছাত্রও তো তার পড়াশোনার প্রথম অথবা মধ্যভাগে এই গবেষণা প্রবন্ধটি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারবে না! আমরা কী একটি ষষ্ঠ শেণীর শিক্ষার্থীকে জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটিতে কবি কী বলতে চেয়েছেন সেটি জিজ্ঞাসা করব? সে নিজে বাংলাভাষী হলেও সেই কবিতাটি বুঝে ওঠার জন্য তার যথেষ্ট বেড়ে ওঠার প্রয়োজন রয়েছে!

একটি গবেষণাপ্রবন্ধ নিয়ে ইংরেজ বন্ধুকে পড়ানোর ফলাফলটি এখানে বলার উদ্দেশ্য পাঠকদেরকে জানানো যে, বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি নয়। সেরকম হলে ইংরেজমাত্রই বিজ্ঞানের গবেষণা প্রবন্ধ পড়ে তার তাৎপর্য বুঝে ফেলত! ফাহাম আব্দুস সালামের আরেকটি কথাতে দ্বিমত রয়েছে আমার। লেখক বলেছেন, গবেষণা প্রবন্ধের অ্যাবসট্রাক্ট সাধারণ বিজ্ঞান পাঠকদের জন্য লেখা হয়। আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়, এটি লেখা হয় পুরো প্রবন্ধটিকে কী বলা হয়েছে তা আগ্রহীদেরকে ঝট করে বলে দেয়ার জন্য । এটা সবার জন্য নয়, বরং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষার্থী, গবেষক এবং সেই বিষয়ে কাজ করছেন এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য। এই সময়ের বিজ্ঞান প্রবন্ধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট জানাশোনা না থাকলে কেউ বুঝতে পারবেন না। না পারাটাই স্বাভাবিক। সাধারণ বিজ্ঞান পাঠক যারা বিজ্ঞানে কৌতুহলী, তাদের জন্য সব ভাষাতেই সহজবোধ্য বিজ্ঞানের বই লেখা হয়। বাংলায় অনেক কম লেখা হয়, ইংরেজিতে লেখা হয় হাজারগুণে বেশি।

ফাহাম আব্দুস সালাম বলতে চাইলেন, বিজ্ঞানের পরিভাষা বাদ দিয়েও, এমনকি বিশেষ্য বিশেষণ অথবা ক্রিয়া পদগুলোর বাংলা করাও সহজ নয়! বিজ্ঞান বুঝতেও হবে ইংরেজিতে, চিন্তাও করতে হবে ইংরেজিতে! তিনি তাঁর লেখায় দু'জন বৈজ্ঞানিকের কথা বলেছেন যাঁরা তাঁদের প্রথম শেখা ভাষা না হলেও বিজ্ঞান বোঝেন ইংরেজিতে। অথচ, দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে আছি বলে এবং বিজ্ঞানের ছাত্র হবার সুবাদে আমি অসংখ্য ছাত্র শিক্ষককে দেখেছি যাঁরা বিজ্ঞান পড়েছেন, বুঝেছেন, সাধনা করেছেন তাঁদের নিজেদের ভাষায়। এমনকি এখনো জার্মানিতে ইংরেজিতে বিজ্ঞান পড়ানো হয় খুব কম ক্ষেত্রেই। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করে তারা কেবল ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করে। বিজ্ঞানের খবর রাখেন এমন কেউ বলতে পারবে না নিজের ভাষায় বিজ্ঞান শিখে জার্মানি পিছিয়ে রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে আমার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকজন জার্মান বৈজ্ঞানিকের সংস্পর্শে আসার, তাঁরা কেউ নোবেল বিজয়ী নন বটে কিন্তু বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁরা প্রথম সারির। নিজেদের বিষয়ে তাঁরা সবার সেরা, সবার উপরের। এঁদের অনেকেই খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না। কিন্তু সেটা জানাতে এই লেখাটি লিখছি না। আমি বলতে চাইছি বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি তো নয়ই, বিজ্ঞানীর ভাষাও ইংরেজি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিজ্ঞানের শব্দ মাত্রও ইংরেজি নয়। বিজ্ঞানের পরিভাষাও ইংরেজি নয়। গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, সব ভাষারই অংশ আছে তাতে। এবারে যে 'টল লাইক রিসেপ্টর' সম্পর্কিত গবেষণার জন্যে চিকিৎসায় নোবেল পুরষ্কার দেয়া হল, সেই 'টল' শব্দটি জার্মান!

