এক টিপাইমুখ:বহু শঙ্কা বাংলাদেশের

নাহরীন আই খান
Published : 26 Dec 2011, 06:00 PM
Updated : 26 Dec 2011, 06:00 PM

বাঁধ আর ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার দ্বন্দ্বঃ
আমরা জানি, বাঁধের জলাধারে বিপুল পরিমান পানি আটকে রাখা হয়। অল্প জায়গায় বিপুল পরিমানের পানি ধরে রাখলে, স্বল্প পরিসরের ঐ জায়গার ভিত্তি ভূমি এবং তার আশেপাশের শিলাস্তরের ওপর ওই বদ্ধ পানির চাপ ব্যাপক হয়। ফলে মাটির নীচের সছিদ্র শিলাস্তরের ফাঁকে জমে থাকা পানির স্বাভাবিক চাপ বা POROUS PRESSURE, বাঁধে জমিয়ে রাখা বাড়তি পানির চাপ এবং পানির ক্রমাগত শিলাস্তর ভেদ করে চুঁইয়ে যাওয়ার প্রাকৃতিক প্রবণতা , এই তিনটি প্রক্রিয়া মিলেমিশে মাত্রাতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। যা বাঁধ চালু হবার কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা যেতে পারে।

এছাড়াও প্লেট টেকটনিক ক্রিয়ার কারণে ভূত্বকের শিলাস্তরের বিচ্ছিন্ন হবার যে প্রবণতা, যা পরস্পর মধ্যকার ঘর্ষণ শক্তির কারণে একত্রিত থাকে , তা বাঁধের কারণে সৃষ্ট জমাকৃত পানির বাড়তি চাপ সইতে না পেরে স্লিপ স্ট্রাইকের বা চ্যুতির সৃষ্টি করতে পারে, যা পরবর্তীতে ভুমিকম্পের "হাইপো সেন্টার" সৃষ্টি করতে পারে। জলাধারের বাড়তি পানির চাপের কারণে বেড়ে যাওয়া এই ভূকম্পন প্রবণতাকে বলে RIVER INDUCED SEISMICITY (RIS)। ১৯৩২ সালে আলজেরিয়ায় কুয়েড ফডডা প্রথম এই ধরনের ভূমিকম্প পরিলক্ষিত হয়। সারা পৃথিবীতে এই পর্যন্ত ৭০টি ভূমিকম্পের কারণ এই RIS.

আরও মজার বিষয় হচ্ছে, এই RIS এর কারণে সংঘটিত এ যাবত কালের সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পটি (৬.৩) ১৯৬৭ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রেই হয়েছে। কোয়েনা বাঁধের কারনে ঘটে যাওয়া এই ভূমিকম্পটি তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কি মি দূরেও তীব্রতার সাথে আঘাত হেনেছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জলাধারের উচ্চতা ১০০ মিটারের উপরে হলেই RIS এর সম্ভাবনা যেখানে বেড়ে যায়, সেখানে ১৬৮.২ মিটার উচ্চতার এই টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের জন্য কী পরিনতি ডেকে নিয়ে আসবে?

সবচেয়ে ভীতিকর তথ্য হচ্ছে, সুরমা বেসিনের শিলাস্তরে রয়েছে অসংখ্য ফাটল বা চুত্যি, আর এটি খুবই নরম শিলা দিয়ে গঠিত । বরাক অববাহিকার অসংখ্য FAULT LINE এখানকার নদী আর শাখা নদীরগুলোর গতিপথ নিয়ন্ত্রন করে । এইসব চুত্যি আর ফাটলের জন্য এই সমগ্র এলাকায় গত ২০০ বছরে ৫ মাত্রা বা তারও বেশী মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ১০০ টিরও বেশি। গত ১৫০ বছরের টিপাইমুখের ১০০ কি মি ব্যাসার্ধের মধ্যে ২ টি ৭+ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে যার মধ্যে ১৯৫৭ সালের ভূমিকম্পটি ছিল প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ থেকে মাত্র ৭৫ কি মি দূরে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের অক্ষটি অবস্থিত এই মহাদেশের বহুল পরিচিত সম্ভাব্য ক্রিয়াশীল TAITHU FAULT এর উপর। এই FAULT টি এর ভূতাত্তিক অবস্থানগত গঠনের কারণে যে কোন সময়ই ভূমিকম্পের এপি সেন্টার হয়ে উঠতে পারে।
ভূতাত্তিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার কথা যদি বাদও দেই, প্রস্তাবিত এই বাঁধের ভৌগোলিক অবস্থান সারা পৃথিবীর ৬টি মারাত্মক ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকার মধ্যে একটি (উত্তর-পূর্ব ভারত)। ভারত ও বার্মা প্লেটের টেকটনিক মুভমেন্ট বা এই দুইয়ের সংঘর্ষের জন্য এই এলাকায় এই ধরনের বাঁধ নির্মাণ করলে তা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাও অনেক । আর বাঁধটি ভেঙে গেলে ভাটির ১০০ কি মিতে অবস্থিত বাংলাদেশের কী হবে?

