জাতীয় শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষা, বিয়ে ও নিদারুণ রসিকতা

এনামুল হক ভূঁইয়া
Published : 11 Oct 2016, 02:38 AM
Updated : 11 Oct 2016, 02:38 AM

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ডক্টর কুদরাত-ই-খুদার তত্ত্বাবধানে প্রণীত হয় 'কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন-১৯৭২'। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এ শিক্ষা কমিশনের সুপারশি নানাবিধ অপবাদে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। ১৯৭৮-৮৭ সাল পর্যন্ত 'আমরা এসো নিজে করি'র তত্ত্বাবাধানে ছিলাম। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে শিক্ষানীতির নামে গঠিত হয় 'শিক্ষা কমিশন' বা 'শিক্ষা কমিটি'। যেমন: 'মফিজ উদ্দিন কমিশন-১৯৮৮', 'সামসুল হক শিক্ষা কমিটি', 'মনিরুজ্জামান কমিশন-২০০৩', 'ড. এম এ বারী কমিশন ২০০২' ও 'জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০'। যদিও 'মনিরুজ্জামান কমিশন-২০০৩' লক্ষণীয় কিছু সুপারিশ করে, তথাপি জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রণীত 'জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০' ছাড়া কোনোটিকে 'জাতীয় শিক্ষানীতি' বলা যায় না।

কেন? সে বিতর্কের চেয়ে এ শিক্ষানীতিতে কী আছে তার একটি ক্ষুদ্রাংশে আলোকপাত করাই উত্তম। ইউনেসকোর পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৬২%। যেখানে এখনও ৩৮% মানুষ শিক্ষার অধিকারবঞ্চিত, সেখানে উচ্চশিক্ষা বিলাসিতা নয় কি? বটে। কিন্তু এ বিলাসিতা করতে হবে। তবে কতটা?

'জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০'এর ৮ অধ্যায়ে (উচ্চশিক্ষা) কৌশল অংশে চার বছর মেয়াদী স্নাতককে (সম্মান) উচ্চশিক্ষা বলা হয়েছে এবং সমাপনী ডিগ্রি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মাস্টার্স, এম.ফিল বা পিএইচডি বিশেষায়িত শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১১ অধ্যায়ে (বিজ্ঞান শিক্ষা) উচ্চশিক্ষা অংশে আবারও জোর দিয়ে বলা হয়েছে চার বছর মেয়াদী স্নাতক (সম্মান) প্রান্তিক ডিগ্রি।

শিক্ষা মৌলিক অধিকার, উচ্চশিক্ষা নয়। আর বিশেষায়িত শিক্ষা তো একেবারেই নয়। তাহলে কেন আমরা বিশেষায়িত শিক্ষাকে অধিকারের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি? যেখানে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জাপান ও জার্মানির মতো উন্নত দেশে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী বিশেষায়িত শিক্ষা নিচ্ছে, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলো হাজার হাজার বিশেষায়িত শিক্ষার্থীর ভারে কাহিল। বিশ্বের তাবৎ নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভূরি ভূরি মাস্টার্স শিক্ষার্থী নেই। একটি উদাহরণ বিষয়টি পরিষ্কার করবে।

অতিসম্প্রতি প্রকাশিত কিউএস র‌্যাংকিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি ৭০১+। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ৭০১+। কেন্ট স্টেটের পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স শিক্ষার্থীর সংখ্যা বড়জোর ২৫ জন (দুই সেমিস্টার মিলে), অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম করে হলেও ৭৫, অর্থাৎ তিন গুণ। পক্ষান্তরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তালিকায় ওঠেনি। অথচ জগন্নাথে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম করে হলেও ৮০ জন।

শিক্ষার্থীর নূন্যতম সুযোগসুবিধা ব্যতীত ও উদ্দেশ্যহীনভাবে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বিশেষায়িত শিক্ষায় তথাকথিত শিক্ষিত করা অপচয় বই কিছু নয়!

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বল্প বাজেটের একটা বিরাট অংশ এসব অনাকাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় হয়। র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্ট স্টেট সমান হলেও বাজেটে তুলনাটাই অবান্তর।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অকারণে মাস্টার্স করছে চার বছর মেয়াদী অনার্স করা শিক্ষার্থীরা। অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর কারণে বিভাগ, আবাসিক হল ও লাইব্রেরিসহ সর্বত্র চাপ বাড়ছে। আবাসিক হলগুলোর সিট অপ্রতুলতার সুযোগ নিচ্ছে তথাকথিত ছাত্র রাজনৈতিকরা। হলে সিট দেওয়ার নামে চলছে নোংরা রাজনীতি। অকারণে বাড়ছে শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা। তাতে শিক্ষকেরা গবেষণায় সময় দিতে পারছেন না। তাছাড়া বাড়ছে সেশনজট। চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘাটতি। অপচয় হচ্ছে সরকারের তথা জনসাধারণের লাখ লাখ টাকা। কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কেন?