যে দু'জন বৈজ্ঞানিকের কথা ফাহাম আব্দুস সালাম বলেছেন তাঁরা নিঃসন্দেহে পূজনীয়। তাঁদের প্রতি যথেষ্ট সন্মান জানিয়েই বলছি, মানুষের ভাষা এবং চিন্তা করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁদের মতামতের চাইতে আমি একজন মনোবিজ্ঞানীর মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেব। মানুষের চিন্তা করার প্রক্রিয়াটি খানিকটা জানতে চেষ্টা করেছি স্টিভেন পিন্কারের কাছ থেকে। আগ্রহী পাঠককে জানিয়ে রাখি, পিন্কার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর। তিনি গবেষণা করেন ভাষা এবং ভাষামনোস্তত্ত্ব বিষয়ে। ভাষামনোস্তত্ত্ব বিষয়ক তাঁর গবেষণা এবং লেখা বইয়ের জন্য তিনি বিখ্যাত।

পিন্কার বলেন (ভাবানুবাদ করছি), আমরা যখন শব্দ মিলিয়ে বাক্য তৈরি করি তখন আসলে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারণা অথবা বোধ মিলিয়ে একটা পূর্ণ ছবি আঁকার চেষ্টা করি। যে ছবিটি আমাদের বক্তব্য ধারন করে। আমাদের বক্তব্য শ্রোতার মস্তিস্কেও সেই একই ছবি তৈরি করে। এই যে আমরা অসংখ্য ধারণা বা বোধের হিসেব মিলিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি এঁকে একেকটি বাক্য তৈরি করি, সেটা আমরা করি আমাদের অবচেতন মনে সচেতন কোনো বাড়তি চেষ্টা ছাড়াই। এরকম অসংখ্য ধারণা বা বোধ মিলিয়ে ভাষা বুঝতে পারার এই প্রক্রিয়াই হচ্ছে চিন্তার ভাষা। স্থান, সময়, বিষয়, কারণ, মানসিকতা, পরিপ্রেক্ষিত ইত্যাদির মতো খুব প্রাথমিক ধারণা বা বোধগুলোই চিন্তার ভিত্তি তৈরি করে।

মনোবিজ্ঞানের কেতাবি হিসেব বাদ দিলেও একটি সহজ ব্যাপার বুঝতে চেষ্টা করতে পারি আমরা। ধরা যাক, আমাদের ভাষা আমরা কীভাবে পাই? ভাষা কী? মানুষের ভাষা (মৌখিক ভাষার কথা বলছি) হচ্ছে, কেউ তার ভাবনা, তার ধারণাকে কিছু শব্দ দিয়ে জানায় অন্য কাউকে। সেই 'অন্য কেউ' প্রথম ব্যক্তির বলা শব্দগুলোকে (অবচেতনভাবে) বিশ্লেষণ করে তার ভাবনাটি বুঝতে পারে (ভাষার সংগায় এই কথাটি পিন্কারও বলেছেন)। সেইজন্যে শব্দ করলেই তা ভাষা হয়না। সেই শব্দটি যদি শ্রোতার মনে একটি নির্দিষ্ট ভাবনা/বোধের জন্ম না দেয় তাহলে সেটা ভাষা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, শব্দের সঙ্গে ভাবনা বা বোধ মেলানোর এই ক্ষমতাটি আমরা কোথায় পাই? কোন শব্দ কোন বোধকে প্রকাশ করে তা আমরা কীভাবে বুঝতে পারি? এইখানেই মাতৃভাষা অথবা ফাহাম আব্দুস সালামের কথামতো ভাষাপ্রেমের অকেজো আবেগ দূরে রেখে বলি, 'প্রথম শেখা ভাষা'র গুরুত্ব। একটি শিশু তার পরিবেশ থেকে তার প্রথম শেখা ভাষার শব্দগুলোর সঙ্গে অবচেতন মনে একটা ছবি আঁকতে শেখে। একেকটি পরিস্থিতি পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করে চিন্তার ভাষা তৈরি করতে শেখে। একটা বাঙালি শিশুকে সেজন্য 'ম্যাঙ্গো' কী জিনিস তা বোঝাতে 'আম' বললেই হয়। অথবা যে কখনো আম দেখেনি তাকে যদি বলা হয় 'আম এক ধরনের ফল'। তাহলে সে বুঝতে পারে। কারণ তার ভেতরে 'এক' শব্দটির ধারণা রয়েছে, রয়েছে "ধরন' এবং "ফল' শব্দটিরও ধারণা। এই শব্দগুলো মিলিয়ে সে তার অবচেতন মনে একটা ছবি আঁকতে পারে। সেই ছবি আঁকার প্রক্রিয়াটি সে শিখেছে তার পরিবেশ থেকে। একেবারে শিশুকাল থেকে একেকটি শব্দ, আর ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে তার মস্তিস্ক জেনেছে কোন শব্দের কী মানে, কোন শব্দ দিয়ে কোন ধারণা প্রকাশ হয়। সেই জন্যে মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে শব্দকে মিলিয়েও ভাষার ভাবোদ্ধার করে। সেই জন্যে মানুষ বিভিন্ন শব্দকে মিলিয়ে সব রকমের ধারণার প্রকাশ করতে পারে। সভ্য মানুষের একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষার ক্ষমতাও এখানে; ভাষা অল্প কিছু শব্দ দিয়েই অসীম ভাব প্রকাশ করতে পারে।