টিপাইমুখ প্রকল্প মূলত তিন ধরনের কাজ করবে, ১, বন্যা নিয়ন্ত্রন; ২, সেচ প্রদান; এবং ৩, বিদ্যুৎ উৎপাদন। বরাক নদীর উজানে এই বাঁধ নির্মাণ মানেই হচ্ছে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের পরিবর্তন ঘটানো। আমরা জানি, এই নদীটিই দুইভাগে ভাগ হয়ে সুরমা আর কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর বাংলাদেশের পাঁচটি প্লাবন ভূমি পার হয়ে এই দুই নদী মেঘনায় যেয়ে মিশেছে। যখনই ভারত জলসেচের জন্য বরাকের পানি প্রত্যাহার করে আসামের কৃষিকাজে সেচ প্রদান করবে অথবা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত পানি জমিয়ে রাখবে আর বর্ষা মৌসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রনের উসিলায় মাঝে মাঝে পানি ছেড়ে দেবে তখন এদেশের এই ৫ প্লাবন ভূমির মানুষ খরায় পুড়বে, আর বন্যায় ডুববে। বাঁধ তৈরি হলে ভুমিক্ষয় বেড়ে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। যদি টিপাইমুখ বাঁধের নিচে ভুমিক্ষয় বেড়ে যায় তাহলে সুরমা -কুশিয়ারা নদীর বুক পলি দিয়ে ভরাট হয়ে যাবে। ফলে নদী তার স্বাভাবিক ধারন ক্ষমতা হারিয়ে অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়বে। আরেকটি দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা হচ্ছে, স্বাদু পানি যেহেতু লবনাক্ত পানির চেয়ে হালকা এবং লবনাক্ত পানির চাপ যেহেতু বেশী ফলে সম উচ্চতার সমুদ্রের লবনাক্ত পানি সম উচ্চতার নদীর পানির দিকে প্রবাহিত হয়।নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে গেলে (বাঁধের কারণে) সমুদ্রের লবনাক্ত পানি প্লাবনভূমিকে লবনাক্ত করে ফেলতে পারে। এছাড়াও ভূগর্ভস্থ WATER TABLE এর উচ্চতা কমে গেলেও লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে। যদিও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল তবুও বাঁধ নির্মাণ যেহেতু স্বল্পকালীন বিষয় নয়, তাই এর সুদূর প্রসারী প্রভাব নিয়েও আমাদের ভাবা উচিত।

