আমাদের হেরে যাওয়া ট্রাম্পরা

ওমর শেহাব
Published : 12 Oct 2016, 03:38 AM
Updated : 12 Oct 2016, 03:38 AM

যে সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি তার বাইরে কোনো কিছু দেখলে বেশ অদ্ভুত লাগে। আমেরিকায় এসে প্রথম ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য একই বাথরুম আর রাতে ক্যাম্পাসে মেয়েদের নিরাপদে ঘোরাফেরা করতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। অবশ্য আমেরিকার সব কিছু আস্তে আস্তে খোলাসা হচ্ছে। বুঝতে পারছি, একটি দেশ মানে আসলে দেশটির মানুষ।

অবকাঠামো, অর্থনীতিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সূচকের কথা চিন্তা করলে হয়তো পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলো (আমরা অবশ্য এখন মধ্য আয়ের দেশ) আর সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। কিন্তু আমরা যদি মানুষের কথা ভাবি তাহলে দেখব এদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

বাংলাদেশ আর আমেরিকা দুই জায়গাতেই অসম্ভব চমৎকার উদার, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, নারীবাদী চিন্তাভাবনার মানুষের দেখা পাওয়া যায়। আবার এর পাশাপাশি, দুই দেশেই এমন মানুষের দেখা মেলে যারা ধর্মান্ধ, গোঁড়া, চরমপন্থী ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার। আমাদের সৌভাগ্য যে, শেষের কাতারে থাকা মানুষগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যায় কমতে থাকে অথবা বুড়ো, অথর্ব, শক্তিহীন হয়ে যেতে থাকে। সাধারণত তাদের মধ্যে তরুণ আর নতুন প্রজন্মের খুব বেশি প্রতিনিধি থাকে না। তাই প্রকৃতির নিয়মেই আমরা মোটামুটি ভালোর দিকে যাচ্ছি।

আমেরিকা এই মুহূর্তে জটিল সময় পার করছে। অনেক বছর ধরে তাদের সমাজ, সংস্কৃতি আর রাজনীতিতে আস্তে আস্তে যে ফাটল তৈরি হচ্ছিল আজ সেই ফাটল দিয়ে হু হু করে বানের জল ঢুকছে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে নতুন নতুন কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন পৃথিবীর আনাচেকানাচে 'অামেরিকার প্রতীক' হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই লোকটি এখন পৃথিবীর সব উগ্রবাদী, ধর্মান্ধ, অগণতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক, সুবিধাবাদী মানুষের চোখের মণি। আমেরিকার অনেক মানুষ, অনেক প্রতিষ্ঠান এই লোকটিকে থামানোর চেষ্টা করেও পারেনি। তারা ব্যর্থ হয়েছে এই দানবকে হারাতে। এখন গোটা আমেরিকার শেষ ভরসা হিলারি ক্লিনটন। আশার কথা হল, এর আগেও আমেরিকা বিভিন্ন সময়ে দানবের জন্ম দিয়েছে (অন্যান্য দেশের মতো) এবং থামাতেও পেরেছে।

বিভিন্ন দেশের এখন যারা তরুণ দানব তারা সবাই স্বপ্ন দেখছেন, বড়ে হয়ে তারা যার যার সমাজের, দেশের, জাতির বা ধর্মের 'ডোনাল্ড ট্রাম্প' হবেন। মনে প্রশ্ন জাগে– একটি দেশ কোথায় পৌঁছুলে তার ভবিষ্যত এতটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে? কতটুকু ভুল রাস্তায় কত দিন ধরে হাঁটলে এত বড় বিপদে পড়তে হয়? আমাদের দেশে কি আমরা কখনও এত বড় বিপদে পড়েছি? পড়লে তার জন্য কত বছর কতটুকু ভুল রাস্তায় হাঁটতে হয়েছিল?