যে শিশুটি বাংলা ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে তার ভাবনা তার ধারণাকে প্রকাশ করতে এবং বুঝতে শিখেছে তাকে তাই ইংরেজি শেখাতে গেলে বলে দিতে হয়, 'ম্যাঙ্গো' মানে 'আম'। সে আম না চিনলে তাকে বলে দিলেই হয়, 'আম হচ্ছে এক ধরনের ফল'। তাকে কখনো বলে দিতে হয়না, 'এক' শব্দটি থেকে কী ধারণা পেতে হবে, 'ফল' শব্দটি থেকেই বা কী ধারণা পেতে হবে! শেখার মাধ্যম তাই যে ভাষাই হোক, চিন্তার মাধ্যম সবসময়েই মাতৃভাষা বা আরও সঠিকভাবে বললে প্রথম ভাষা । যে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কেউ তার প্রথম ভাষা আয়ত্ত করতে শেখে সেই প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করে কাউকে অন্য একটি ভাষায় চিন্তা করতে শেখানো কেবল অবৈজ্ঞানিক নয়, অসম্ভবও। অনেকে বাংলাভাষী হয়েও হয়তো দাবী করতে পারেন তাঁরা ইংরেজিতে ভাবেন। আমি তাঁদেরকে তাঁদের ভাবনার ভাষা চেনাতে চাইছি না। সেই দায় আমার নয়। আমি কেবল পাঠকদের বলে রাখি, চিন্তা করার ভাষা ব্যাপারটি অনৈচ্ছিক, সেটি ব্যবহার করা এবং বুঝতে পারা অবচেতন মনের কাজ। অবচেতন মন সেই কাজটি করতে শেখে একেবারে শিশুবেলায়, অনেক টানাপোড়েন সামলে তারপর। কেউ সচেতনভাবে ঠিক করে দেন না তিনি কোন ভাষায় ভাববেন।

একজন ইংরেজ যখন বিজ্ঞান শেখে সে তখন তার মাতৃভাষায় কল্পনা অথবা চিন্তার দারুণ ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই বিজ্ঞানের তত্ত্ব অথবা পরিভাষা বুঝতে পারে। একটি বাঙালি শিশু যখন ইংরেজি শেখে সে তখন তার মাতৃভাষাতেই ইংরেজি শেখে। সেই বাঙালি শিশুটিকে যদি ইংরেজিতে বিজ্ঞান পড়তে দেয়া হয় তাহলে সে ইংরেজিতে পড়বে ঠিকই কিন্তু সেটার অনুবাদ করে নেবে বাংলায় এবং বাংলায় অনুবাদ করার পরেই সে বুঝতে পারবে সেই বিজ্ঞানের তাৎপর্য। সে যদি ইংরেজিতে বিজ্ঞান পড়ে বুঝতে দারুণ অভ্যস্থ হয়ে যায় তখন ওই অনুবাদের কাজটি সে করবে অবচেতন মনে। কখনো কখনো তখন তার মনে হতে পারে সে ইংরেজিতে বুঝতে পারছে! অনেক ইংরেজি অথবা বিদেশী শব্দের পরিভাষা বাংলায় নেই। এরকম শব্দ আমরা ব্যাখ্যা করে বুঝি। ব্যাখ্যাটি কিন্তু বাংলাতেই হতে হয়! জার্মানরা খাওয়ার আগে পরিচিত জনকে বলে 'গুটেন আপেটিট'। তার মানে, 'তোমার খাওয়া ভালো হোক' অথবা 'ভালো মতো খাও'। বাংলায় যেমন সকালে সুপ্রভাত বলে শুভেচ্ছা জানানোর নিয়ম, যার মানে 'তোমার সকাল শুভ হোক'। জার্মানরা সেরকম শুভেচ্ছা খাওয়ার আগেও জানায়। খাওয়ার আগে শুভেচ্ছা জানাতে তারা বলে 'গুটেন আপেটিট'। এটা তাদের সংস্কৃতি। প্রিয় পাঠক আমার মনে হয়, 'গুটেন আপেটিট' জাতীয় শব্দমালা এমনকি এই সংস্কৃতি বাংলাতে না থাকলেও এই শব্দ দুটির অর্থ, ব্যবহার এবং তাৎপর্য বুঝতে আপনাদের কারো জার্মান শিখে জার্মান ভাষায় ভাবতে হয়নি!