২০০৩ সালের পূর্বে বাংলাদেশে তিন বছর মেয়াদী স্নাতক (সম্মান) ও এক বছরের মাস্টার্স প্রচলিত ছিল। তখনও আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। এখনও বিশ্বের কিছু দেশে তিন বছর মেয়াদী সম্মান চালু আছে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে চার বছর মেয়াদী সম্মান চালু হয়। কথা ছিল, চার বছর মেয়াদী সম্মানকে সমাপণী ডিগ্রি ঘোষণা করা হবে। চার বছর মেয়াদী সম্মান ডিগ্রিধারীদের আগের (৩+১ = ৪) মাস্টার্সের সম্মান দেওয়া হবে। এই নিয়ে ২০০৩ সালে ছাত্র আন্দোলনও হয়েছিল। তখন জগাখিচুড়ি কিছু একটা বলে ছাত্র আন্দোলন থামনো হয়েছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান করা হয়নি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঁচ (৪+১ = ৫) বছরের উচ্চশিক্ষা। সেশনজটের কারণে তা অনেক সময় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আট-নয় বছরে গড়ায়। এতে করে অভিভাবকের খরচ বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা কর্মস্পৃহা হারায়। কর্মজীবনে গিয়ে তারা ঝিমায়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক বছরের মাস্টার্স করতে দুই বছর লাগে। এ দুই বছরে একজন শিক্ষার্থীর পিছনে সরকার ও অভিভাবকের অনেক অর্থ অপচয় হয়। পক্ষান্তরে, শিক্ষার্থীরা এ দুই বছর পড়াশুনার পরিবর্তে চাকরি খোঁজে। অনেকে ঠিকমতো ক্লাশে যায় না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সুযোগসুবিধা গ্রহণ করে বিসিএস গাইড, ব্যাংকার্স রিক্রুটেমেন্ট গাইড ইত্যাদি পড়ে। যারা অধিকতর ভালো শিক্ষার্থী তারা পড়ে আইএলটিএস, টোফেল, জিআরই, জিম্যাট ইত্যাদি। তাতে মাস্টার্স ডিগ্রির (বিশেষায়িত শিক্ষা) অসারতা প্রামণিত হয়। ব্যহত হয় বিশেষায়িত শিক্ষার উদ্দেশ্য।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক (সম্মান) উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীকে মাস্টার্সে ভর্তি করাচ্ছে। প্রকৌশলীরা যদি স্নাতক সম্মানের পর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে, তবে অন্যরা পারছে না কেন? তাছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে এভাবে গণহারে মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে হয়। কথিত আছে, বিয়ে করতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাগে। এটি কেবল একটি যুক্তি। বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত দেশে স্নাতক সম্মানের পর শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। অতঃপর পেশা অনুযায়ী প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমরা চলেছি উল্টো রথে।

একেবারে সাদামাটা পরিসংখ্যান। মনে করি, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর সাত হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ধরি,তাদের পাঁচ হাজার মাস্টার্স পর্যন্ত যায়। কিন্তু, সেশেনজটের কারণে দুই-তিনটি ব্যাচের মাস্টার্স শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত থাকে। তথাপি, শুধু দুই ব্যাচের ১০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য সরকারে প্রতি বছরে নূন্যতম খরচ হয় প্রায় ৪৮ কোটি টাকা (আনুমানিক হিসাব), যা প্রতিবছর ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাবদ বরাদ্দের দ্বিগুণ। এসব শিক্ষার্থীর পিছনে অভিভাবকদের ব্যয়ও নেহাত কম নয়। দুই বছরের অপ্রয়োজনীয় মাস্টার্স না করে কর্মজীবনে প্রবেশ করলে এরা আয় করত তার চেয়ে ঢের বেশি।

আরও একটি অতিসাধারণ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, একজন শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছে। অতঃপর ব্যাংকে চাকরি নিচ্ছে। তার দুই বছরে করা মাস্টার্স ডিগ্রি ব্যাংকের কী কাজে আসবে? অথচ চার বছরের অনার্স ডিগ্রির পর সে যদি ব্যংকে যোগদান করে এক বছর ব্যাংকিং বিষয়ে ট্রেনিং নিত, তার পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেত। দেশকে এক বছর বেশি সেবা দিতে পারত।

কেবল বিয়ে করা, চাকরির আবেদন করা, বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার জন্য মাস্টার্স করা অর্থহীন। সবাইকে গণহারে মাস্টার্স ভর্তি না করে, প্রতিটি বিভাগে মেধাবী ও শিক্ষকতা বা গবেষণায় আগ্রহী ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো উচিত।

এতে গবেষণার মান বাড়বে। অর্থের অপচয় কমবে। মেধাবী ও আগ্রহীরা গবেষণায় ও শিক্ষকতায় আসবে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মানবৃদ্ধি পাবে। উচ্চশিক্ষা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। বাকিরা অতি দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। প্রয়োজনীয় পেশগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবে। দেশ অনেক দীর্ঘ সময় তাদের সেবা পাবে। তাছাড়া প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। আর তাতে বিভিন্ন প্রফেশনের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ক্লাস নেবেন। এসব বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

জাতীয় শিক্ষানীতির তোয়াক্কা না করে ৫ম ও ৮ম শ্রেণির সমাপণী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতির কোথাও এ বিষয়টি ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থায় এমন আরও অনেক কিছু হচ্ছে, যা জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই। সেসব নীতি কারা বাস্তবায়ন করছে? কার স্বার্থে করা হচ্ছে?

শিক্ষানীতি কি কেবল কাগজে আর অনলাইনে থাকার জন্য? এ নিয়ে চলছে এক নিদারুণ রসিকতা। কেবল নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায় এমন একটি বিষয় বিগত ছয় বছর যাবত ঝুলে আছে। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় শিক্ষানীতির উচ্চশিক্ষা অংশ বাস্তবায়নের উদ্দ্যোগ নেবে। তাতে অতিসম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে বিতর্কে সূত্রপাত হয়েছে তা তিরোহিত হবে। আশা রাখি, ইউজিসিও যথাযথ সহযোগিতা করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য তাগাদা দেবে।

উচ্চশিক্ষা ও বিশেষায়িত শিক্ষার নামে চলছে অপচয়। উচ্চশিক্ষা অধিকার নয়, সুযোগ। সুযোগ কেবল তারই প্রাপ্য যার যোগ্যতা ও আগ্রহ আছে। তাছাড়া অকারণে অনাগ্রহী কিছু শিক্ষার্থীকে বিশেষায়িত শিক্ষায় টেনে নেওয়া সমীচীন নয়।