নিজস্ব ভাবনাঃ
লেখাটি একেবারেই একটি নির্দলীয় পরিবেশবান্ধব খুব সাধারন ভাবনাপ্রসূত। তাই রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এই বিতর্কিত অবস্থান থেকে দূরে যেয়ে নিজস্ব কিছু ভাবনা কে তুলে ধরতে চাইঃ
প্রশ্ন উঠতে পারে আমরা দুর্বল জাতি কিনা। আমি আসলেই নিশ্চিত নই যে আমরা দুর্বল কিনা। হয়ত পাঠকরা ভাল বলতে পারবেন। তবে আমার মনে হয় আমাদের পররাষ্ট্র নীতি দুর্বল হতে পারে, পরাশক্তির কাছে 'জো হুকুম জাহাপনা" একটা ভাব থাকতে পারে, কিন্তু রক্তে আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস, এটি যেন আমরা ভুলে না যাই । দ্বিতীয়তঃ আমাদের ক্ষেত্রে ভারতের বন্ধুসুলভ রাজনীতিকে "আশ্চর্যবোধক চিহ্ন" দিয়ে আমি ব্যবহার করতে চাই। ২০০৭ সালে ভারতের সাথে এক চুক্তিতে ভারত কথা দিয়েছিল বন্যা শুরুর আগাম সংবাদ আমাদের ১৫ দিন আগে জানিয়ে দেবে, স্লুইস গেট খুলে দেবার কথা ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দেবে। আজও ভারত এই কাজটি করেনি। ১৯৯৬সালে "ভারত- বাংলাদেশ গঙ্গা চুক্তিতে" ভারত " উভয় দেশের পারস্পরিক মঙ্গলের স্বার্থে জলসম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারে সদিচ্ছা" পোষণ করলেও তাদের সদিচ্ছা বারবারই স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হচ্ছে। মনমোহনের মন মোহিত করা আশ্বাস বাংলাদেশের নাভিশ্বাসের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে । তাই এই যদি হয় বন্ধুতা তবে বৈরিতা কোনটা? পাঠক জানেন কি? তৃতীয়তঃ টিপাইমুখ নিয়ে সব আলোচনার আগে ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনা কৌশল আমাদের বুঝতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশেশজ্ঞরা একটি বিষয় খতিয়ে দেখতে পারেন যে, যেখানে টিপাইমুখে মাত্র ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, সেখানে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এত বড় অবকাঠামো কেন ? চতুর্থতঃ ভারতের আন্তঃরাজ্য ও আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক যা বহুকাল ধরে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ, টিপাইমুখ বাঁধ কি সেখানে শুধুই বাঁধ, নাকি অন্য কোন স্বার্থ সেখানে রয়েছে? পঞ্চমতঃ যৌথ নদী কমিশন ৪০ বছরে কী করল? এই প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করা আজ ভীষণ প্রয়োজন। ভারত শুধু টিপাইমুখেই নয়, বরাকের অপর আরও ৪টা , ব্রক্ষপুত্রের অপর ১২ টা ড্যাম নির্মাণ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তখন শুধু মেঘনাই নয় ব্রক্ষপুত্রও অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে । সবকটি অভিন্ন নদীর অপর ভারতীয় আগ্রাসনের কী প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়বে– এই বিষয়টি আজ সার্বিকভাবে সামনে আসা উচিত। ষষ্ঠতঃ আজও আওয়ামী লীগ আর ফারাক্কা , দুইটি নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই, সরকারের ভেবে দেখা উচিৎ , ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, অথবা ঘটে যাওয়া ভুলের পুন:প্রকাশ আবারও তাঁরা ঘটতে দেবেন কিনা?

পুরো পৃথিবী আজ যখন বাঁধ তৈরির বিপক্ষে , সবাই যখন "যত বড় বাঁধ , তত বড় বিপদ" এই ভাবনাকে ধারণ করছে, তখন নব্য পরাশক্তি ভারত বাংলাদেশের গলা টিপে ধরার এক মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে এই টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে। আমরা যদি গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দাই হই, তবে, মানুষসহ, সব কিছু; ছোট শ্যাওলা, নাম না জানা ছুটে চলা মাছ, কচুরিপানা,শামুক, এদের সবারই বেঁচে থাকার বাঞ্ছিত পরিবেশ কেন আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করি? কেন বুঝিনা, নদী মানুষেরই মত তার শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে জীবনের শেষ বেলায় সমুদ্রে পতিত হয়। নদীর স্বাভাবিক গতিকে স্তব্ধ করে দেয়া আর মানুষকে তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থান থেকে জোর করে সরিয়ে দেয়া একই কথা।

মানুষ হত্যার বিচার যদি হয়, তবে নদী হত্যার বিচার চাইতে দোষ কী?

নাহরীন আই খান:জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক।

তথ্যসূত্র :
১) বিতর্কিত টিপাইমুখ বাধ: সামগ্রিকতার নিরিখে- এম আনোয়ার হোসেন (২০০৬)
২) Silenced Rivers: The Ecology and Politics of Large Dams, by Patrick McCully, Zed Books, London, 1996
৩)http://www.somewhereinblog.net/blog/dinmojurblog/28953317
৪)সাম্প্রতিক কালের সংবাদপত্র, টিভি নিউজ এবং লেখকের নিজস্ব ভাবনা