সচেতন মনে অনেকেই বাংলা শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে অনেক ইংরেজি শব্দের অর্থ করতে পারেন না। প্রয়োজনীয় ছবি আঁকতে পারেন না। অনেকের ধারণা তাঁরা সেই কাজটি করেন ইংরেজিতে। সেটি অনেকের ক্ষেত্রে তাঁদের দাবী অনুয়ায়ী সত্য হতে পারে, সেই তর্কে যাবো না। তাঁদের দাবীই মেনে নিলাম। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য এটা সত্য নয়। যেসব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নেই, যেসব আচরণের প্রতিরূপ বাংলা সংস্কৃতিতে নেই সেসবও বাঙালিরা বাংলাতেই বোঝেন। কেবল প্রথমবার সেটার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়।

বাংলাভাষী শিশুরা অথবা বাংলাভাষী বাবা মায়ের সন্তানরা শিশুকাল থেকেই দেশের বাইরে বেড়ে উঠলে সেই পরিবেশের প্রভাবেই তারা অন্য ভাষায় ভাবতে শেখে। কিন্তু একেবারে শিশুকাল থেকেই ভিন্নভাষী পরিবেশে না থাকলে তার ভিন্ন ভাষা আয়ত্ব করার মাধ্যমটিও বাংলা-ই রয়ে যায়। যে কথাটি প্রথমে বলতে চেয়েছিলাম, একটি শিশু যদি জন্মগত ভাবে ইংরেজিভাষীও হয়, তাহলেও বিজ্ঞান বুঝতে তাকে বিজ্ঞানের পরিভাষা নয়, নির্ভর করতে হয় তার মাতৃভাষা ইংরেজিটুকুতেই। যে ইংরেজি তাকে তার অবচেতন মনে একটি বোধগম্য ছবি আঁকতে শেখায়। সেই ভাষাতেই সে বিজ্ঞানের পরিভাষাকে অনুবাদ করে। সবাই তার নিজের মাতৃভাষাতেই বিজ্ঞানকে অনুবাদ করে নিয়ে তারপর বোঝে। বিজ্ঞানের পরিভাষা কারো মাতৃভাষা নয়! বিজ্ঞানের পরিভাষা অনুবাদের ভালো দিকটিও এখানে। রেডিওঅ্যাক্টিভিটি শব্দটির বাংলা তেজস্ক্রিয়তা। এটি একটি তৈরি করা শব্দ। আমার ভুল না হলে এই শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি। এতো চমৎকার অনুবাদ কিন্তু আরো অনেক বৈজ্ঞানিক পরিভাষারও হতে পারে। পরিভাষা মানেই কেন অবোধ্য আর খটোমটো হতে হবে! পরিভাষা তো অর্থবহও হতে পারে। শ্বেতকণিকা শব্দটি কি হাস্যকর? অথবা লোহিত কণিকা? এগুলোও তো বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। সব বৈজ্ঞানিক শব্দের বাংলা হতে হবে তাও তো নয়! অনেক বৈজ্ঞানিক শব্দই বাংলায় দারুণ মানিয়ে যায়! কিন্তু বাঙালির মনের ভেতরে একটা অর্থবহ ছবি আঁকতে যদি বাংলা বৈজ্ঞানিক পরিভাষার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটা আমরা করব না কেন! আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা কিন্তু ইংরেজিতেও খুব দারুণ দারুণ সব শব্দ নয়। অনেকক্ষেত্রেই সেসব অবোধ্য আর হাস্যকর। কিন্তু সেগুলো বিজ্ঞানের প্রয়োজনে এসেছে, সেটা গ্রহণ করবার মানসিকতাও তাদের রয়েছে। কেউ যদি গ্রহণযোগ্য বাংলা বৈজ্ঞানিক পরিভাষাকে হাস্যকর আর উদ্ভট বলে তাহলে তাকে মৌলবাদী বলা ছাড়া আর উপায় নেই! তার অন্ধ ইংরেজভক্তি দুধে ধুলেও যাবে না! আর তাছাড়া বৈজ্ঞানিক শব্দমাত্রই কিন্তু ইংরেজি ভাষার শব্দ নয়। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন বিজ্ঞানে নিত্য নতুন পরিভাষা যোগ হয়। যিনি কোনো নতুন আবিষ্কার করেন অথবা তত্ত্ব উত্থাপন করেন তিনিই সেটার ব্যাখ্যা দেন এবং প্রয়োজনীয় পরিভাষাটি প্রস্তাব করেন। বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তাই ইংরেজরাও মায়ের মুখ থেকে শেখে না।