বাংলাদেশের জন্য এত বড় বিপদ হয়েছিল তখন, যখন প্রথমবারের মতো জামায়াত রাজনীতি করার অনুমতি পেয়েছিল। কেন? কারণ, জামায়াত হল বাংলাদেশের অস্তিত্ত্ব আর সংজ্ঞার ঠিক বিপরীত নাম। তাদের রাজনীতি করতে দেওয়া, সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া আত্মহত্যার শামিল। যে ডাকাত দল গ্রামে আক্রমণ করে তাদের কেউ মোড়ল বানায়? বানায় না। জামায়াতকে সংসদে জায়গা দেওয়ার মতো বড় বিপদ ডেকে আনার জন্য আমাদের বেশ কিছু বছর ভুল পথে হাঁটতে হয়েছিল– ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। শাহবাগ আন্দোলনের কারণে জামায়াত এখন একটি প্রায় হারিয়ে যাওয়া নাম। কিন্তু তাদের অশুভ আত্মা, নোংরা আদর্শের নানা অংশ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

যখন শাহবাগ আন্দোলন প্রথম শুরু হয়, সবার মনে আছে, নিয়মিত টিভিতে কী দেখাত, পত্রিকায় কী বলা হত? তখন পর্যন্ত আমরা জানতাম না এ আন্দোলন সফল হবে কি না। জানতাম না, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া থেমে যাবে নাকি চলতে থাকবে। পুলিশ সবাইকে গ্রেপ্তার করতে পারবে কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছিল না। গ্রেপ্তার করলে বিচার ঠিকমতো হবে কি না, বিচার করার পর রায় কার্যকর করা যাবে কি না– সব কিছু নিয়েই ছিল চরম অনিশ্চয়তা।

যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের নিশ্চয়ই ছিল চরম আত্মবিশ্বাস আর অধ্যবসায়। তা না হলে দেশে আর বিদেশে এত ধরনের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে তারা টিকে থাকতে পারতেন না। কিন্তু শুরুর দিকের চরম অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের 'ডোনাল্ড ট্রাম্পরা' তাদের নোংরা চেহারা ঠিকই দেখিয়ে দিয়েছিল। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, যদি শাহবাগ আন্দোলন সফল না হত তাহলে তাদের উদ্ধত আস্ফালন স্থায়ী হয়ে যেত।

আমরা সৌভাগ্যবান, তা হয়নি। শাহবাগ আন্দোলন সফল হয়েছে আর এসব নোংরা ট্রাম্পরা আবার গর্তে ঢুকে গেছে।

এখন যে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে সেটি শুরু হয় ২০০৯ সালে। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক বিতর্কিত অধ্যাপক নিয়মিত টিভিতে কী বলতেন আর পত্রিকায় কী লিখতেন। বিচার স্বচ্ছ আর আন্তর্জাতিক হচ্ছে না– এই বায়বীয় কথা বাংলা ভাষাভাষী গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। শাহবাগ আন্দোলনের বছর, ২০১৩ সালে, তার এই প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে।

আজ যদি শাহবাগ আন্দোলন সফল না হত, যদি সরকার বিদেশ থেকে আসা ফোন কলগুলোতে দেশের মানুষের ইচ্ছার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত, সেই অধ্যাপক আজ আরও উদ্ধতভাবে টিভির পর্দা কাঁপিয়ে বলতেন, "বলেছিলাম না, যুদ্ধাপরাধের বিচার আসলে রাজনৈতিক ধান্দাবাজি। বলেছিলাম না, দেলওয়ার হোসেইন সাঈদী যুদ্ধাপরাধী নন!"