ফাহাম আব্দুস সালাম বলছেন "প্রশ্ন হলো যে ভাষায় আপনি অনুশীলন করছেন সে ভাষার এমন সক্ষমতা আছে কি না যে সে ধারণ করবে প্রয়োজনীয় কনসেপ্টগুলো, ভাষাটি আপনার প্রথম না দ্বিতীয় সেটা খুব বড় বিষয় না। খুব ভালো হোতো যদি বাংলা ভাষার এই ক্ষমতা থাকতো, কিন্তু বাস্তবতা হোলো সে ক্ষমতা আমাদের নেই।" এই বাক্যটিতে তীব্র আপত্তি রয়েছে আমার। একটি জাতির ভাষায় কোনো ধারণা বোঝার অথবা বুঝিয়ে বলার সামর্থ নেই মানে সেই জাতি ওই ধারণাটিই গ্রহন করতে পারে না। তাদের মস্তিস্ক ওই ভাবনার জন্য উপযুক্ত নয়! লেখক ভাষা এবং চিন্তা সম্পর্কে খুব না জেনেই বলেছেন বলে সন্দেহ হয়। বাংলা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর একটি। অসীম ধারণা প্রকাশ করতে যতোটা বিবর্তনের প্রয়োজন হয় বাংলার তা হয়েছে। লেখকের শব্দভাণ্ডারে যথেষ্ট শব্দ না থাকতে পারে, মাতৃভাষার ব্যবহারে লেখকের মন বাংলা শব্দকে সবরকম ধারণায় বদলে নেয়ার জন্য তৈরি অথবা অভ্যস্থ নাহয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে বাঙালি এবং বাংলা চিন্তাশক্তিতে দুর্বল বলে মেনে নিচ্ছি না। ভাষা বিবর্তনের সেরা ফসলগুলোর একটি। তুলনামূলক কম বিবর্তিত প্রাণীদেরই ভাষা (ভাব প্রকাশের ব্যপ্তির হিসেবে) দুর্বল হয়! কম বিবর্তিত ভাষাই যথেষ্ট ভাব প্রকাশ করার অযোগ্য হয়!

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছে তো নিশ্চয়ই। যতো বাঙালি বিজ্ঞানের চর্চা করছেন সব বাংলাতেই হচ্ছে। তাঁরা পড়ছেন হয়তো ইংরেজিতে কিন্তু ভাবছেন বাংলায়। বিজ্ঞান কোনো জাতির জন্য নির্দিষ্ট নয় বলে বিশ্বের জন্য তাঁরা ইংরেজিতেই সেটার প্রকাশ করছেন। সেজন্য তাঁদের ইংরেজি শিখতে হয়েছে নিশ্চয়ই। আমাদের আজকের শিক্ষার্থীরাও ভালোমত ইংরেজি শিখবে। তাদের ইংরেজিতে দূর্বলতা কেন তৈরি হচ্ছে সেটা আমরাই খুঁজে বের করব এবং দূর করব। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিখবে কেবল সেটা আন্তর্জাতিক ভাষা বলে। বিজ্ঞানের ভাষা বলে নয়। বিজ্ঞানের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। যে ভাষাতেই বিজ্ঞানের সেই ভাষাকে অনুবাদ করা হোক তার অর্থ বদলে যায় না। বদলে যাওয়ার উপায় নেই বলেই সে বিজ্ঞান।