স্বৈরাচারদের ছায়ায় ফুলেফেঁপে ওঠা দুটি রাজনৈতিক পরিবারের দুই তরুণ সদস্য শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে নিয়মিত কী কী মন্তব্য টিভির টকশোতে করতেন, কারও মনে আছে? এদের কপাল খারাপ, ইউটিউব বলে একটি ওয়েবসাইট আছে, যেখানে টকশোতে বলা তাদের সবার ভিডিও মজুদ আছে। এদের একজন চ্যানেল আইয়ের একটি টকশোতে ব্লগ-লেখকদের নিয়ে ভীষণ নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। তিনি আমাদের সংসদের সদস্যও হয়েছিলেন।

তাই ভুল শুধু আমেরিকা নয়, আমরাও করি। একই রাজনীতিবিদের অংশ নেওয়া ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবরের একটি টকশোর ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া গেল, যেখানে তিনি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে সম্বোধন করছেন 'কাদের মোল্লা সাহেব' বলে। ভাগ্যিস, 'শহীদ' বলেননি!

ইউটিউবে আরেক রাজনীতিবিদেরও এ রকম ভিডিও পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে তারা ইতিহাসের ভুল দিকে ছিলেন। একটি ভিডিওতে দেখা গেল, এই রাজনীতিবিদ বলছেন, গণজাগরণ মঞ্চের উচিত হয়নি জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি করা। একই রাজনীতিবিদের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেল, তিনি 'হেফাজতে ইসলাম'এর জন্ম গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে এমনটি দাবি করছেন, যা আসলে ডাহা মিথ্যা।

শাহবাগ আন্দোলন যদি সফল না হত তাহলে এই রাজনীতিবিদ তার মিথ‌্যা প্রচারণা চালিয়ে যেতেন আরও কত বছর কে জানে!

শুধু রাজনীতিবিদদের কথাই-বা বলি কেন, বিতর্কিত ও স্বঘোষিত সেই বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকের নামটি মনে থাকার কথা সবার। তিনি হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাস আর বিএনপির বাসে আগুন দেওয়ার বিষয়টি শোষিত মানুষের 'শ্রেণিসংগ্রাম' নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর প্রকাশিত তার সেই উপসম্পাদকীয়র কথা মনে আছে, যেখানে 'বিজ্ঞানবাদ' বলে একটি আজগুবি শব্দ আবিষ্কার হয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা একটি রাজনৈতিক প্রচারণা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল?

শাহবাগ আন্দোলন যদি ব্যর্থ হত, যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি থেমে যেত, কয়েক বছর পর এই লোক কী হতেন? জাতীয় অধ্যাপক? বিজ্ঞান একাডেমীর সভাপতি? প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা? ভাবাই যায় না!

এছাড়া দেশের বড় বড় বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিকের অনেকগুলো যুদ্ধাপরাধের বিচার বিতর্কিত করার জন্য বহু উপসম্পাদকীয় ছেপেছে। ঠিক যেমন বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার পরদিন পত্রিকাগুলো সেটি 'ভালো কাজ' হিসেবে অভিহিত করেছিল! পঁচাত্তরের পর তারা ওই কাজ করেছিল বলে যুদ্ধাপরাধের বিচার এতগুলো দশক আটকে ছিল। এবার যদি শাহবাগ হেরে যেত, যুদ্ধাপরাধের বিচার আবারও আটকে যেত, এই পত্রিকাগুলো সমস্বরে বলত– "আমরা তো বলেছিলাম এ বিচার না করতে।"

তারপর ঠিকই তারা নিয়মিত যুদ্ধাপরাধীদের লেখা ছাপাত আর সাক্ষাৎকার নিত– যেমন তারা নিয়মিত করে গেছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পরা শুধু আমেরিকাতেই জন্মায় না, ঠিকঠাক পরিবেশ পেলে সব দেশে, সব সমাজেই জন্মায়– ছোট, বড়, মাঝারি সব ধরনের ট্রাম্প। আমাদের ইতিহাসে ট্রাম্পদের দেখেছি, এখনও দেখছি, ভবিষ্যতেও দেখব।

কী সৌভাগ্য, আমরা শাহবাগের সময় আমাদের ট্রাম্পদের হারিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা যেমন কল্পনাও করতে পারি না ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সফল না হলে একাত্তরে কী হত, তেমনি কল্পনাও করতে পারি না শাহবাগ আন্দোলন সফল না হলে দেশটার কী দশা হত আজ!