আরেকটি কথা বলতে চাই, ভাষা হিসেবে বারো বছর ধরে ইংরেজি শিখিয়েও আমাদের ছেলেমেয়েদের যে ইংরেজিতে দুর্বলতা সেটির জন্য কেবল ইংরেজি বিমুখতা দায়ী নয়। সেরকম হলে আমাদের ছেলেরা কেবল ইংরেজিতে কাঁচা হলেও গণিতে, বিজ্ঞানে নাহয় অন্তত বাংলাতে পোক্ত হয়ে উঠতো। কিন্তু বাস্তবতা সেরকম নয়। সেটার কারণও ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। আমরা পড়াশোনা করেছি শেখার আনন্দে, শেখার জন্যে নয়! আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠরা পড়াশোনা করেছি মুখস্ত করে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য। আমাদের শিক্ষা আমাদেরকে চিন্তা করতে শেখায় নি। শিক্ষা আমাদেরকে আনন্দ দেয় নি। এটা বিরাট সমস্যা তো বটেই। এবং এই সমস্যার সমাধান করার প্রয়োজন এখনই। এবং সেজন্যেই আমরা বলছি বাংলায় সহজবোধ্য বিজ্ঞান লেখার এবং পড়ানোর কথা। আমাদের শিশুরা যখন বিজ্ঞানের তীব্র আনন্দ বুঝতে পারবে তখন তারা নতুন কিছু সৃষ্টিরও উৎসাহ দেখাবে। রুপকথার গল্পের মতো সেটি কেবল বই লিখে সম্ভব নয়, জানি। বিজ্ঞানের আবহ এবং উচ্চতর গবেষণার সুযোগও আমাদেরকেই তৈরি করতে হবে। অন্য কোনো দেশ কিন্তু বাঙালি জাতির ভবিষ্যত বিজ্ঞানীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে বসে নেই! আমরা একটি জাতি কি অন্য দেশে পাওয়া একটু আধটু সুযোগের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করব, নাকি নিজেদের জন্যে নিজেরাই উচ্চতর বিজ্ঞানের পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করব?

আমরা বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্বের তুলনায় যে শত বছর পিছিয়ে আছি সেটাতো একদিনে লাফ দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার নয়। একটি জাতিকে ধরে ইংরেজিতে খাওয়া ঘুমানো শিখিয়ে আর লাখে হাজারে ইংরেজি বিজ্ঞানের বই মুখস্ত করিয়ে ফেলেও সেই দূরত্ব পার হওয়া সম্ভব নয়। আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও তারা ইংরেজি অথবা ফরাসিতে কথা বলে, জীবনধারণ করে। শিক্ষার মাধ্যম বদলে দিলে যদি বিজ্ঞানে এগোনো যেত তাহলে এইসব দেশ তো আর সময়ের সবচেয়ে অনুন্নত দেশ হয়ে থাকতো না! তাই ভাষা না বদলে, মানসিকতার সঙ্গে মানানসই বিজ্ঞানের আবহ তৈরি করে যদি একটি প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা যায় তাহলে বিজ্ঞানের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যে দূরত্ব সেই দূরত্ব কিছুটা কমতে পারে। আরো আশার কথা হচ্ছে, জ্ঞান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উন্মুক্ত। এই সময়ের জ্ঞান নিয়ে এখন থেকেই আমরা যাত্রা শুরু করতে পারি। সেই যাত্রা খুব দ্রুতগতির হবে তা বলছি না। কিন্তু অন্তত একটা যাত্রা তো শুরু হবে! একটি জাতিকে যুগ যুগ ধরে ইংরেজ বানিয়ে তারপর আজকের বিজ্ঞান বোঝানোর মূর্খামি না করে তাকে এই সময়ের বিজ্ঞান তার মাতৃভাষাতে বুঝিয়ে বললেই সে আজকের বিজ্ঞানকে ধারণ করতে পারবে।

রজিউদ্দীন রতন:বিজ্ঞান-গবেষক ও লেখক ।